নৌকায় চলা জীবনে স্বস্তি দিতে পারে ১০ কিমি সড়ক
১৩ অক্টোবর ২০২২ ২০:৫৮
ঢাকা: পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলা। এই উপজেলার গাওখালী বাজার এলাকার দেউলবাড়ী, ডোবরা ইউনিয়নের মনোহরপুর, সাতিয়া, পদ্মডুবি ও পূর্ব মগরজোর এলাকায় নেই কোনো সড়ক। আছে কেবল বিস্তীর্ণ খাল আর বিল। এসব এলাকার জনগণসহ ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর স্কুল-কলেজ ও মাদরাসায় যাতায়াতের বাহন নৌকা। এই নৌকার মাঝিও শিক্ষার্থীরা। আর এই অবস্থা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।
স্থানীয়রা জানিয়েছে, এসব এলাকায় রাস্তাসহ কালভার্ট নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে সয়েল টেস্ট শুরু হয়েছে। ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হলে বিস্তীর্ণ এই এলাকার শিক্ষার্থী ও জনগণের যাতায়াত দুর্ভোগ অনেকাংশে কমে যাবে। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এই সড়ক নির্মাণে ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রয়োজন। মনোহরপুরসহ ওই এলাকার কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বিরাজমান এই সমস্যা দ্রুত সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
২০১৮ সালে ২০ জুলাই সারাবাংলা ডটনেটে এই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা ও দুর্ভোগ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর এই এলাকার পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু করেছে। বর্তমানে ওই বিস্তীর্ণ এলাকায় সড়কসহ স্কুল-কলেজ ও মাদরাসাগুলোতে বিশুদ্ধ পানি ও সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করা হচ্ছে। এখন বাকি রয়েছে সড়ক ও কালভার্ট নির্মাণ।
বর্তমানে ওই এলাকায় ১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ছয়টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি আলিম মাদরাসা এবং একটি কলেজ রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি। বিস্তীর্ণ এই জনপদের শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে যাতায়াত করে নৌকায় চড়ে। এমনকি শীত মৌসুমে তাদের ক্লাস কার্যক্রম চলে জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে।
স্থানীয়রা জানিয়েছে, নৌকা বেয়ে স্কুলে লেখাপড়া করে এই এলাকার অনেক সন্তান পুলিশের উচ্চপদে চাকরি করছেন। অনেকে হয়েছেন সচিবও। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে মনহরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করেন। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের এখানে একটি প্রাথমিক ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। স্কুল দু’টির একতলা করে ভবন এবং বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য সড়ক নির্মাণ হয়নি। ফলে জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে ক্লাসের সূচি করা হয়।’
আরও পড়ুন: নৌকা বেয়ে শিশুরা আজও স্কুলে যায়… আর নয় বেশি দিন!
তিনি জানান, এ বছর ৩৩ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। এদের সকলেই পাস করেছে। এবং তাদের ফলাফলও বেশ ভালো। নূরে আলম সিদ্দিকী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই শিক্ষার্থীরা যাতায়াত দুর্ভোগের মধ্যেও পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার তাদের বাড়ি ফিরতে রাত ৯টা বেজে গেছে। কারণ তাদের জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে আসা-যাওয়া করতে হয়েছে।’
এ বিষয়ে নাজিরপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পদে (অতিরিক্ত দায়িত্ব) থাকা মো. আল মামুন সারাবাংলাকে জানান, মনোহরপুর বজার পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সড়ক নির্মাণের আগে ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করতে হয়। এ জন্য সয়েল টেস্ট কার্যক্রম চলছে।
তিনি বলেন, ‘বিস্তীর্ণ ওই এলাকার শিক্ষার্থীরা যুগ যুগ ধরে খুবই কষ্টে স্কুল-কলেজে যাতায়াত করে থাকে। বর্তমান সরকারের প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ.ম রেজাউল করিম শিক্ষার্থীসহ জনগণের কষ্ট লাগবের জন্য চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তার চেষ্টা অনেকটা সুফল বয়ে এনেছে।’
এ বিষয়ে নাজিরপুরের উপজেলা প্রকৌশলী মো. জাকির হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গাউখালী ইউনিয়নের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য সড়ক-কালভার্ট নির্মাণের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে। স্কুল শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দারিদ্র্যপীড়িত এলাকা হওয়ায় স্কুলে টিফিন নিয়ে আসে না কেউ। বিলাঞ্চল হওয়ায় স্কুল ফিডিং কার্যক্রমও নেই এখানে। ফলে শিশুরা ক্ষুধার তাড়না নিয়ে ক্লাস করে।’
স্থানীয় বাসিন্দা কামরুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখানকার স্কুলের শিক্ষার্থীরা অনেকে পানি খেয়েই পেট ভরে রাখে। ফলে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারে না। তাই ফলাফলও ভালো হয় না। তাছাড়া উপস্থিতিও কম।’
স্থানীয় চেয়ারম্যান রফিকুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা ঝুঁকি নিয়েই সারাবছর নৌকায় চড়ে স্কুলে যাতায়াত করে। অনেক সময় নৌকা ডুবে যায়। তবে বিলাঞ্চল হওয়ায় জীবনের প্রয়োজনে শিশুরা সাঁতার জানে। এ কারণে হতাহতের ঘটনা তেমন ঘটে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই এলাকার জনদুর্ভোগ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসে। তিনি ইতোমধ্যে এই এলাকার স্কুলগুলো একতলা করে দিয়েছেন। এছাড়া বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করেছেন। স্কুলে যাতায়াতের জন্য সড়ক নির্মাণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মাস্টার মো. ওয়ালী উল্লাহ জানান, তার ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা বিলাঞ্চল হওয়ায় সড়ক যোগাযোগ কম। তাই অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নৌকায় করে স্কুলে যাতায়াত করতে হয়। তবে আগে অবস্থা আরও খারাপ ছিল।
ছবি: আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
সারাবাংলা/এএইচএইচ/পিটিএম