Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে ২ মন্ত্রণালয়ের ২ মত

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:০৮

ঢাকা: সরবরাহ ঘাটতি নেই, দেশীয় উৎপাদন পরিস্থিতিও অনুকূলে। তারপরেও বাজারে চালের দাম বাড়তি। গত দুই মাসে কেজিতে চার থেকে পাঁচ টাকা করে যে দাম বাড়ানো হয়েছিল, তা আর নামছেই না। দাম বৃদ্ধিতে খুচরা ব্যবসায়ীরা দুষছেন পাইকারী ব্যবসায়ীদের। আর পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মূল্য বৃদ্ধি হয় মিল থেকেই।

এদিকে, দাম বাড়ার পেছনে বাজারে ধানের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাত দেখাচ্ছেন মিল মালিকরা। তবে পরস্পরবিরোধী অভিযোগের অবসান ঘটিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে মিলগুলোতে প্রতিদিনের একটি মূল্য তালিকা প্রদর্শনের কথা ভাবছে কৃষি মন্ত্রণালয়। কিন্তু খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, বাজারে কঠোর মনিটরিং বাড়ানোর বিকল্প নেই।

বিজ্ঞাপন

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ১৮ দশমিক ০২ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য মজুত রয়েছে। এর মধ্যে চাল ১৬ দশমিক ৩৯ লাখ মেট্রিক টন। গম ১ দশমিক ২০ লাখ মেট্রিক টন আর ধান দশমিক ৬৬ মেট্রিক টন। খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এই পরিমাণ মজুত আমন মৌসুম চালিয়ে দিতে যথেষ্ট।

এদিকে, কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) ঢাকার বাজারে মোটা চাল (সিদ্ধ) পাইকারি বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৪৬ টাকা। আর খুচরা ৪৭ থেকে ৫০ টাকা প্রতি কেজি। তবে এদিন রাজধানীর বিভিন্ন বাজার থেকে চালের দামের একেকরকম তথ্য পাওয়া গেছে। কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৪৮ থেকে ৫৩ টাকা। আর মিলগুলোতে কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৫ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে।

খুচরা ব্যবসায়ীরা দাম বৃদ্ধি সম্পর্কে বলেছেন, পাইকারি পর্যায়ে বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয় বলে তাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মিল থেকেই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে তাদের। এ প্রসঙ্গে কুষ্টিয়ার নাহিদ অ্যারোমাটিক অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী আহমেদ আলী সরদার স্বপন সারাবাংলাকে জানান, ধানের বাজারের ওপরে নির্ভর করে চালের বাজার। বর্তমানে বাজারে ধানের দাম বেশি। এই সময় প্রতি মণ ধান কিনতে হচ্ছে ১৬৫০ টাকায়। যেখানে এই সময়ে প্রতিমণ ধানের দাম থাকার কথা ছিল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। সেজন্য চালের দাম বেশি। দুর্যোগপূর্ন আবহাওয়ার কারনে ধান উৎপাদনও এবার কম হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘মিল থেকে ৫০ টাকা কেজি কিনে তা পাইকারি বিক্রেতারা পরিবহন খরচ বাবদ বিক্রি করে ৫৪ টাকা। আর তার থেকে খুচরা ব্যবসায়ী ২ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করে। এভাবে হাত বদলে মিল থেকে কেনা ৫০ টাকা কেজি দরের চাল ভোক্তাদের ঘরে ৬০ টাকা কিংবা তার থেকেও বেশি দামে পৌঁছায়। এখানে মিল মালিকদের দাম বাড়ানোর সুযোগ কম।’

এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার চাল ব্যবসায়ীদের বড় অজুহাত ছিল ইউক্রেন- রাশিয়ার যুদ্ধ। এরপর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি। এসব অজুহাত দেখিয়ে বছরের শুরু থেকেই চালের বাজার অস্থিতিশীল করে তোলা হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। তারপরেও বাজার অস্থিতিশীল রয়ে গেছে। এর মধ্যে বর্ষায় মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হওয়ায় চাষাবাদে প্রভাব পড়ে। অনেক মিলার মনে করছেন, এবার খরার কারণে আমনের ফলন ভাল হবে না। কারণ, খরার কারণ আমন রোপনে দেরি হয়েছে। যদিও গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে।’

কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘আমনের সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল টাইম হলো যখন ধান গাছে ফুল আসে। এবং ফুলের পরে দানা যখন পরিপুষ্ট হয় তখন বৃষ্টির প্রয়োজন। তখন যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে আমনের ফলন কমে যায়। আমনের ফলন ভাল হবে না এমন একটা ধারণা মানুষের মধ্যে রয়েছে। সে কারণেই অনেক মিলার গুদামে খাদ্য মজুত করছে।’

