দেশের অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ প্রধানত ৩টি: বিশ্বব্যাংক
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:০১
ঢাকা: দেশের র্অনীতিতে আর্থিক খাতের সংস্কারসহ প্রধানত তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। অন্য দুটি চ্যালেঞ্জ হলো- শক্তিশালী বাণিজ্য প্রতিযোগিতার অভাব এবং অপরিকল্পিত শহরায়ণ। এসব চ্যালেঞ্জ টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
‘বাংলাদেশ কান্ট্রি ইকোনমিক মেমোরেন্ডাম চেঞ্জিং অব ফেব্রিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন অগ্রগতি সাধন করেছে। এই প্রবৃদ্ধির গতিপথ ধরে রাখতে এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধির হারকে আরও ত্বরান্বিত করতে দেশটির একটি শক্তিশালী সংস্কার এজেন্ডা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে রফতানির ক্ষেত্রে শুল্ক-অশুল্ক বাধা কমিয়ে আনা, তৈরি পোশাক খাতের বাইরে রফতানি পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ, খেলাপি ঋণ কমানো, বেসরকারি ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি, এলডিসি উত্তরণের পর টিকে থাকতে বাণিজ্য সক্ষমতা বাড়ানোসহ বিভিন্ন পরামর্শ উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন, বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এবং বর্তমান সিনিয়র ইকোনমিস্ট ড. নোরা ডিহেল। প্যানেল আলোচক ছিলেন- সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান এবং এসবিকে টেক ভেঞ্চারের প্রতিষ্ঠাতা সোনিয়া বশির কবির। এছাড়াও বক্তব্য দেন- বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর ড্যান ড্যান চ্যান এবং সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয় প্র্যাকটিস ম্যানেজার হুন এস শো। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন লিড কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ইউটেকা ইয়োসিনো।
প্রতিবেদনে রফতানি অস্থিরতার ঝুঁকি কমাতে প্রবৃদ্ধির নতুন উৎস তৈরি করতে এবং দীর্ঘমেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়াতে রফতানি বহুমুখীকরণের কথা বলা হয়েছে। তৈরি পোশাকের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা এবং বাংলাদেশের দেশীয় শিল্প প্রতিরক্ষামূলক শুল্ক ব্যবস্থা ও বৈচিত্রময়তা না থাকায় রফতানি বৃদ্ধিকে বাধা দেয়। এছাড়া কম মজুরির ওপর ভিত্তি করে বাণিজ্য প্রতিযোগিতার সঙ্গে বাংলাদেশ তার রফতানি ঝুড়িকে বৈচিত্রময় করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে পারে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, বাংলাদেশে গড় শুল্ক তুলনাকারী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। মধ্যবর্তী পণ্যের গড় শুল্ক হার ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ, যা চীন, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। সামগ্রিক বাণিজ্য ব্যয় এবং অদক্ষ সীমান্ত প্রক্রিয়া বাণিজ্যে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। গভীর এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারতের সাথে শুল্ক আধুনিকীকরণ, বর্ধিত বাণিজ্য সহজীকরণ, পরিষেবা ও বিনিয়োগ সংস্কারের মধ্যে ব্যাপক বাণিজ্য চুক্তি বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধি করতে পারে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য বেসরকারি খাতে অর্থায়ন বৃদ্ধি করা অপরিহার্য।
