সংকট কাটিয়ে চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড, বাড়বে রফতানি
২৭ অক্টোবর ২০২২ ১০:২৯
মৌলভীবাজার: দেশে গত সেপ্টেম্বর মাসে ১৪৭ কোটি ৪০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে, যা অতীতের যেকোনো মাসের উৎপাদনের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। বাংলাদেশ চা বোর্ড এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। একইসঙ্গে চায়ের রফতানি আরও বাড়ার প্রত্যাশা করছেন উৎপাদন সংশ্লিষ্টরা।
এর আগে, মাসভিত্তিক উৎপাদনের সর্বশেষ রেকর্ড হয় গত বছরের অক্টোবর মাসে। ওই মাসে উৎপাদন ছিল ১৪৫ কোটি ৮০ লাখ কেজি।
চা বোর্ড সংশ্লিষ্টরা জানান, অনুকূল আবহাওয়া, ভর্তুকি মূলে সার বিতরণ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও চা বোর্ডের নিয়মিত মনিটরিং, বাগান মালিক ও শ্রমিকদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে গত আগস্টের শ্রমিক কর্মবিরতির সংকট কাটিয়ে এ শিল্প ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বছর আগস্ট মাসে শ্রমিক কর্মবিরতির কারণে উৎপাদন কিছুদিন বন্ধ থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ দিক-নির্দেশনায় শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয় এবং বাগানের স্বাভাবিক কার্যক্রম দ্রুত শুরু হয়। এছাড়া সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় বৃষ্টি, ভর্তুকিমূল্যে সার বিতরণ, চা রফতানির ক্ষেত্রে প্রণোদনা, নিয়মিত বাগান মনিটরিং এবং শ্রমকল্যাণ নিশ্চিত করায় এ বছর চায়ের উৎপাদন অনেক ভালো।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের ১৬৭টি চা-বাগান এবং ক্ষুদ্রায়তনের চা বাগান থেকে দেশে সেপ্টেম্বর মাসে ১ কোটি ৪৭ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় দেড় কোটি কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। এর আগে কোনো মাসেই দেশে এ পরিমান চা উৎপাদন হয়নি। অতীতের যেকোনো মাসের উৎপাদন রেকর্ড ছাড়িয়েছে এই উৎপাদন। এর আগে মাসভিত্তিক উৎপাদনের সর্বশেষ রেকর্ড হয়েছিল গত বছরের অক্টোবর মাসে। ওই মাসে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছিল দেশে।’
সেপ্টেম্বর মাসে রেকর্ড উৎপাদন চা শিল্পের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক ঘটনা উল্লেখ করে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, ‘চলতি আগস্ট মাসে শ্রমিক কর্মবিরতির কারণে উৎপাদন কিছুদিন বন্ধ থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ দিক নির্দেশনায় শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হয় এবং বাগানের স্বাভাবিক কার্যক্রম দ্রুত শুরু হয়। এছাড়া প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত, সঠিক সময়ে ভর্তুকিমূল্যে সার বিতরণ, চা রফতানির ক্ষেত্রে প্রণোদনা, নিয়মিত বাগান মনিটরিং, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি ও শ্রমকল্যাণ নিশ্চিতকরণের ফলে এ বছর চায়ের উৎপাদন অনেক ভালো।’
সরকারের নানা উদ্যোগের পাশাপাশি বাগানমালিক, চা-ব্যবসায়ী ও চা-শ্রমিকদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফলে চা শিল্পের সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
চা বোর্ডের তথ্যে দেখা যায়, সঠিক ব্যবস্থাপনার ফলে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) দেশের ১৬৭টি বাগান এবং ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগানে সব মিলিয়ে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৩০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। ২০২১ সালে দেশে মোট ৯ লাখ ৬৫ হাজার ৬ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছিল, যা ছিল ২০২০ সালের চেয়ে ১ কোটি ১ লাখ ১১ হাজার কেজি বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই একবছরে এত বেশি চা উৎপাদন হয়নি।
শুধু উত্তরাঞ্চলে সমতলের চা-বাগান ও ক্ষুদ্র চা বাগানগুলো থেকেই গত বছরে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা জাতীয় উৎপাদনে যুক্ত হয়েছিল; ২০২০ সালে যা ছিল ১ কোটি ৩ লাখ টন। বর্তমান ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে- এমন আশার কথা শুনিয়ে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, ‘২০২২ সালে ২০২১ সালের চেয়েও বেশি চা উৎপন্ন হবে দেশে। মহামারি করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতেও উৎপাদন কর্মকাণ্ড অব্যাহত ছিল। এতেই বোঝা যায় যে, চা শিল্পের সক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।’
চা বোর্ডের পক্ষ থেকে উত্তরাঞ্চলে চা চাষিদের ‘ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুলের’ মাধ্যমে চা আবাদ বিষয়ে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহ করা হয়। যার ফলে সমতলের চা-বাগান ও ক্ষুদ্র চা চাষ থেকে বেশি চা উৎপাদন সম্ভব হয়েছে বলেও জানান চা বোর্ডের পরিচালক।
তবে চা উৎপাদন বাড়লেও রফতানিতে ভালো করছে না বাংলাদেশ। একসময় চা ছিল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রফতানি পণ্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চা থেকে কাঙ্ক্ষিত বিদেশি মুদ্রা দেশে আসছে না। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে চা রফতানি থেকে ২১ লাখ ৪০ হাজার ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ কম।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে অবশ্য ইতিবাচক ধারা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) চা রফতানি থেকে ৪ লাখ ৯০ হাজার ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি।
এ প্রসঙ্গে আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে চা উৎপাদন বাড়ায় এখন বিভিন্ন দেশ থেকে পরিমানে কম চা আমদানি করতে হবে। এতে বিদেশি মুদ্রা সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে রফতানিও বাড়বে। তিনি বলেন, চা রফতানি বাড়াতে হলে আমাদের চায়ের গুণগতমান বাড়াতে হবে। বিদেশে যে মানের চায়ের চাহিদা বেশি, সেই মানেরই চা উৎপাদন করতে হবে।’
চা বোর্ডের তথ্য অনুসারে, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়ায় দেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৮ কোটি কেজি চা উৎপাদন ছিল, যা ছাপিয়ে ২০১৯ সালে উৎপাদন ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি হয়। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় ২০২০ সালে উৎপাদন কমে ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯৪ হাজার কেজিতে নেমে আসে। ২০১৯ সালে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি।
দেশের ১৬৭টি চা-বাগানের মধ্যে ১৩৬টিই বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে সর্বোচ্চ ৯১টি, হবিগঞ্জে ২৫টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২১টি, পঞ্চগড়ে ৮টি বাগান, রাঙ্গামাটিতে ২টি এবং ঠাকুরগাঁওয়ে রয়েছে একটি চা বাগান রয়েছে।
সারাবাংলা/এমও