‘প্রাথমিকে মোবাইল নয়, মাধ্যমিকে সর্বোচ্চ ২জি’
২১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২২:০৫
ঢাকা: স্কুলগামী শিশুদের সাইবার জগতে নিরাপদ রাখতে তাদের হাতে মোবাইল না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পরিকল্পনা প্রতমন্ত্রী ড. শামসুল আলম।
তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতে একদমই নয় আর মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশুদের মোবাইল দিতে হলেও সেটি যেন ২জি মোবাইল দেওয়া হয়। এতে করে তারা অনলাইনে ছবি দেওয়ার সুযোগ পাবে না কিন্তু প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারবে।
বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একনেক সভায় ঢাকায় ন্যাশনাল চিলড্রেনস টাস্কফোর্স (এনসিটিএফ), সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ ও প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এর আয়োজনে ‘চাইল্ড পার্লামেন্টে’র ২১তম অধিবেশনে এসব কথা বলেন তিনি। এতে অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু।
সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী এসময় বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীসহ মেয়ে শিশুদের জন্য উপবৃত্তিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। বর্তমানে আবার বেসরকারি পর্যায়েও প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক স্কুল বানানো হচ্ছে। এসব স্কুল সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়েও সংখ্যা অনেক বেশি। আবেদনের প্রেক্ষিতে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। এছাড়াও এখন একই জায়গায় একাধিক স্কুল গড়ে ওঠে। দরকার না থাকলেও বানানো হচ্ছে। যেখানে প্রয়োজন সেখানে সরকার থেকে স্কুল বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বাল্যবিয়ে নিয়ে তিনি বলেন, ১৮ এর নীচে বিয়ে না দেওয়ার আইন থাকলেও তা অনেক জায়গাতেই মানা হচ্ছে না। এসময় তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হটলাইন নাম্বারে ফোন দিয়ে বাল্যবিয়ে বন্ধের আহ্বান জানান।
আত্মহত্যকে সামাজিক ব্যাধি উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি শিশু অন্তত দশম ও দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পরিবারে সবচেয়ে বেশি সময় কাটায়। তাই একজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার জন্য পরিবারই সবার আগে দায়ী। যেসব পরিবারে বাবা-মায়ের মধ্যে, ভাই-বোনের মধ্যে সম্পর্ক ভালো না থাকলে, বাবা-মায়ের অসত জীবনযাপন ইত্যাদি নানা কারণে সন্তানের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে একান্নবর্তী পরিবারের সন্তানরা তুলনামূলক বেশি নিবিড়ভাবে দেখাশোনার মধ্যে থাকে ফলে তারা তুলনামূলক বেশি মানসিকভাবে শক্তিশালী হয় ফলে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কম।
এসময় পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে শিশুদের দেখাশোনা করার জন্য পর্যাপ্ত দিবা যত্নকেন্দ্র নাই। সরকারি অফিসে এটি বাস্তবায়নের পর্যায়ে থাকলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এখনো বাধ্যতামূলক নয়। সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র থাকা আইন করে বাধ্যতামূলক করা দরকার। এতে করে শিশুরা একজন প্রশিক্ষিত কর্মীর কাছে থাকবে যেখানে সে তুলনামূলক ভালো পরিবেশ পাবে।
এছাড়াও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এসময় পরীক্ষানির্ভর পড়াশোনা ব্যবস্থা বদলানোর আহ্বান জানান। বিশেষ করে প্রাইমারি পর্যায়ে তিনটি পরীক্ষা তাদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য দেশের ৬৫ জেলায় শিশু নিবাস রয়েছে জানিয়ে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, এসব শিশু নিবাসে দশটি করে সিট আছে বয়স্কদের জন্যও রয়েছে। তবে নানারকম সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এসব শিশু নিবাসের ৯০ শতাংশই খালি পড়ে থাকে।
রাজবাড়ি থেকে আসা একাধিক শিশু দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর শিশুদের নানারকম বঞ্চনার কথা তুলে ধরে। তারা পাচার, জাতীয় পরিচয়পত্র না পাওয়া নির্যাতন, ওষুধ খাইয়ে স্বাস্থ্য বাড়ানোর মত সমস্যা তুলে ধরেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে বাবা-মায়ের নাম থাকতেই হবে সেটি বদলাতে হবে। শুধু মায়ের নামেই জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনে আইন বদলাতে হবে।
২১-তম চাইল্ড পার্লামেন্ট অধিবেশনে ৩০টি জেলার ৫২ শিশু অংশ নেন। এতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও বিনোদনের অধিকার নিশ্চিতকরণে শিশুদের অংশগ্রহণ ও মতামতের ভিত্তিতে বাজেট প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা বিষয়ে আলোচনা করে শিশুরা। পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও সুরক্ষা বিষয়ে প্রশ্ন ও সুপারিশ তুলে ধরে।
রাজবাড়ী থেকে আসা অষ্টম শ্রেণির ছাত্র নদী আক্তার। বড় হয়ে ইংরেজির শিক্ষক হতে চাওয়া নদী আজ দুইজন মন্ত্রীর সামনে একজন শিশু সংসদ সদস্য হিসেবে তার এলাকার শিশুদের সমস্যা ও বঞ্চনার বিষয়টি তুলে ধরে। নদী বলেন, আমাদের দৌলতদিয়া এলাকায় বেশকিছু যৌনপল্লী রয়েছে। এখানকার শিশুরা নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। আমি তাদের কথা বলতে এসেছি।
সাতক্ষীরা সদর থেকে এসেছে শামস তুহিন (১৭)। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারে ডিপ্লোমা করছে তুহিন। এই নিয়ে চার বছর ধরে এনটিসিএফের সঙ্গে থাকলেও এবারই প্রথম চাইল্ড পার্লামেন্টে আসা তার। তাদের এলাকায় বাল্যবিয়ের সমস্যা বেশ প্রকট। মেয়ে শিশুদের বোঝা মনে করে বিয়ে দেয় অনেক বাবা-মা। আজ দুইজন মন্ত্রীর সামনে এই সমস্যা তুলে ধরে সে সম্মানিত বোধ করছে ও পরিবর্তন হবে বলে আশা করছে।
তুহিন বলেন, শিশুদের সবাই অবহেলা করে। আজ এখানে কথা বলতে পারায় আমি আনন্দিত। যে অভিজ্ঞতা হল এখানে এসে তা এলাকায় প্রচার করতে পারবো।
অন্যান্যদের মধ্যে অধিবেশনে সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড রাইটস গভর্নেন্স অ্যান্ড চাইল্ড প্রোটেকশনের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুনসহ সেভ দ্য চিলড্রেন এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
আবদুল্লাহ আল মামুন সারাবাংলাকে বলেন, প্রতিটি জেলায় এনটিসিএফ এর কমিটি আছে। সেই কমিটির মাধ্যমে চাইল্ড পার্লামেন্টে যারা অংশ নেবেন সেই সদস্য নির্ধারণ করা হয়। এবং এখানে আসার আগেই তার সারাদেশের শিশুদের মধ্যে একটি জরিপ পরিচালনা করে। সেই জরিপের ফলাফল আজ তারা তুলে ধরেছে। পরে আবার এই জরিপের উপর ফলোআপ করা হয়। এবারের ২১-তম চাইল্ড পার্লামেন্টে প্রান্তিক পর্যায়ের শিশুদের সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। এইজন্য এবার সমাজকল্যান ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীদের আনা হয়েছে। দেখা গেছে উন্নয়ন হলেও এর সমান সমান ভাগ প্রান্তিক শিশুরা পাচ্ছে না। প্রতিবন্ধী, প্রান্তিকসহ সব শিশুর জন্য যেন সমানভাবে ও সুবিধাজনকভাবে সুযোগ পৌঁছে দেওয়া যায় সেই লক্ষ্যেই এই আয়োজন।
প্রতিবছরই ন্যাশনাল চিলড্রেন টাস্কফোর্স (এনসিটিএফ) চাইল্ড পার্লামেন্ট অধিবেশনের মাধ্যমে তাদের মতামত প্রদানের কাজ করে। এবারের অধিবেশনে তিন হাজার শিশুর উপর করা জরিপ ও এক হাজার ৩১৭ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সঙ্গে আলোচনা করে শিশুরা তাদের আলোচ্য বিষয় নির্ধারণ করে।
সারাবাংলা/আরএফ/এনইউ