Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শ্যামপুর মাদরাসা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলছেই

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৫ অক্টোবর ২০২২ ১৯:১৬

ঢাকা: মাদরাসার সুপার দীর্ঘ ১২ বছর ধরে নিজভূমে না রেখে পরবাসে রাখায় এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে শ্যামপুর দারুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা ধলাই হাওর থেকে ভেঙে শ্যামপুর গ্রামে নিয়ে গেছেন। কিন্তু সুপার সেখানে না গিয়ে শ্রেণি পাঠদানসহ শিক্ষার সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আবারও নতুন ঠিকানা হিসেবে ধলাই-বগাদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত টিনশেড ঘর জুটিয়ে নিয়েছেন। এতে এলাকাবাসী ও সুপারের মধ্যে মাদরাসার জায়গা নিয়ে বিরোধ চরমে পৌঁছেছে।

বিজ্ঞাপন

মাদরাসার নির্ধারিত জায়গা নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং শ্রেণি পাঠদানসহ শিক্ষার সার্বিক কার্যক্রম ব্যাহত শুধু নয়, বন্ধ করে শতশত শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ও অভিভাবকদের স্বপ্ন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে যাচ্ছেন সুপার মো. আমিনুল হক।

সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দাখিল করে দীর্ঘ ১২ বছর হলো শ্যামপুর মাদরাসাটি শ্যামপুর গ্রাম থেকে সরিয়ে নিজ এলাকায় নিয়ে গিয়ে কুক্ষিগত করে রেখে এমন নৈরাজ্যের পরিবেশ তৈরি করেছেন সুপার।

তিনি মাদরাসার শ্রেণি পাঠদান ও সহ-শিক্ষা কার্যক্রম এবং এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে ২০০৫ সালের ২৬ জানুয়ারিতে রেজিস্ট্রিকৃত নিজস্ব উপযোগী পর্যাপ্ত জায়গা ফেলে সুপার শিক্ষার্থীদের পাঠদান মাসের পর মাস বন্ধ রেখে এ পর্যন্ত জায়গা বদল করেছেন সাতবার।

সর্বশেষ গত ৬ সেপ্টেম্বর ফের ধলাই হাওরে সুপারের নিজস্ব ২০ শতক ফসলি জমিতে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণের ১১ বান্ডিল টিন দিয়ে ছোট তিনটি ঘর উঠালে শ্যামপুরবাসী তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং গত ৯ সেপ্টেম্বর মাদ্রাসাটি ভেঙে শ্যামপুর গ্রামে নিয়ে প্রতিস্থাপন করেন।

এ নিয়ে সুপার মো. আমিনুল হক বাদী হয়ে ৮২ জনকে আসামিসহ অজ্ঞাতনামা এলাকার আরও শতাধিক লোকের বিরুদ্ধে মিঠামইন থানায় মামলা করে হয়রানি করা হচ্ছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।

এ ব্যাপারে ‘আমরার মাদ্রাসা আমরা পুনরুদ্ধার করেছি’ মন্তব্য করে তারা বলেন, ‘সুপার দীর্ঘ ১২ বছর ধরে মাদ্রসার প্রকৃত জায়গাটিকে অনুপযোগী দেখিয়ে আর ক্ষমতাবানদের নাম বেঁচে মাদ্রাসাটি নিজের কব্জায় রেখে হীনস্বার্থ হাসিল করে আসছেন।’

‘এতদিন তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল’ বলে অনুযোগ করে তারা বলেন, ‘সুপার যে সব কারণ দেখিয়ে অস্থায়ী পাঠদানে প্রশাসনের অনুমতি ও আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে চলেছেন, আসলে সে সব কারণ আদৌ বহাল নেই।’

বিজ্ঞাপন

তবুও সুপার শ্যামপুর গ্রামে না গিয়ে ফের বিকল্প জায়গা হিসেবে শ্রেণি পাঠদান ও সহ-শিক্ষা কার্যক্রমের নামে ধলাই-বগাদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি পরিত্যক্ত টিনশেড ঘরে গিয়ে উঠেছেন। সেখানে ৫টি বেঞ্চ, একটি চেয়ার, একটি ভাঙা টেবিল দিয়ে চলছে ২৭৪ জন শিক্ষার্থীর এবং ১৪ জন শিক্ষক ও ৩ জন কর্মচারীর পুরো মাদরাসা। আর অফিস চলছে একই ঘরে তাসখেলার আসরে।

এমনই আজব মাদ্রাসাটির বর্তমান অবস্থান কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘি ইউনিয়নের ধলাই-বগাদিয়া বাজারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের কাছে বারবার ধরনা দিয়েও প্রতিকার না পেয়ে অবশেষে কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের এমপি প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকের দ্বারস্থ হন এলাকাবাসী। এতে তাদের ২০২০ সালের জুলাই মাসে এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতিপুত্র এমপি তৌফিক ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রভাংশু সোম মহানসহ ভূমি ও শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তা ও পুলিশ প্রশাসন নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শন যান। তিনি বিপুলসংখ্যক এলাকাবাসীর উপস্থিতিতে মাদরাসাটির পাঠদানে একাডেমিক স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তির স্থায়ী জায়গা চিহ্নিত করে শ্যামপুরে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়ে শ্রেণি পাঠদানে উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে দেন। কিন্তু সুপার সেখানে না গিয়ে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে মাদরাসা নিয়ে এখানে-ওখানে ফেরি করে বেড়াচ্ছেন। যে মাদরাসাটির মৌজা- মুশুরিয়া, খতিয়ান- ৬০, সাবেক দাগ- ৩৯৯ অর্থাৎ আরএস দাগ নং- ৮৭২ ও ৮৭৫।

পঞ্চমবারের মতো মাদরাসাটি নতুন বগাদিয়া গ্রামের হারিছ মিয়ার বসতভিটায় অবস্থানের সময় গত ১২ জুলাই ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হলে চার মাস শ্রেণি পাঠদান বন্ধ রাখেন সুপার। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি ও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হতে থাকলে তড়িঘড়ি করে গত ৬ সেপ্টেম্বর ধলাই হাওরে গিয়ে ঘর উঠায়।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, সুপার নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অধিক লাভবান হতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ফলে মাদরাসার আয় তসরুপ করে চলা, সার্টিফিকেট বাণিজ্য করা, গরুর পাইকারি করা ও জমি বেচা-কেনার দালালিসহ মৌসুমি ব্যবসা অবাধ রাখতে নিয়মিত শ্রেণি পাঠদানে ফাঁকি দিতে সুপার শ্যামপুর মাদরাসা ইচ্ছেমতো যখন যেখানে সুবিধা, সেখানেই মাদ্রাসার ঘর তুলে মনগড়া মতো চালাচ্ছেন।

তাছাড়া মাদরাসা পরিচালনায় নিয়মকানুনের কোনো বালাই না থাকলেও স্থানীয় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে কাগজপত্রে সবকিছু ঠিকঠাক দেখিয়ে যাচ্ছেন। ম্যানেজিং কমিটি গঠনসহ মাদরাসা খোলা থাকা না-থাকা, পাঠদান করা না-করা, কাউকে ছাড় বা ছুটি কিংবা টাইমস্কেল দেওয়া না-দেওয়া যাবতীয় কাজ চলে সুপারের মর্জিতে।

বিগত ১২ বছর ধরে শ্রেণি পাঠদান ও সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে নাম না থাকলেও কাগজপত্রে শিক্ষার্থীর হাজিরা শতকরা ৫০ ভাগ। আর শিক্ষক উপস্থিতির ১৪ জনের মধ্যে ছয়-সাত জনকে বলিরপাঁঠা বানিয়ে রাখলেও বাকিরা চলছেন নয়-ছয় করে সুপারের আশীর্বাদে।

এলাকাবাসী হতবাক হয়ে বলেন, শিক্ষার্থী-অভিভাবক, সমাজ ও দেশের চরম ক্ষতি করে কাগজে-কলমে মাদরাসাটি নামেমাত্র চালানো হলেও শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য সুপার মো. আমিনুল হককে ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম গোল্ডেন অ্যাওয়ার্ড- ২০২১’ এবং ‘বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী গোল্ডেন অ্যাওয়ার্ড- ২০২২’ দেওয়া হয়েছে।

মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা পায় শ্যামপুর গ্রামে। ওই গ্রামেরই ক্ষুদ্র কৃষক মো. জজ মিয়ার দান করা এক একর ভূমির বদৌলতে। ফলে মাদ্রাসার নামকরণ হয় গ্রামের নামানুসারেই। জায়গাাটি নিচু হওয়ায় শ্যামপুর বড়হাটি মসজিদের পেছনে ছোট টিনের দোচালা ঘর তুলে প্রথম পাঠদান শুরু হয়।

তাছাড়া কাগজপত্রে প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৯৯ সালে দেখানো হলেও শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় ২০০৫ সালে জমির দলিল রেজিস্ট্রির পর। যা ওই বছরই মাদরাসাটি পাঠদানের একাডেমিক স্বীকৃতি পায়। আর এমপিওভুক্ত হয় ২০১০ সালে।

এরপরই সুপারের মর্জি ঘুরে যায়। জমিদাতা ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. জজ মিয়াসহ অন্যান্য সদস্যদের ডিঙিয়ে সুপার নিজের খেয়ালখুশি মতো মাদ্রাসায় আসা-যাওয়া ও পাঠদান না করাসহ আয়-ব্যয়ে কোনোকিছুর হিসেব না দিয়ে চালাতে থাকেন। এতে ম্যানেজিং কমিটি আপত্তি জানালে সুপারের স্বার্থে লাগে। ফলে মাদরাসার নথিপত্র সব সরিয়ে নিজের বাড়ি ধলাই গ্রামে নিয়ে যান তিনি।

পরবর্তীতে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে রাতারাতি আসবাবপত্র ও ঘর সরিয়ে ধলাই-বগাদিয়া বাজারে গিয়ে নূরুল হক ভূঞার ভিটাতে ভাড়া করা জায়গা নেন। এ আশ্রয়ে থাকেন ৯ বছর।

জমিদাতা ও সাবেক সভাপতি বর্তমানে প্রয়াত মো. জজ মিয়ার পুত্র শাহীন খান (২৪) বলেন, সুপারসহ অন্যরা ক্ষমতা বলে পরের ধনে পোদ্দারি করছেন। শিক্ষা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অবসান চেয়ে শ্যামপুরে শ্রেণি পাঠদানসহ শিক্ষার সার্বিক কার্যক্রম ত্বরিত চালু করার জন্য শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

সুপার আমিনুল হক নিজের অবস্থানকে সঠিক দাবি করে বলেন, ‘সুষ্ঠু পরিবেশে ছাত্রছাত্রীদের শতকরা অর্ধেক উপস্থিতিতে নিয়মিত শ্রেণি পাঠদান চলছে।’

হাইস্কুলের পরিত্যক্ত ঘর ব্যবহারে কর্তৃপক্ষের অনুমতি রয়েছে বলে জানান তিনি।

উপস্থিতির ক্ষেত্রে শতকরা অর্ধেক হিসেবে ১৩৭ জন শিক্ষার্থী পাঁচটি বেঞ্চে দশটি শ্রেণির পাঠদান একসঙ্গে চালানো সম্ভব কি না এবং পাঠদানে অস্থায়ী অনুমতির কারণসমূহ হালে বিদ্যমান না থাকলেও শ্যামপুর মাদরাসার স্থায়ী চত্বর শ্যামপুর গ্রামে না যাওয়ার কারণ কি- জানতে চাইলে সুপার এর জবাব এড়িয়ে ক্ষমতাবানদের নাম ভাঙেন। তার শত্রুর সংখ্যা বেশি এবং এলাকাবাসী তাঁর পেছনে লেগে মাদ্রাসা সঠিক নিয়মে চালাতে বাধা দিচ্ছেন বলেও খেদোক্তি প্রকাশ করেন।

এদিকে এলাকাবাসী গত ২৯ আগস্ট জেলা প্রশাসকের বরাবরে ‘শ্যামপুর দারুল উলুম দাখিল মাদ্রাটি শ্যামপুরে ফেরত, অবকাঠামো নির্মাণ, জালিয়াতি করে উত্তোলিত সরকারি অর্থ ফেরত প্রদান এবং সুপারের অনৈতিক কাজের বিচার প্রসঙ্গে’ শীর্ষক আবেদন করেছেন।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, ‘এলাকাবাসীর লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

সারাবাংলা/একে

মাদরাসা শ্যামপুর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর