Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাকায় বাড়ছে লোডশেডিং

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৯ অক্টোবর ২০২২ ০৮:৪৮

ঢাকা: কথা ছিল দিন-রাত মিলিয়ে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং হবে। সেটাও আবার হবে এলাকাভিত্তিক শিডিউল করে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীতে সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নজির চোখে পড়েনি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত আট ঘণ্টাই বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে বলে অভিযোগ নগরবাসীর। তারা বলছেন, যখন-তখন বিদ্যুৎ চলে যায়। কখনো এক ঘণ্টা আবার কখনো দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা পরেও বিদ্যুৎ আসে। একদিকে লোডশেডিং অন্যদিকে ভ্যাপসা গরমে এক রকম অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন।

বিজ্ঞাপন

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা এখন ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াট। গত কয়েক বছরে এ খাতে নানা উদ্যোগ নেওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা বেড়েছে। এই সক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং প্রায় বিদায় নিয়েছিল। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হতো না বললেই চলে। কিন্তু সেই জ্বলজ্বলে শহরে এখন হঠাৎ করে প্রায়ই নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গত কয়েক মাসে গ্রামের মতো শহরেও বাড়ছে লোডশেডিং। আর তা এখন খোদ রাজধানী ঢাকা শহরে প্রকট আকার ধারণ করেছে। দিন-রাত মিলিয়ে দুই ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কথা থাকলেও এখন তা পাঁচ, ছয় কখনো আট ঘণ্টায় ঠেকেছে।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি গ্রিড বিপর্যয়ের পর লোডশেডিং কিছুটা বেড়েছে। সংকট দ্রুতই কেটে যাবে বলে যদিও আশ্বস্ত করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্র অনুযায়ী, দেশে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তার একটি বড় অংশ ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। গত কয়েক মাস ধরে বিশ্ববাজারে সব ধরনের জ্বালানির দাম বাড়তি থাকায় চাপের মুখে পড়ে সরকার। তাই তেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতেও উৎপাদন কমিয়ে এনে লোডশেডিং করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিন্তু সেই শিডিউলে গ্রামাঞ্চল বা শিল্পাঞ্চল নেই, সে সব এলাকায় কম গুরুত্ব দিয়ে শিল্পাঞ্চল আছে এমন এলাকার পাশাপাশি সরবরাহ স্থিতিশিল রাখা হয় রাজধানীতে। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, গত ৭-৮ বছরে শহরের মানুষ বিদ্যুৎ নিয়ে অন্তত এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত তিন থেকে চারদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিংয়ের সময় বেড়ে গেছে।

রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা মো. আলমগীর হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত শুক্রবার ছুটির দিন সকাল ৭টার দিকে বিদ্যুৎ চলে গেছে। যদিও এক ঘণ্টা পরে ফিরে এসেছে। আবার ৯টার দিকে চলে গেল। এভাবে রাত পর্যন্ত ৭ থেকে ৮ বার গেল আবার আসল। প্রতিবার এক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎবিহীন থাকতে হয়েছে।’

বাণিজ্যিক এলাকার বাসিন্দা খালিদ হোসেন জানান, ‘গত এক যুগেও এমন লোডশেডিং দেখিনি। মধ্য রাতে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। সারাদিন তো যেতেই থাকে। গরম আবহাওয়ায় ইট-পাথরের ঘরে থাকা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

এদিকে গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে লেখালেখি চলছে। উন্নয়নকর্মী তানবীর সিদ্দীকি লিখেছেন, ‘রাত ৩টা ৩১ মিনিট। বিদ্যুৎ সাহেব চলে গেলেন!’ সজল সায়েক নামের আরেকজন লিখেছেন, ‘রাত ৩টায় কারেন্ট যায়। আল্লাহ ক্ষমা দাও। এই নিয়ে ৩ বার গেল।’

সাংবাদিক এমদাদুল হক তুহিন লিখেছেন, ‘এক ঘণ্টা করে তো বিদ্যুৎ যেতেই পারে। লোডশেডিং দিনে দুই তিন ঘণ্টা অস্বাভাবিক কিছু নয়। দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নের পরও লোডশেডিং শূন্য করা সম্ভব হয়নি। তবে সম্প্রতি গ্রিড বিপর্যয়ের পর লোডশেডিং অনেকটাই বেড়েছে। হয়তো কিছুদিনের মধ্যে তা আবারও কমে আসবে। কিন্তু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে যে হারে তা জানানো হচ্ছে, মনে হচ্ছে দেশে বিষ্ময়কর কিছু ঘটে যাচ্ছে, যেন বাংলাদেশে কোনোকালেই লোডশেডিং ছিল না।’

আরেক সাংবাদিক মোহাম্মদ মুকিমুল আহসান লিখেছেন, ‘বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের বানানো অনেকগুলো ডকুমেন্টারি ইউটিউবে দেখে ফেললাম এক ঘণ্টার লোডশেডিংয়ে। আলহামদুলিল্লাহ ফর এভরিথিং।’ তিনি কিছু সময়ের ব্যবধানে আরেকটি স্টাটাসে লিখেছেন, ‘মানুষ বোবা হয়ে আর কত আজাব সহ্য করবে! আহারে লোডশেডিং!’

তানভীর আহমেদ নামে একজন লিখেছেন, ‘মধ্যরাতে লোডশেডিং কোনো অবস্থায় মানবিক কাজের মধ্যে পড়ে না। তাই মানবিক সরকারের কাছে আকুল আবেদন বিষয়টি বিবেচনায় রাখবেন।’

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, গতকাল শনিবার (৮ অক্টোবর) বিদ্যুতের চাহিদা পিকআওয়ারে ছিল ১৩ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট, আর উৎপাদন করা হয়েছে ১১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। সে হিসাবে ১৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার তুলনায় ঘাটতি দেখা গেছে। এর আগের দিন শুক্রবার পিকআওয়ারে চাহিদা ছিল ১১ হাজার ৮৯৯ মেগাওয়াট আর উৎপাদন হয়েছে ৯ হাজার ২৪১ মেগাওয়াট, সে হিসাবে ২ হাজার ৬৫৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকতে দেখা যায়।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, দিনে গড়ে দুই হাজারের বেশি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। গ্যাস চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অধিকাংশই বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তাই লোডশেডিং এর পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুতের গবেষণা বিভাগ পাওয়ার সেল’র মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘যখন জ্বালানি সংকট সামনে আসে তখন পরিকল্পনা করা হয় বিদ্যুতের যেটুকু ঘাটতি দেখা দেবে তা লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা গেছে সাধারণ অনেক মানুষই সরকারকে সহযোগীতা করছে না। এক ঘণ্টা লোডশেডিং দিলে অনেকেই আইপিএস, জেনারেটরে পাওয়ার রিজার্ভ করছে। এতে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) সরবরাহ কমেছে।

এ প্রসঙ্গে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, ‘উৎপাদন তো কম হচ্ছে। ফলে লোডশেডিং কখনো কখনো বাড়াতেও হচ্ছে। তবে যতটা সম্ভব একেকবারে কম দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

এদিকে গত ৪ অক্টোবর দুপুর ২টার কিছু সময় পর জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চলে হঠাৎ বিপর্যয় দেখা দেয়। ফলে ঢাকাসহ দেশের চার বিভাগের একটা বড় অংশ বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, পিএম কার্যালয়, রাষ্ট্রপতির ভবনও বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে।

এই বিপর্যয়ের কারণে পূর্বাঞ্চল গ্রিডে বিদ্যুৎ উৎপাদন শূন্যে নেমে এসেছিল। ওই সময়ে এক ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ৮৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। যা কাটিয়ে উঠতে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা লেগে যায়। ওই ঘটনা খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটিও কাজ করছে।

গত বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) সচিবালয়ে সংবাদ ব্রিফিং করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, নাশকতার উদ্দেশে বিষয়টি ঘটেছে কি না বা যান্ত্রিক ত্রুটি কি না- এসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওই বিপর্যয়ের পর থেকে সিলেট বিভাগে লোডশেডিং বাড়ছে বলে পিডিবি সূত্রে জানা গেছে। একই কারণে রাজধানী ঢাকাতেও লোডশেডিং বাড়ছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সূত্র থেকে শোনা যাচ্ছে।

সরকারের হিসাবে ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি, যা এখন ১৫২টিতে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে। সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট (১৬ এপ্রিল ২০২২)। গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৩৬ লাখ। মোট সঞ্চালন লাইন (সা.কি. মি) ১৩ হাজার ৮৮৯। গ্রিড সাবস্টেশন ক্ষমতা (এমভিএ) ৫৬ হাজার ৬২৮, বিতরণ লাইন ( কি.মি) ৬ লাখ ২৯ হাজার। সিস্টেম লস ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ (জুন ২০২২)। মাথাপিছু বিদ্যুত উৎপাদন (কি: ও: আ:) ৬০৮ দশমিক ৭৬, বিদ্যুৎ সুবিধা প্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ১০০ ভাগ, প্রি-পেইড মিটার স্থাপন ৫১ লাখ ৭ হাজার ৪৫২টি এবং সোলার হোম সিস্টেম ৬০ লাখ।

সারাবাংলা/জেআর/এনএস

বিদ্যুৎ লোডশেডিং

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর