প্রাণ ফিরেছে ডেমুর, কাল থেকে ফের ছুটবে যাত্রী নিয়ে
৮ অক্টোবর ২০২২ ২১:৫৭
ঢাকা: বছরের পর বছর ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা ডেমু ট্রেন দেশীয় প্রযুক্তি দিয়ে সচল করে ফের পরিবহনের উপযোগী করা হয়েছে। দেশের একদল প্রকৌশলী দীর্ঘদিন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে ডেমু ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে তুলেছেন। যা আগামীকাল রোববার (৯ অক্টোবর) থেকেই বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহন শুরু করবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিকল হয়ে পড়ে থাকা বাকি ডেমুগুলোকেও একই প্রক্রিয়ায় দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে সচল করে তোলার উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আপাতত এক সেট ডেমু ট্রেন মেরামত করে নতুন রূপে সচল করা হয়েছে। যা বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে পার্বতীপুর-রংপুর রুটে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহন করবে। আগামীকাল রোববার এর উদ্বোধন করবেন রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। দিনাজপুরের পার্বতীপুর রেলওয়ে স্টেশনে সকাল ১১টায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে এই ডেমু ট্রেনের উদ্বোধন করবেন তিনি।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেরামতে করে সচল করা এক সেট ডেমু ট্রেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে যোগ হচ্ছে। এটি প্রাথমিকভাবে পাবর্তীপুর-রংপুর রুটে চলাচল করবে। দীর্ঘ সময় ধরেই এটার ট্রায়াল চলছিল। এখন ফুল লোডে ট্রায়াল হবে অর্থাৎ যাত্রী নিয়ে ডেমু ট্রেনটি চলাচল করবে। ১৫ দিন এভাবে দেখব, তাতে সফল হলে এটি আরও একাধিক রুটে হয়ত চলাচল করবে।’
ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট সংক্ষেপে ‘ডেমু’। এটি এক ধরনের ট্রেনের নাম। এই ট্রেনের দুই দিক দিয়ে দুইটি ইঞ্জিন, মাঝখানে বগি থাকে। একেকবার ১৪৯ জন যাত্রী আসনে বসে এবং ১৫০ যাত্রী দাঁড়িয়ে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারেন। ডেমু ট্রেন মূলত কম দূরত্বে যাত্রী পরিবহনের জন্য। যাত্রীদের সেবা আরও উন্নত, সহজ এবং দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে ২০১৩ সালে লাল-সবুজের মাঝে সাদা রঙের ২০ সেট ডেমু ট্রেন যুক্ত করা হয়েছিল বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের কম দূরত্বে চলাচলের জন্য মূলত এই ডেমু ট্রেন কেনা হয়। চীনের থাংশান রেলওয়ে ভেহিকেল কোম্পানি লিমিটেড থেকে এই ডেমু আমদানিতে খরচ হয়েছিল ৬০০ কোটি টাকা। আর ট্রেনগুলোর আয়ুকাল ধরা হয়েছিল ২০ বছর। সে হিসেবে ২০১৩ সালে তৈরি করা ট্রেনগুলো ২০৩৩ সাল পর্যন্ত চলার কথা। কিন্তু এই ৯ বছরেই অর্ধেকের বেশি ডেমু ট্রেন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, ডেমুর নিম্মমানের কোচ, মেরামত কারখানা না থাকা, দূরত্ব সীমার চেয়ে বেশি চালানো, দেশের বাজারে ডেমুর যন্ত্রপাতির অপর্যাপ্ততাসহ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় আয়ুকালের আগেই নষ্ট হতে শুরু করে ট্রেনগুলো। অর্থাৎ আমদানির চার, পাঁচ বছরের মাথায়ই নষ্ট হতে হতে অধিকাংশ ডেমুর স্থান হয় ঢাকা ও চট্টগ্রামের ওয়ার্কশপে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ডেমু ট্রেন মেরামতের জন্য ওয়ার্কশপ না থাকা, এতে ব্যবহার করা মডিউলের সফটওয়্যার সেটআপ দেওয়া সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা না থাকাসহ নানা কারণে ডেমু ট্রেনগুলো অকেজো হতে শুরু করে। পরে এগুলো মেরামত করতে গিয়ে দেখা যায় রেলওয়ে চীনা প্রযুক্তিতে তৈরি ডেমু ট্রেনগুলো মেরামত করতে যে পরিমাণ টাকার দরকার তা নতুন ক্রয় মূল্যের প্রায় সমান। তাই এগুলো মেরামত করতে গিয়েও বার বার পিছপা হয় রেলওয়ে।
তবে এই পিছপা থেকে বিষয়টি সামনে এগিয়ে নিয়ে গেলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী। তিনি ডেমু ট্রেনগুলোকে সচল করতে দেশীয় প্রকৌশলীদের শরণাপন্ন হন। এ কাজে এগিয়ে আসেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও আণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান। ট্রেনের খোলস ঠিক রেখে দেশীয় প্রযুক্তিতে ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম পরিবর্তন করে ফের সচল করা হয় বিকল হয়ে পরে থাকা ডেমু ট্রেন। দীর্ঘ সময় নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে একসেট ডেমু যাত্রী পরিবহনের জন্য পুরোপুরি সক্ষম হয়ে ওঠে। আর এতে নতুন সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
গত ছয় মাস ধরে সদ্য সচল হওয়া ডেমু সেটটির ট্রায়াল শেষে আগামীকাল রোববার ফের যাত্রী নিয়ে ছুটতে যাচ্ছে। সেজন্য এরই মধ্যে শিডিউলও করা হয়েছে। সে অনুযায়ী, বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটে পাবর্তীপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে গিয়ে রংপুর পৌঁছাবে ৬টা ১৫ মিনিটে। আবার সেখান থেকে রংপুর থেকে ৬টা ৩০ মিনিটে ছেড়ে পাবর্তীপুর এসে পৌঁছাবে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। প্রাথমিকভাবে এই ৩৭ কিলোমিটারে চারটি স্টেশন পেরিয়ে দুইটি করে প্রতিদিন ট্রিপ দিয়ে চলবে ডেমু ট্রেনটি। আর যাত্রী সংখ্যা হবে আনুমানিক ৫০০ জন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘অকেজো হয়ে পড়ে থাকা বাকি ডেমু ট্রেনগুলো একই প্রক্রিয়া সচল করার অ্যাসেসমেন্ট চলছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব রেলপথ মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করা হবে। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেলে আমরা পর্যায়ক্রমে স্বল্প মেয়াদি, মধ্য মেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি কর্ম পরিকল্পনার মাধ্যমে আগামী বছরের মধ্যে সবগুলো অকেজো ডেমু সচল করে চালু করা সম্ভব হবে।’
তিনি আরও বলেন, এখন যে একসেট ডেমু পার্বতীপুর-রংপুর রুটে চালু হচ্ছে এটি ধীরে ধীরে আরও একাধিক রুটে পরিচালনা করা হবে।’
উল্লেখ্য, অল্প দিনেই মানুষের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ডেমু ট্রেন। ট্রেনগুলো ঢাকা-টঙ্গী, ঢাকা-জয়দেবপুর, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ, সিলেট-আখাউড়া, চট্টগ্রাম-কুমিল্লা, নোয়াখালী-লাকসাম, লাকসাম-চাঁদপুর, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট, পাবর্তীপুর-লালমনিরহাট, পাবর্তীপুর-পঞ্চগড় রুটে চলাচল করত। ট্রেনগুলো মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের আশে পাশে কম দূরত্বে যেমন ২০ কিলোমিটারের মধ্যে চলাচলের জন্য কেনা হয়েছিল। কিন্তু অন্য রুটগুলোতে দূরত্ব চারগুণেরও বেশি ছিল। ফলে বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি ট্রেনগুলো। অথচ চীন থেকে আমদানি করা ডেমু ট্রেনগুলো ছিল সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তির। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ট্রেনগুলো ঠিক মতো রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে আয়ুকাল পর্যন্তই যাত্রী পরিবহন করতে পারত।
সারাবাংলা/জেআর/এনএস