ড. রাজ্জাক বলেন, ‘সম্প্রতি চাল রফতানিতে ভারত ফের ২০ শতাংশ ট্যাক্স বসিয়েছে। সব মিলিয়ে একটা অস্থিরতা চলছে। তবে খাদ্য সংকট তৈরি হওয়ার মতো অবস্থা দেশে তৈরি হয়নি। কিন্তু ব্যবসায়ীদের আচরণ যেন খাদ্য সংকটেই পড়তে যাচ্ছে দেশ।’

এদিকে চাল, ডাল, তেলসহ নয়টি গুরুত্বপূর্ণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করতে যাচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘খাদ্য, স্টিলসহ নয়টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করতে আমরা ট্যারিফ কমিশনকে ১৫ দিন সময় দিয়েছিলাম। হয়তো আরও সাতদিন সময়ের প্রয়োজন হবে।’ তিনি বলেন, ‘এই উদ্যোগের কারণে ব্যবসায়ীদের অনৈতিক সুযোগ নেওয়া কমে যাবে।’

এই উদ্যোগে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে না বলে মনে করছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘নয়টা পণ্যের দাম নির্ধারন করার যে সিদ্ধান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিয়েছে সে কাজটা অনেক কঠিন। তাদের কী ম্যাকানিজম আছে তা আমি জানি না। এ নিয়ে আলোচনা করা দরকার। সমন্বিত সভায় বসে পদ্ধতি বের করা যেতে পারে। তবে এই কাজ খুবই চ্যালেঞ্জের এবং খুব কঠিন।’ সেক্ষেত্রে চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে মিলগুলোতে একটি দৈনিন্দন মূল্য তালিকা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেন কৃষিমন্ত্রী।

তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু সবচেয়ে বড় অভিযোগটা মিল মালিকদের ওপরেই সেজন্য মিলারদের প্রতিদিনের একটি মূল্য তালিকা রাখা বাধ্যতামূলক করা যায় কিনা- এ নিয়ে আলোচনা চলছে।’ তিনি বলেন, ‘মিলাররা বলবে যে, আজ চালের কেজি ৫০ বা ৬০ টাকা। সেখানে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলতে পারবে না যে, মিল থেকে তারা বেশি দামে কিনেছে। আমরা সেই পরিকল্পনা করছি।’

তবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন চালকল মালিকরা। তারা বলছেন, এটা কেবলমাত্র আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রেই সম্ভব। এ প্রসঙ্গে কুষ্টিয়ার নাহিদ অ্যারোমাটিক অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী আহমেদ আলী সরদার স্বপন সারাবাংলাকে জানান, মিলে দাম নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কারণ বাজারে প্রতিদিন দাম ওঠানামা করে। এটা আমদানি করা চাল, ডাল বা অন্য কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে হতে পারে। কিংবা অন্য পণ্য যেমন মাংসের ক্ষেত্রে হতে পারে। দেশে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য প্রতিদিন নির্ধারিত হয়। সেখানে মনে হয় এই সিদ্ধান্ত কাজে আসবে না।’

এদিকে, এ প্রসঙ্গে খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে চালের দাম বাড়তি এটা মিথ্যা নয়। তবে এটা হয়েছে অবৈধ মজুতের কারণে। আমরা লক্ষ্য করেছি, যখন প্রতিবেশি দেশ ভারত চাল রফতানিতে ২০ শতাংশ আর মিয়ানমার ১৫ শতাংশ ট্যাক্স বসিয়ে দিল তখন বাজারে একটা কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা শুরু করে দেশের ব্যবসায়ীরা। তবে আমরা বিষয়টা মনিটর করছি। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদফতরের মনিটরিং টিম নিয়মিত কাজ করছে, যাতে অবৈধভাবে মজুত করতে না পারে।’

তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি বিভাগীয় কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা একটা কর্মকৌশল নির্ধারণ করেছি। সেখানে মাঠপর্যায়ে মনিটর জোরদার করা হবে। বিষয়টি সকল বিভাগীয় কমিশনারদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার ভোক্তা অধিকারও কাজ করছে।’ এসব উদ্যোগের কারণে চালের বাজার শিগগিরই নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করছেন খাদ্য সচিব।

সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম

কৃষি মন্ত্রণালয় খাদ্য মন্ত্রণালয় চালের বাজার সরবরাহ ঘাটতি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর