বিজ্ঞাপন

কমছে খেলার মাঠ, বাড়ছে শিশুদের আত্মহননের প্রবণতা

June 7, 2022 | 6:15 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: উত্তরার জাভেদ আহমেদ (ছদ্মনাম) বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তার স্ত্রী সীমা ইসলামও (ছদ্মনাম) চাকরি করেন বেসরকারি একটি ব্যাংকে। তাদের ছয় বছর বয়সী একমাত্র সন্তান তূর্য (ছদ্মনাম)। সন্তানকে বাসায় দেখাশোনা করতেন তাদেরই একজন নিকটাত্মীয়। কিন্তু তূর্যের সময় কাটতো বাসায় টিভি ও স্মার্টফোনে ইউটিউব বা গেমিং নিয়ে। স্কুলে গেলেও তূর্যর মন পড়ে থাকতো বাসায়। বাবা-মা অফিস শেষে বাসায় এলেই তূর্য ব্যস্ত হয়ে পড়তো মোবাইল ফোন নিয়ে। মোবাইল গেমিং ও ইউটিউব দেখার মাঝে বাধা দিলেই তূর্য উত্তেজিত হয়ে পড়তো।

বিজ্ঞাপন

জাভেদ আহমেদ বলেন, ‘তূর্যকে আমরা প্লে-গ্রুপে ভর্তি করাই স্কুলে। ভেবেছিলাম স্কুলে গেলে হয়তো মোবাইলের আকর্ষণটা কমে যাবে। কারণ এই বয়সের বাচ্চারা তো স্কুলে খেলাধুলো করেই সময় কাটাবে স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু স্কুলে আসলে খেলার মাঠ না থাকায় সেটা তার পক্ষে সম্ভব না। আবার দেখা যাচ্ছে ইনডোর গেইমের দিকে তার তেমন আগ্রহ নেই। আমরা দু’জনই চাকরিজীবী হওয়ার কারণে মাঠে নেওয়ার সময়টা তেমন হয় না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথমে ভাবতাম মোবাইল নিয়ে ফেলাটাই হয়তো সমাধান। কিন্তু আজকাল তার মাঝে এই অল্প বয়সেই বেশ কিছু প্রবণতা দেখছি যা অস্বাভাবিক। কথায় কথায় সে আমাদের ধমক দেয় আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে ওর গুরুত্ব বুঝব- এমন কিছু। আমরা প্রথমে ভাবতাম- হয়তোবা রাগের থেকে বলছে। কিন্তু মাঝে একদিন ওর মা মোবাইল নিয়ে যাওয়ার পরে সে এমন কিছু একটা করে যা আসলে আমাদের ভয় পেতে বাধ্য করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা দু’জনই তূর্যকে নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শে সময় দিচ্ছি। চেষ্টা করছি ওর সঙ্গে মিশে কিছুটা বোঝার জন্য। কিন্তু খেলার মাঠের অভাবটা আসলে এই ঢাকা শহরে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে তারা জানায় মাঠ বিষয়ে অপারগতার কথা। এমন অবস্থায় আসলে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ওকে আলাদাভাবে বেশি সময় দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।’

বিজ্ঞাপন

মহাখালীতে বাস করা বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা স্বাধীন চৌধুরীর (ছদ্মনাম) গল্পটা অবশ্য একটু ভিন্ন। একসময় গ্রামে বড় হয়ে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় পরিবার নিয়ে আসার পর থেকেই সন্তানের মাঝে দেখতে পান কিছু পরিবর্তন।

স্বাধীন চৌধুরী বলেন, ‘আমার ছেলে রাফিদ চৌধুরী এ বছর সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হলো ঢাকায়। প্রায় ৫ থেকে ৬ মাস হয়ে গেল স্কুলে ভর্তির পরে। কিন্তু প্রতিদিন কেমন যেন ওর মাঝে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। আগে খুলনায় যে স্কুলে পড়তো সেখানে খেলাধুলোর পরিবেশ ছিল। সে নিজেকে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলোয় ব্যস্ত রাখত। কিন্তু এখানে আসার পরে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিশলেও খেলার মাঠে যাওয়ার সুযোগ তেমন হয় না। এই সময়ে সে মোবাইল গেমিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘মাঠের অভাব তো আর মোবাইল ডিভাইসে পূরণ হবে না। আমাদের সময়ে এই বয়সে যখন পড়াশোনা, খেলাধুলো, গান-বাজনা, অভিনয়সহ নানা রকমের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে নিজেদের বিকশিত করার সুযোগ ছিল এখন তেমনটা দেখছি না। সবচাইতে ভয় পাই যখন দেখি রাফিদ আমার মোবাইল থেকে পর্নোগ্রাফি ব্রাউজিং করছে। প্রথমে ক্ষিপ্ত হলেও পরে নিজেকে সামলে নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলি। সে জানায়, স্কুলে বন্ধুদের কাছ থেকে শিখেছে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘বিষয়টি স্কুলের শিক্ষকদের জানানোর পাশাপাশি সেদিন থেকে আমরা রাফিদকে আলাদাভাবে সময় দেই। একসঙ্গে ভাত খাওয়া, সকালে কিছুটা সময় কাটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। কারণ ওকে বাধা দিতে গেলেই যদি ভিন্ন কিছু করে বসে, সেই আতঙ্কটা কাজ করে। তাছাড়া আমি তো ঢাকায় আনার পরে ওকে খেলার মাঠে যাওয়ার সুযোগ দিতে পারছি না। এটা ভেবেও খারাপ লাগে। কবিগুরুর মতো বলে উঠতে ইচ্ছে করে— দাও ফিরিয়ে এ অরণ্য, লও এ নগর। অন্তত আমাদের সন্তানরা যেন এই ঢাকা শহরেও মাঠে নিজেদের সেভাবেই ব্যস্ত রাখতে পারে যেমনটা পেরেছিলাম আমরা।’

শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি

এরকম ঘটনা যে শুধুমাত্র রাফিদ বা তূর্য ও তাদের অভিভাবকদের ক্ষেত্রেই ঘটছে, তা কিন্তু নয়। রাজধানীসহ দেশের অনেক জায়গার শিশুরা বর্তমানে এই সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দেশে বেড়েছে শিশুদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতাও।

মোবাইল ডিভাইস বা কাঙ্ক্ষিত চাহিদার জিনিসটি না পেয়ে বাবা-মায়ের ওপরে অভিমান করে শিশুদের আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার প্রবণতার বিষয়টি জানা যায় গবেষণায়। সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়েও আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে শিশুরা। একইভাবে পারিবারিক অস্থিরতা থেকেও শিশুদের মাঝে আত্মহননের প্রবণতা বাড়ছে।

বিজ্ঞাপন

গবেষণা ফলাফল কী বলছে?

২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় জানানো হয়, বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ শিশু শরীরচর্চার পেছনে দৈনিক এক ঘণ্টা সময়ও ব্যয় করে না। অর্থাৎ প্রতি তিনজনের মধ্যে দু’জন শিশু শরীরচর্চার পেছনে সময় ব্যয় করে না। শারীরিক অনুশীলনের অভাবে শিশুর স্বাস্থ্য তো বটেই, মস্তিষ্কের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সামাজিক দক্ষতা। একইসঙ্গে অতিরিক্ত মাত্রায় মোবাইল বা অন্যান্য ডিভাইস ব্যবহারের কারণে শিশুরা হারাচ্ছে চিন্তাশক্তি। একইসঙ্গে নিজের মতের সঙ্গে মিল না হওয়ার কারণে খুব দ্রুতই উত্তেজিত আত্মহত্যার মতো ভাবনাও আসছে তাদের মাঝে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বে ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজনেরই নেই পর্যাপ্ত শরীরচর্চার অভ্যাস। শুধুমাত্র পর্যাপ্ত শরীরচর্চার অভাবই নয়, সেইসঙ্গে ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তি কেড়ে নিচ্ছে শিশুর শৈশব। আর এ কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টসের (বিএপি) সূত্র অনুযায়ী, দেশে শিশু-কিশোরদের মাঝে মানসিক রোগের হার ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার ৫ দশমিক ১ শতাংশ, কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার ১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং শিশু-কিশোরদের মধ্যে অতি উদ্বেগ ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।

এর আগে ২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট কর্তৃক পরিচালিত মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী জানানো হয়—শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে মানসিক রোগের হার প্রায় ১৩ শতাংশ। এদের মধ্যে ৯৪ শতাংশ চিকিৎসা নেয় না।

এছাড়াও ২০২০ সালের মার্চে করোনা মহামারী শুরুর পর ইউনিসেফ শিশুদের নিয়ে একটা গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১৮৮টি দেশে লকডাউন বা অন্যান্য কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের কারণে ১০৬ কোটির বেশি শিশু ও তরুণরা শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীদের তিনজনে একজন অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৪৬ কোটি শিশু এখন আর অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না। করোনার কারণে শিশু অপুষ্টির হারও বাড়ছে। পাশাপাশি এই মহামারিতে শিশুদের উপর নির্যাতন সহিংসতায় দুর্ব্যবহার ও বেড়েছে।

কেন আত্মহত্যা বাড়ছে শিশুদের মাঝে?

