সম্প্রীতির মিলন মেলা ‘কল্প জাহাজ’ ভাসা উৎসব
১১ অক্টোবর ২০২২ ০৮:৩০
কক্সবাজার: জেলার রামু উপজেলার বাঁকখালী নদীতে ভাসানো হলো ঐতিহ্যবাহী ‘কল্প জাহাজ’। যাকে ‘স্বর্গের জাহাজ’ও বলা হয়ে থাকে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বর্ণিল এই উৎসবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলন মেলায় পরিণত হয় উৎসবটি। প্রায় ২০০ বছর ধরে রামুতে ‘কল্প জাহাজ’ ভাসানোর উৎসব উদ্যাপিত হয়ে আসছে।
বৌদ্ধদের শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারেও বাঁকখালী নদীতে জাহাজ ভাসা উৎসবের আয়োজন করেছে রামু কেন্দ্রীয় প্রবারণা ও জাহাজ ভাসা উৎসব উদযাপন পরিষদ। গতকাল সোমবার (১০ অক্টোবর) উপজেলা ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের ফকিরাবাজার চেরাংঘাটা এলাকায় বাঁকখালী নদীতে এ জাহাজ ভাসানো হয়।
বাঁকখালীর পাড়ে গিয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, এই উৎসবে রামু উপজেলার ছয়টি বৌদ্ধ পল্লিতে নির্মিত ৯টি কল্প জাহাজ অংশ নেয়। বাঁশ, বেত, কাঠ, রঙিন কাগজ দিয়ে অপূর্ব কারুকার্যে তৈরি জাহাজে সম্রাট অশোকের প্রতিকৃতি, ঈগল, ময়ূর, ঘোড়া, চূড়াসহ বিভিন্ন প্রাণির প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ছয়-সাতটি নৌকায় এক করে সেই নৌকার ভেলায় বসানো হয় এক একটি জাহাজ। এসব জাহাজেই চলে শিশু-কিশোর ও যুবকদের বাঁধভাঙা আনন্দ। উৎসবে অংশগ্রহণকারীরা জানান, এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির মিলন মেলা।
অর্পণ বড়য়া নামে এক যুবক বলেন, ‘এই উৎসবে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটি বিষয় রয়েছে। এতে সকল ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। এই মেলাকে প্রগতিশীল ও ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসীদের মিলন মেলাও বলা যেতে পারে।’
জাহাজ ভাসা উৎসবে আসা লাকী নামে এক নারী বলেন, ‘এই উৎসব একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিরপ্রকাশ। এখানে হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ সবাই সম্মিলিতভাবে এই অনুষ্ঠান উপভোগ করে থাকে। এর মধ্য দিয়েই একটি সকল মানুষের মধ্যে সুন্দর বন্ধন তৈরি হয়।’
উৎসবের কয়েকদিন আগে বিভিন্ন এলাকার গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা সংগ্রহ করেন বৌদ্ধ শিশু–কিশোর ও তরুণেরা। এ সময় ঢোল, মন্দিরা, বাঁশিসহ নানা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বুদ্ধকীর্তন গান তারা। সেই অর্থ দিয়ে বিভিন্ন প্রতিকৃতির কল্প জাহাজগুলো নির্মাণ করা হয়।
এই উৎসব কমিটির সভাপতি অর্পন বড়ুয়া বলেন, প্রতিবছর তিন মাস ভিক্ষুদের বর্ষাব্রত পালন শেষে প্রবারণা পূর্ণিমার পরদিন কল্প জাহাজ ভাসানো উৎসব হয়ে থাকে।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে মিয়ানমারের মুরহনঘা নামক স্থানের একটি নদীতে সংঘরাজ ম্রাজংব্রান প্রথম কল্প জাহাজ ভাসানো উৎসব আয়োজন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে রামুতেও এই উৎসবের প্রচলন হয়।
সংসদ সদস্য (কক্সবাজার-৩-সদর, রামু, ঈদগাঁও) সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক অপশক্তি কখনো ঐতিহ্যকে নষ্ট করতে পারে না। এই জাহাজ ভাসা উৎসব তারই প্রমাণ। সকল নানা ধর্ম-বর্ণের হাজার হাজার মানুষ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেছে। এই মিলন মেলায় প্রমাণ করে সাম্প্রদায়িক শক্তি পরাজিত হয়েছে।’
এই উৎসবের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। প্রবারণা পূর্ণিমার জাহাজ ভাসানো উৎসবে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সম্প্রীতি মেলবন্ধন দেখে এই কথার সত্যতা ফুটে উঠেছে। এই আয়োজন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হলেও এই উৎসব যেন সবার। এরই মাধ্যমে একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তৈরি হয়েছে।’
সম্প্রীতির বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এভাবেই মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের ধর্মীয় উৎসব সবার জন্য আনন্দের উৎস হোক- এমনটাই কামনা করেন সচেতন মহল।
বৌদ্ধভিক্ষুদের মতে, আড়াই হাজার বছর আগে বৈশালী নামক রাজ্যে অনাবৃষ্টি, খরা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মারা যেতে থাকে মানুষ ও জীবজন্তু। তখন রাজার আমন্ত্রণে শিষ্যদের নিয়ে বৈশালীতে যান গৌতম বুদ্ধ। তিনি ‘রত্নসূত্র’ পাঠ করে খারাপ দেবতার প্রভাব থেকে বৈশালীকে রক্ষা করেন। ফিরতি পথে সর্প দেবতারা ৫০০টি নৌকায় শিষ্যসহ বুদ্ধকে নদী পার করে দেন। তাই এই দিনকে স্মরণ করতেই কল্প জাহাজ ভাসানো উৎসব পালত করে আসছেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা।
সারাবাংলা/এনএস