সম্পদের গুণমান উন্নত করা, ব্যাংকের মূলধন বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ মোকাবেলা করা হচ্ছে আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে বেসরকারি ঋণ বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার জন্য জরুরিভাবে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। থাইল্যান্ড, চীন এবং ভিয়েতনামের বিপরীতে, বাংলাদেশের একটি অপ্রয়োাজনীয় অভ্যন্তরীণ পুঁজিবাজার রয়েছে, যা দীর্ঘমেয়দী অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগে কাজে লাগানো প্রয়োজন। পুঁজিবাজারে অর্থ অবকাঠামোর পাশাপাশি জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্পের জন্য ব্যবহার করা যায়। সবুজ বিনিযয়োগ এবং জলবায়ু ঝুঁকিতে অর্থায়নের জন্য বেসরকারি খাতের অর্থায়ন যোগ করা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। প্রাপ্ত বয়স্কদের ব্যাংকের সঙ্গে যুক্তকরা, ক্রেডিট অবকাঠামো শক্তিশালী করা এবং আর্থিক পরিষেবার আরও ডিজিটালাইজেশন করে সবচেয়ে অনুন্নত জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো গুরুত্বপূর্ণ। বৃহত্তর ঢাকা দেশের জিডিপির এক-পঞ্চমাংশ এবং আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের প্রায় অর্ধেক উৎপন্ন করে।
অনুষ্ঠানে এম এ মান্নান বলেন, ‘টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে যেসব চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে সেগুলো আমরা সমাধানে উদ্যোগ নিচ্ছি। তবে সবগুলো একসঙ্গে হবে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা। আমি বলব, হ্যাঁ আকাশের দিকে তাকালে দেখা যায়, কালো মেঘ আছে। কিন্তু সেটি ঝড় হবে না। কেননা ঝড় হলে কারও জন্যই ভালো হবে না। যেমন লাটিসোটা দিয়ে মূল্যস্ফীতি বা দ্রব্যমূল্য কমানো যাবে না। এজন্য আলাপ-আলোচনা দরকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘অর্থনৈতিক খাতে সংস্কার দরকার। এই খাতে অনেক ব্যর্থতা আছে। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি । এটা সুখকর কিছু নয়। সরকার চেষ্টা করছে সংস্কার আনতে।’ আর্ন্তজাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সোয়াপ লাভজনজ হবে না বলেও তিনি জানান।
ড্যান ড্যান চ্যান বলেন, ‘প্রতিবেদনে তিনটিতে শক্তিশালী নীতি সংস্কারের আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হচ্ছে বাণিজ্য প্রতিযোগিতার ক্ষয়রোধ করা, আর্থিক খাতে দুর্বলতা মোকাবিলা করা এবং সুশৃঙ্খল নগরায়ন প্রক্রিয়া নিশ্চিত। রিপোর্টটি এই সংস্কার এলাকায় ক্রস-কাটিং থিম হিসাবে ডিজিটাল উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোও খুঁজছে।’
তিনি বলেন, ‘গত এক দশকে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০টি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে রয়েছে। তবে আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশ নেই। নতুন এবং উদীয়মান চ্যালেঞ্জগুলোসহ প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং জলবায়ু পরিবর্তন-একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির পরিবর্তনশীল মনোযোগের জন্য নতুন নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ভাবনের প্রয়োজন।’ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের রূপকল্প অর্জনের জন্য বাংলাদেশের শক্তিশালী এবং রূপান্তরমূলক নীতি পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মত দেন চ্যান।
অনুষ্ঠানে নোরা দিহেল বলেন, ‘উন্নত নগরায়ন এবং সংযোগ জলবায়ু অভিবাসীদের শুষে নিতে এবং দ্রুত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। সফল নগরায়নের অর্থ হবে ছোট এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে আকৃষ্ট করা। মাঝারি আকারের শহরের জন্য পরবর্তী স্তরের শহরগুলোকে আনুষ্ঠানিক সংস্থা এবং দক্ষ কর্মীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনসহ অবকাঠামো বিনিয়োগ এবং পরিষেবার বিধানের জন্য শহরগুলোকে তাদের নিজস্ব রাজস্ব বাড়াতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করবে। এজন্য দ্রুত ব্রডব্যান্ড গতি, মৌলিক পরিষেবাগুলোতে আরও ভালো সুবিধা এবং সহজ আন্তঃনগর পরিবহন সংযোগ চালু করতে হবে।’
সারাবাংলা/জেজে/পিটিএম