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিশুদের আত্মহত্যার যে পরিসংখ্যান জানা গেছে খুবই আশঙ্কাজনক। করোনার সময়ে দীর্ঘদিন ঘরে বসে থাকার ফলে অনেকের মতো শিশুদের মাঝেও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন এসেছে। রাগ বেড়েছে, মানসিকভাবে সহজেই ভেঙে পড়ার হারও বেড়েছে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে কমেছে মাঠ, সেখানে খেলাধুলোর অভাবের পাশাপাশি সামাজিকভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সে মোবাইল বা অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসে নিজেকে ব্যস্ত রাখছে।’

তিনি বলেন, ‘একইভাবে করোনা পরবর্তী সময়ে শিশুদের মাঝে বেড়েছে পড়াশোনার চাপও। হঠাৎ করে এতোটা চাপ নেওয়া অনেক শিশুর জন্যেই কিছুটা কষ্টকর হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে তাদের পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যাও। সব মিলিয়ে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা সবকিছু একসঙ্গে সামাল দিতে পারছেনা বলেই তুলনামূলক আত্মহত্যার হার বেড়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘১৮ বছর পর্যন্ত বয়সের শিশুদের মাঝে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবেই প্রথমেই চলে আসে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ব্যাঘাতের বিষয়টি। যে বয়সে শিশুরা গান গাইবে, গান শুনবে বা খেলাধুলো করবে তারা কেনো আত্মহত্যা করছে? এর মূল কারণটা হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হিসেবে এই শিশুরা আধুনিক সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু এর কারণে তাদের মানসিকতা কিছুটা ভঙ্গুর প্রকৃতির হয়ে যাচ্ছে। কিছুটা আবেগী হয়ে তারা নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।’

তানসেন রোজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা একটা সময় মাঠে খেলাধুলোয় ব্যস্ত থাকতাম কিন্তু বর্তমান সময়ে সেটা সব শিশুরা পাচ্ছে না। সামাজিক নানা কর্মকাণ্ডে নিজেদের যুক্ত রাখতে পারার কারণে আমাদের মানসিকতা সেভাবেই গড়ে উঠেছে। আমাদের শিশুরা বর্তমানে সেটা থেকে দূরে। তাদের মাঝে খেলাধুলোর প্রবণতা থেকে শুরু করে শারীরিক পরিশ্রমও অনেকটাই কমছে। ফলে শহরের পাশাপাশি গ্রামেও মোবাইল বা ডিভাইসের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ছে শিশুদের।’

তিনি বলেন, ‘এসব কারণে দেখা যায় শিশুদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। কারণ তারা যখন কোনো কিছু চেয়ে পাচ্ছে না তখনই আবেগী হয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এ সময়টা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না অনেক শিশুরাই। এটাও আরেকটা কারণ।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম করোনার পর আত্মহত্যা প্রবণতা কমে যাবে। কিন্তু আমরা দেখছি শিক্ষার্থীরা পরিবার থেকে কোনো কিছু না পেয়ে অভিমান করেও আত্মহত্যা করেছেন। মোটরবাইক, মোবাইল চেয়ে না পাওয়ার কারণে অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। প্রত্যাশা পূরণ না হলে বা নিজের মনের মাঝে থাকা নানা রকমের চাপ সামাল দিতে পেরেও অনেকে আত্মহননের দিকে ঝুঁকছে।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের মনোরোগ চিকিৎসক ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আত্মহত্যা প্রায় সকল বয়সসীমাতেই বাড়ছে। তবে শিশুদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার জন্য দুইটি বিষয় কাজ করছে। প্রথমত তাদের যে আবেগের বিকাশ সেটি ঠিকমতো না হতে পারা। আঁচল ফাউন্ডেশনের রিপোর্টেও আত্মহত্যার মূল কারণ হিসেবে আবেগীয় সম্পর্কের বিষয়টি উল্লেখ করা আছে। এজন্য শিশুদের আবেগের বিকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শৈশবে, পরিবারে ও স্কুলে এ বিষয়টাতে নজর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি বলেন, ‘আরেকটি বিষয় হচ্ছে গত কয়েক বছরে বিশেষ করে করোনাকালে যত ধরনের মানসিক অভিঘাত আমাদের ওপরে এসেছে তাতে পেশাজীবীদের বাইরে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষার্থীরা। একদিকে তাদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয়েছে, দুইটা বছর তাদের স্কুলিং নষ্ট হয়েছে অন্যদিকে তাদের পরীক্ষা, ক্যারিয়ারসহ নানা বিষয়ে চাপ বেড়েছে। একইসঙ্গে যোগ হয়েছে পারিবারিক চাপ। সব বিষয় তাদের ওপর একটা বাড়তি চাপ ফেলেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘একদিকে শিশুদের অন্তর্গত চাপ যেখানে তাদের আবেগের বিকাশের ব্যাঘাত ঘটেছে অন্যদিকে করোনাকালে সৃষ্টি হওয়া নানা ধরনের চাপ শিশুদের মাঝে বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহননের প্রবণতা বাড়িয়েছে। আত্মহত্যা কখনো একটা কারণে হয় না। এটা অনেকগুলো কারণ যখন একসঙ্গে হয় তখন আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি হয়।’

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ডা. সিফাত ই সাঈদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৮ বছর পর্যন্ত যাদের বয়স তাদের শিশু বলা হয়ে থাকে। এই শিশুদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়লে সেটা সমাজের জন্য অবশ্যই এলার্মিং একটা বিষয়। এটার জন্য অনেকগুলো কারণ কাজ করে। তবে একটা অন্যতম কারণ হচ্ছে এই শিশুদের স্ট্রেস হ্যান্ডেল করতে পারার ক্ষমতা খুবই কম।’

তিনি বলেন, ‘আজ থেকে ১০ বছর আগেও যদি বিবেচনা করা হয় তবে শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে শিশুরা হয়তোবা এতোটা আত্মহত্যার কথা ভাবতো না। কিন্তু এখন কেনো করছে এ বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। বিশেষ করে শিশুদের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা এতো কমে গেল কেন? পড়াশোনার চাপ, বাসার চাপ বা স্কুলের চাপটাও এক্ষেত্রে একটা বিষয় হয়ে থাকতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগে শিশুরা খেলার মাঠে ব্যস্ত রাখতে পারতো নিজেদের। বিভিন্ন শরীরচর্চার মাঝেও থাকতো তারা। কিন্তু সেগুলো কমে এসেছে অনেক। স্ট্রেস রিলিফ করার জন্য এগুলো জরুরি। কিন্তু এখন যাদের স্ট্রেস থাকছে তাদের দেখা যায় একমাত্র সঙ্গী হচ্ছে মোবাইল, ট্যাব বা কম্পিউটার। এগুলো কিন্তু স্ট্রেস কমাচ্ছে না বরং বাড়াচ্ছে নানাভাবে। ইন্টারনেট অ্যাডিকশন নিয়ে তাই আরও গবেষণা প্রয়োজন।’

ডা. সিফাত বলেন, ‘হাসপাতাল ও চেম্বারে আমরা এখন অনেক শিশুকেই পাচ্ছি যারা কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতি ও এর পরবর্তীতেও নানাভাবে মানসিক সমস্যায় ভুগছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীদের যারা তারা অনেক বেশি মাত্রায় ডিভাইস অ্যাডিক্টেড হয়ে গেছে। অনেকেই আবার দেখা গেছে এখন আর অফলাইনে অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ক্লাস করতে চায় না। তারা চায় যে অনলাইনেই যেন ক্লাস হয়। কারণ তারা এটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখান থেকে বাধা দিলেই তারা কথা শুনতে চাইছে না বলে অভিযোগ অভিভাবকদের। এক্ষেত্রে আসলে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে বেশি। তারা যেন তাদের স্ট্রেসটা কাটিয়ে উঠতে পারে সে বিষয়ে সহযোগিতা করতে হবে।’

আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আত্মহত্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে কোন কারণগুলো আছে তা খুঁজে বের করে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবী। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা এখন যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাতে আত্মহত্যা না করলেও তাদের অন্যান্য মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘পেশাজীবীদেরও এ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা উচিত এবং কী উদ্যোগ নেওয়া যায় সে বিষয়ে সমন্বিত কাজ করা প্রয়োজন। এছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সিফাত বলেন, ‘বর্তমানে শিশু-কিশোরদের যে মানসিক অস্থিরতা বা অসুস্থতা তা বলা যেতে পারে করোনার কারণে হওয়া ভার্চুয়াল স্কুলিংয়ের প্রভাব। তখন ওদের স্কুলে বা কোচিংয়ে যেতে হতো না। কোনো ধরনের আউটডোর অ্যাক্টিভিটি বা খেলাধুলোর সঙ্গেও যুক্ত ছিল না তারা। সারাদিন মোবাইলে বা কম্পিউটারে ক্লাস করত। সেখান থেকে যদি তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হয় তবে শিক্ষক ও অভিভাবকদের বাস্তবতা বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, একটু সময় লাগলেও তাদের বোঝাতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘অনেক বাবা-মা অভিযোগ করে বলেন সন্তান খালি মোবাইল টিপে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য কিন্তু বাবা-মায়ের হাত থেকেও মোবাইলটা রাখতে হবে। বাবা-মার ক্ষেত্রেও কিন্তু দেখা যায় তাদের হাতে মোবাইল কিন্তু তারা বাচ্চাকে বলছে, তুমি মোবাইল রেখে পড়তে বসো। সেটা কিন্তু হবে না। কারণ বাচ্চারা কিন্তু বাবা-মাকে অবজার্ভ করে। এক্ষেত্রে বাবা-মাকে মোবাইলটা রাখতে হবে আগে। এর পরে বাচ্চা মোবাইল বা ডিভাইস রেখে সেই সময়ে বিকল্প কি করবে সেটা নিয়েও ভাবতে হবে। অর্থাৎ বাচ্চাকে আরেকটা সোর্স অফ এন্টারটেইনমেন্ট দিতে হবে। এই জায়গাতে শিক্ষক ও অভিভাবকদের বড় দায়িত্ব আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শিশুদের মজার কোনো কার্যক্রমে যুক্ত করা বা পরিবারের সঙ্গে পর্যাপ্ত সময় কাটানোর সুযোগ করে দেওয়াটা খুবই প্রয়োজন মোবাইল আসক্তি কাটানোর জন্য। ঘরে বসেই অনেক ধরনের ইনডোর গেইম খেলা যায়। এগুলো একটু ধীরে কাজ করলেও আস্তে আস্তে সন্তানের ডিভাইস আসক্তি কাটানো সম্ভব। আশা করছি আমরা সবাই মিলে যদি চেষ্টা করি এই সমস্যা সমাধান করতে পারব।’

‘সবচাইতে বড় কথা শিশুদের কঠোরভাবে না বুঝিয়ে ধীরে ধীরে প্রয়োজন হলে একটু সময় বেশি নিয়ে হলেও কনফিডেন্সে আনতে হবে’— অভিভাবকদের উদ্দেশে বলেন ডা. সিফাত।

এম আর খান শিশু হাসপাতালের ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফরহাদ মনজুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যা সমাধানে মূল ভূমিকা রাখতে পারে সাইকোলজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিকরা। স্কুল বেইজড তারা কাউন্সেলিং করতে পারে। কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে চেষ্টা করে খুব একটা বেশি ভালো ফল আসার সম্ভাবনা দেখি না। দেখা গেল আমি আমার বাচ্চাকে কাউন্সেলিং করলাম। কিন্তু সে যখন আবার স্কুলে যাবে তখন সঙ্গীদের সঙ্গে মিশে আবার পুরনো অবস্থায় ফিরে যাবে। এজন্যেই স্কুলে যদি পরিকল্পনা নিয়ে কাউন্সেলিং করা যায় সেটাতে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘খেলার মাঠ না থাকলে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই আসলে অনুমোদন দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ শুধুমাত্র পড়াশোনার ওপরে জোর দিয়ে শিশুদের মানসিকতা সুস্থ রাখার চেষ্টাটাও করা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে শিশুদের খেলা মাঠে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। মাঠে যখন শিশুরা খেলবে তখন তাদের মাঝে স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হওয়ার একটা প্রবণতা সৃষ্টি হবে। এর ফলে তাদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতাটাও অনেকটা কমে আসবে বলে আশা করা যায়।’

দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। নানারকম বিধিনিষেধ আরোপের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ঘোষণা করা হয় ছুটি। সংক্রমণ চলাকালীন দীর্ঘ সময়ের প্রভাব পড়েছে দেশের শিশু-কিশোরদের মাঝে। দীর্ঘ সময় শারীরিক চর্চার ঘাটতি একদিকে যেমন বাড়িয়েছে শিশুদের নানা রকম অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ঠিক একইভাবে বাড়িয়েছে মানসিক অসুস্থতা। কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রভাবে দেশের শিশুদের মানসিক ও শারীরিক ঝুঁকিগুলো নিয়ে সারাবাংলার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব।

আরও পড়ুন:

প্রথম পর্ব: করোনার প্রভাবে শিশুদের মাঝেও দেখা দিচ্ছে ডায়াবেটিস

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন