বিসর্জনের সুরে বিষাদের ছোঁয়া
৫ অক্টোবর ২০২২ ২১:০৭
ঢাকা: বুধবার (৫ অক্টোবর) বিজয়া দশমীতে ভাসানের মাধ্যমে শেষ হল পাঁচদিনের শারদীয় দুর্গোৎসব-২০২২। বিসর্জনের সুরে তাই বিষাদের ছোঁয়া। কৈলাশ পর্বত থেকে সন্তান-সন্ততি নিয়ে দেবী দুর্গার মর্ত্যে ফেরার অপেক্ষা আরও এক বছরের। তার আগে শেষবারের মত মা-কে দেখতে, পূজা ও অঞ্জলি দিতে মণ্ডপে মণ্ডপে ভিড় জমান হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিবাসীরা। চলে ফুল-বেলপাতায় অঞ্জলি, ঢাকের তালে নাচ, সিঁদুরখেলা ও একে অন্যকে বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা জানানো।
পাঁচদিনব্যাপী আয়োজনের শেষদিন বিজয়া দশমীর আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ বছরের শারদীয় দুর্গোৎসব। সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে দশমীর পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ফুল ও আরতি দিয়ে পূজা দেওয়া হয় দেবী দুর্গাকে। মন্দিরে দশমীর পূজা পরিচালনা করেন তিনজন পুরোহিত। এর মধ্যে প্রধান পুরোহিত হিসেবে ছিলেন প্রণাদ চক্রবর্তী। আর তার সঙ্গে ছিলেন প্রণব চক্রবর্তী ও বরুণ চক্রবর্তী। এ সময় মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করা হয়।
পরে পূজার পর ফুল ও বেলপাতা দিয়ে অঞ্জলি দেন আগত ভক্ত ও দর্শনার্থীরা। এ কার্যক্রম পরিচালনা করেন পুরোহিত, পূজা উদযাপন কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব প্রণব চক্রবর্তী। অঞ্জলির পর তর্পণ দেওয়া হয়। পরে সকাল সোয়া ১১টা নাগাদ ঘট ও দর্পন বিসর্জনের পর সিঁদুর খেলা শুরু হয়।
এ বিষয়ে পুরোহিত প্রণব চক্রবর্তী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আজ বিজয়া দশমীর মাধ্যমে পাঁচ দিনব্যাপী পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হচ্ছে। সকালে দশমী পূজা শেষে দর্পণ বিসর্জন দেওয়া হয়। এ দর্পণ আঘাত প্রতিরোধক। সমাজে যত অশুভ, অশিষ্ট আর বৈষম্য আছে তার বিরুদ্ধে দেবীর সম্মিলিত শুভশক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে এই দর্পণ বিসর্জন দেওয়া হয়। দর্পণ বিসর্জনের মাধ্যমে দেবী শুভ সময়, সমাজ ও সংসার সৌভাগ্য ও ঐশ্বর্যময় হয়ে ওঠার জন্য আশ্বস্ত করেন। আজ দেবী বিসর্জনের পর শিবের সঙ্গে অবস্থানের জন্য কৈলাশ ফিরে যাবেন।’
বিজয়া দশমীর সকালে ঢাকেশ্বরী প্রাঙ্গণের মণ্ডপ ছাড়াও অনেককে আদি মন্দিরেও পূজা দিতে দেখা যায়। এখানে ফুল ও প্রসাদ দিয়ে পূজা দেওয়ার পর মোমবাতি ও ধূপ জ্বালিয়ে অর্ঘ্য প্রদানের মাধ্যমে অঞ্জলি দেন অনেকে।
বিকেল ৫টায় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন কেন্দ্রীয় কমিটির দফতর সম্পাদক সুবল ঘোষ।
ঢাকেশ্বরীর দেবী বিসর্জন হবে বরাবরের মতোই পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে। বিসর্জনের পরে হয় অপরাজিতা পূজা।
সকালে মিরপুর থেকে ছোটভাই অর্জুনকে নিয়ে পলাশীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আসেন এইচএসসি পরীক্ষার্থী সংজ্ঞা রাহা। অন্যান্যবার গ্রামে গেলেও এবার ঢাকায় পূজা উদযাপন করছেন। দুর্গোৎসবের শেষদিন আজ ঢাকেশ্বরীতে এসেছেন তারা।
কেমন লাগল জানতে চাইলে অর্জুন বলে, ‘সবগুলো মণ্ডপের চেয়ে এই মন্দিরের ঠাকুর সবচেয়ে সুন্দর। তাছাড়া এখানে পূজার মঞ্চ উঁচু হওয়ায় ঠাকুরকে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে।’
স্বামীবাগ থেকে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সিঁদুর খেলতে আসেন শিখা ভট্টাচার্য। প্রতিবছরই বন্ধুদের সঙ্গে আসেন। সারাবাংলাকে তিনি জানান, স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনায় তারা হিন্দু বিবাহিত নারীরা সিঁদুর পরেন। সারাবছর বিজয়া দশমীর জন্য অপেক্ষায় থাকেন। এদিন দেবীর পায়ে সিঁদুর দিয়ে নিজেদের সিঁথিতে বা গালে সিঁদুর ছোঁয়ান তারা। বিবাহিত নারীরা সিঁথিতে সিঁদুর দিলেও অবিবাহিত মেয়েরা গালে দেন। এভাবেই বিজয়া দশমীর আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন প্রতিবছর।
দুপুর দেড়টায় সিঁদুরখেলা শেষে পলাশী থেকে একটি শোভাযাত্রা যায় ভাসানের উদ্দেশে। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রতিমাটি স্থায়ী হওয়ায় এটি ভাসান দেওয়া হবে না। আগেই ঢাকেশ্বরী প্রাঙ্গণের পুকুরে ঘট এবং দর্পণ বিসর্জন দেওয়া হয়। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অস্থায়ী প্রতিমা বিসর্জনের জন্য শোভাযাত্রা সহযোগে নিয়ে আসা হয় বুড়িগঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে।
২৫ সেপ্টেম্বর মহালয়ার মাধ্যমে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। পহেলা অক্টোবর ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া পাঁচদিনব্যাপী সার্বজনীন দুর্গাপূজার শেষদিন নানা আয়োজনে চলে দেবী বিদায়ের পালা। দীর্ঘদিন পর হাসি-আনন্দ আর পূজা-অর্চনায় উচ্ছ্বাস ফিরে আসে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় এই উৎসবে।
মণ্ডপে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা মেতে ওঠে ঢাকের তালে, ধুনুচি নাচে। এর পাশাপাশি ছিল নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শিশু থেকে বৃদ্ধ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ মেতে ওঠে উৎসবে। মণ্ডপ থেকে মণ্ডপে ঘোরাঘুরি, মেলায় কেনাকাটা ও একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পালন করেন শারদীয় দুর্গোৎসব।
পঞ্জিকামতে এই বছর দেবী দুর্গার আগমন গজে। তার ফলে শস্যপূর্ণ বসুন্ধরা। আর গমন নৌকায়। যার অর্থ শস্যবৃদ্ধি এবং জলবৃদ্ধি। এই নিদানে যারা বিশ্বাস রাখেন তাঁদের কাছে এই বছরটা সত্যিই ভালো যাবে। কারণ, গমন এবং আগমন দুইয়েই দেবী শস্যপূর্ণ বসুন্ধরার আশীর্বাদ দিয়ে যাবেন বলেই জানাচ্ছেন শাস্ত্রকাররা।
করোনা মহামারির কারণে সীমিত আয়োজনে পালন হওয়ার তিনবছর পর বিধিনিষেধহীন দুর্গোৎসব ফিরে আসে দেশে।
গত বছর কুমিল্লা শহরে নানুয়া দীঘির পাড়ে একটি পূজামণ্ডপে কুরআন অবমাননার কথিত অভিযোগে গত ১৩ অক্টোবর ওই শহরে আটটি মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছিল। ওই ঘটনার জের ধরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় আটজন নিহত হন। এর মধ্যে এ বছর হাওরাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত সিলেট, সুনামগঞ্জসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলার জনজীবন। তার উপর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতিতে জাতীয় জীবন জেরবার। এসবের মধ্যেই নানা শঙ্কা নিয়ে আসে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা।
দেশজুড়ে পাঁচদিনব্যাপী দুর্গোৎসব উদযাপন নির্বিঘ্ন করতে সতর্ক অবস্থানে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আলাদা ব্যবস্থা নেয় বিভিন্ন মন্দির ও পূজা উদযাপন কমিটিও। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা আনসার-পুলিশের পাশাপাশি যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মণ্ডপ পাহারায় ছিল পূজা উদযাপন কমিটির নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবকরাও।
চলতি বছর ২৫ সেপ্টেম্বর মহালয়ার দিন পঞ্চগড়ের আউলিয়ার ঘাটে নৌকাডুবির ঘটনায় ৫৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তীর্থযাত্রীদের এই নৌকডুবি ও হতাহতের ঘটনা ছাড়া নির্বিঘ্নে উৎসবমুখর পরিবেশে পালন হয় শারদীয় দুর্গোৎসব।
সারাবাংলা/আরএফ/একে