গ্রিন ফ্যাক্টরি: বদলে দিয়েছে শ্রমজীবন
৮ নভেম্বর ২০২২ ১৩:১৪
নারায়ণগঞ্জ থেকে ঘুরে এসে: ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের একটি সবুজ কারখানা ফতুল্লা অ্যাপারেলস। এর ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে সবুজের সমারোহ। চারদিকে নানা প্রাজাতির ফুল ও ফলের গাছ। রয়েছে একটি পুকুরও। যেন কারখানাটির আঙিনার পরতে পরতে প্রকৃতির ছোঁয়া। শ্রমিকরা যেসব ফ্লোরে কাজ করছেন, সেখানকার পরিবেশও চমকপ্রদ। সুয়িং মেশিনগুলো এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে, যেন এক ডেস্ক থেকে অন্য ডেস্কের দুরত্বও বেশ। নিটিং সেকশনের সিঙ্গেল জার্সি আপ মেশিনগুলোর ক্ষেত্রেও একটি থেকে অন্যটির দুরত্ব রয়েছ অনেকটা। কারখানার ভেতরে ঘিঞ্জি পরিবেশ নেই।
সবমিলিয়ে এই সবুজ কারখানায় কাজ করে প্রশান্তির কথা জানিয়েছেন শ্রমিকরা। বলছেন, নিয়মিত বেতনভাতা সবকিছুতেই বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন তারা। কারখানার কর্মপরিবেশও শ্রমিকবান্ধব। সম্প্রতি নারায়গঞ্জের জালকুড়ি এলাকায় অবস্থিত কারখানাটি ঘুরে ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
কারখানাটির সুয়িং সেকশনে কথা হয় লেবেল মেকার মিনারা মিনুর (৩৫) সঙ্গে। স্বামী মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরেছেন তিনি। তার এক ছেলে এখন ডিপ্লোমা ইঞ্চিনিয়ারিংয়ে পড়ছে। মিনু সারাবাংলাকে বলেন, ‘৩ বছর ধরে এখানে কাজ করছি। এর আগে গ্রামে ছিলাম। স্বামীর আয় দিয়েই সংসার চলত। উনি মারা যাওয়ার পর পরিবারের হাল ধরতে হয়েছে। ছেলেকে ইন্টার (এইচএসসি) পাশ করিয়েছি। এখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি করিয়েছি। তাই বাধ্য হয়ে গার্মেন্টেসে কাজ করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানকার পরিবেশ খুবই ভালো। সব দিক থেকে এই কারখানা খুবই সুন্দর। এখানে নিয়ম-কানুন ভালো। সবার ব্যবহার ভালো। চারদিকে তাকালে মনে হয় যেন পার্ক আছি। কাজের জায়গা থেকেও বাইরের দিকে তাকালে চোখে শান্তি লাগে।’
সুয়িং সেকশনে কাজ করেন মাকসুদা ( ৩২)। গত মার্চ থেকে কারখানাটিতে কাজ করছেন তিনি। মাকসুদা বলেন, ‘৩ মাস হয়েছে অপারেটর হয়েছি। এখানে নেওয়ার আগে ট্রেনিং করিয়েছে। ১৫ বছর আগেও গার্মেন্টেসে কাজ করতাম। অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে গেছে। এখন আর্থিক অবস্থা খারাপ তাই আবারও এই কারখানায় যোগ দিয়েছি। স্বামী টেক্সটাইল মিলে কাজ করে। এখানের পরিবেশ অনেক ভালো লাগে। কারখানার আঙিনা অনেক সুন্দর। ভেতরে বকাঝকা নেই। মাইক দিয়ে ঘোষণা করা হয়— কেউ কাউকে গালিগালাজ করতে পারবে না। কারখানায় নাস্তা ও দুপুরের খাওয়ার জন্য আলাদা ফ্লোর আছে, সেখানেই দুপুরের খাবার খাই। তবে এই কারখানায় ওভারটাইম কম করানো হয়।’
ময়মনসিংহের রিমলা আক্তার (৩০)। স্বামীর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের শিবু মার্কেট এলাকায় থাকেন। তাদের ঘরে এক ছেলে রয়েছে। কাজ করেন ফতুল্লা অ্যাপারেলসে। রিমলা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছুটি চাইলে আমাদের ছুটি দেওয়া হয়। বেতন ব্যাংকে হয়। ৫ তারিখের মধ্যে বেতন হয়ে যায়। কারখানার ভেতের খোলামেলা পরিবেশ। সব কিছু এখানে মেনে চলে, নিয়ম-কানুন ভালো।’
রিমলা আরও বলেন, ‘সকালে ৬টায় ঘুম থেকে উঠে রান্না করি। দুপুরের খাবার নিয়ে অফিসের বাসে করে কারখানায় আসি। এখানে খাওয়া-দাওয়ার জন্যে বসার ব্যবস্থাও ভালো। খাবারের পর অল্প সময় কারখানার আশেপাশে ঘোরাফেরা করি। এখানে কাজ করতে আমাদের ক্লান্তি লাগে না। সবমিলিয়ে এখানে কাজের পরিবেশে খুবই স্বস্তিদায়ক।’
কারখানাটিতে পলিম্যানের কাজ করেন মিষ্টি (২১)। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কোনো সমস্যা হলে তারা তা বুঝাতে চেষ্টা করে। ছুটি চাইলে ছুটি দেয়। এখানে বেতন সময় মতো হয়।’ ১৯ বছরের ইতি, ৬ বছর ধরে এই কারখানায় কাজ করছেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা একজন কৃষক। ক্লাস নাইন (৯ম শ্রেণি) পর্যন্ত পড়েছি। তারপর থেকে গার্মেন্টেসে কাজ করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অবিবাহিত হলেও এখানে কেউ কোনো ধরনের সমস্যা করে না। কাজ করতে কোনো সমস্যা হয় না। সবাই পরিবারের সদস্যের মতো। কারখানার পরিবেশও খুব ভালো। ছুটি দেয়। নিময় ভালো। অবসর সময়ে কারখানার আশেপাশে ঘুরতে ভালো লাগে।’
নাজমা নামের আরেক শ্রমিক বলেন, ‘কোম্পানি আমাদের বাস দিয়েছে। অফিসের গাড়িতেই কারখানায় আসি। আবার এখান থেকে কাজ শেষে কোম্পানির বাস করে বাসায় যাই। এই কারখানায় চাপ কম। পরিবেশও সুন্দর।’
কারখানাটির কাটিং সেকশনে দেখা গেল অটোমেটিক ফেব্রিক চেকিং মেশিন। এর মাধ্যমে ফেব্রিকের গুণগত মান চেক করা হয়। কোথাও কোনো ধরনের কাটা-ছেঁড়া বা কাপড়ে দাগ থেকে তার রিপোর্ট কম্পিউটারে চলে যায়। এর ফলে রিজেক্ট হওয়া পণ্যের পরিমাণ একেবারেই কমে যায়। এমনটিই জানিয়েছেন ফতুল্লা অ্যাপারেলসের মহাব্যবস্থাপক (প্রোডাকশন) মো. আসাদুজ্জামান। এই কারখানার নিটিং সেকশনে কাজ করে ২০ থেকে ২২ জন। সেখানে সুতা থেকে কাপড় তৈরি হয়। সেখানের কর্মপরিবেশও খুব ভালো। এক মেশিন থেকে আরেকটি মেশিনের দুরত্ব খুবই বেশি।
কর্মরতরা জানান, সিঙ্গেল জার্সি আপ মেশিনে সেখানে সুতা থেকে কাপড় তৈরি হচ্ছে। কারখানাতে নিজেদের পলি নিজেরাই তৈরি করছে। নিটিং অপারেটর জাহাঙ্গীর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি এখানে তিন বছর ধরে কাজ করছি। এখানে সুযোগ-সুবিধা ভালো। বেতন সঠিক সময়ে দেয়। কারখানার ভেতরে সবই সবুজ। এখানে ফাঁকা জায়গা অনেক বেশি।’
নিটিং সেকশনের নির্বাহী পরিচালক নুরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা কাগজে কলমেই গ্রিন না, বাস্তবতায় গ্রিন ফ্যাক্টরি। চারদিকে সবুজ। কর্মপরিবেশ ভালো। সঠিক সময়ে বেতন প্রদান করা হয়। আমাদের তৈরি কাপড়ের গুণগত মানের বিষয়ে খুবই সতর্ক আমরা। কোনো পণ্যে ত্রুটি হলে তা ডেলিভারি করি না। ভালো জিনিস দেওয়ার চেষ্টা করি।’
কারখানাটির মহাব্যবস্থাপক (প্রোডাকশন) মো. আসাদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘নারায়রণগঞ্জে তিন থেকে চারটি সবুজ কারখানা রয়েছ, এর মধ্যে ফতুল্লা অ্যাপারেলস অন্যতম। কারখানাটির শ্রমিকদের বড় একটি অংশ ২০ থেকে ২৫ বছর ধরেই এখানে কাজ করছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে ৩ থেকে ৪ তারিখের মধ্য বেতন হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মপরিবেশ সবচেয়ে ভালো। বেতন, ওভারটাইম ঠিকমতো দেওয়া হয়। ১০ রোজার মধ্যে বোনাস দেওয়া হয়। কর্মপরিবেশ নিরাপদ। বাতাস প্রবেশের জন্য দরজা-জানালায় গ্রিল রাখা হয়নি, গ্লাসও খোলা যায়। রাতের বেলায়ও দরজা-জানালা আটকানো যায় না, খোলা থাকে। প্রতি ফ্লোরে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়লে রেড এলার্ট আসবে, যেহেতু আমাদের পরিবেশ ভালো, এখন পর্যন্ত কোনোদিন এই এলার্ম বাজেনি। ভেতরে ডায়িং নেই, তাই কার্বন ডাই-অক্সাইডও কম। কারখানাটিতে ৪৫০ জন শ্রমিক রয়েছে। এখানে কাজ করে সবাই সন্তুষ্ট।’
কারখানায় নিজের অফিসে বসে সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেন ফতুল্লা অ্যাপারেলসের মালিক ফজলে শামীম এহসান। তিনি বলেন, ‘সবুজ আমার প্রিয়। সবুজের মাঝখানে বড় হয়েছি। প্লাটিনাম নাকি গোল্ড পাব— এই চিন্তা থেকে সবুজ কারখানা করিনি। সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য করা হয়নি, সখের জন্যই করেছি। কারণ, আমি তো এই কারখানাতেই বসি। আমার কারখানা একটিই। তাই চাই কাজের পরিবেশটা আনন্দময় হোক। এই যে এখানে বসে আছি— যেদিকে তাকাবেন সেদিকেই সবুজ। আপনি চাইলেই বাইরের প্রকৃতি দেখতে পারছেন। এতে হৃদয়ে প্রশান্তি আসে। চোখেরও শান্তি লাগে।’
তিনি বলেন, ‘কারখানার সব তার (ক্যাবল) মাটির নিচ দিয়ে গেছে। ভেতরে কোনো ঝুলানো তার দেখা যাবে না। শ্রমিকরা যেকোনো জায়গা থেকে বাইরের দিকে তাকালে সবুজ দেখতে পায়। চোখ শান্তি পায়। ৭০ থেকে ৭২ শতাংশ কাজই সূর্যের আলো দিয়ে কাভার করা যায়, বিদ্যুতের ব্যবহার কম। প্রত্যেক বিভাগে কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিমাপের মিটার আছে। খোলা মেলা থাকার কারণে কার্বনের পরিমাণও কম।’
শামীম এহসান আরও বলেন, ‘কারখানাতে বৃষ্টির পানি সম্পূর্ণ সংরক্ষণ করা হয়। খাওয়ার পানি, অজু ও হাতমুখ ধোয়ার জন্য কেবলমাত্র ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয়। বাকিসব কাজে রিসাইকেল ওয়াটার ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের এখানে ৬০ কিলোওয়াটের সৌর বিদ্যুৎ প্যানেল রয়েছে। ভবিষ্যতে আরও ১০০ কিলোওয়াটের প্ল্যান্ট স্থাপন করার লক্ষ্য রয়েছে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ফ্যানের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি, লাইটে তেমন খরচ হয় না। আরও কি করলে বিদ্যুৎ খরচ কমানো যাবে, তা নিয়েও কাজ চলছে। আমাদের এখানে যে বিদ্যুৎ প্রয়োজন, ভবিষ্যতে তার ৫০ শতাংশই বিকল্প উৎস থেকে মোটানো সম্ভব হবে।‘
শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা প্রযুক্তির মাধ্যমে নিরুপণ করা হবে জানিয়ে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে শ্রমিকদের ইফিসিয়েন্সি (কর্মদক্ষতা) ৩৫ থেকে ৫৫ শতাংশ। চীনে এই হার ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ। প্রতিটি শ্রমিকের কর্মস্পৃহা অটোমেটিক ক্যালকুলেট হবে- এমন প্রযুক্তি আমরা নিয়ে আসছি। কে কতোটুকু পরিশ্রম করছে, তা পরিমাপ করা হবে। অনেক সময় দেখা যায়, ভালো শ্রমিকও বঞ্চিত হয়, অবার খারাপ শ্রমিকের পদন্নতি হয়। প্রযুক্তির ব্যবহার হলে সত্যিকার অর্থে কে কতটা কাজ করছেন তা সহজেই নিরুপণ করা যাবে। এতে শ্রমিকদের কর্মক্ষমতাও বাড়বে।’
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে নারায়ণগঞ্জের জালকুড়িতে ফতুল্লা অ্যাপারেলেসের নিটিং সেকশনের কাজ শুরু হয়। গার্মেন্টস শুরু হয় ২০২০ সালে। গত সেপ্টেম্বরে কারখানাটি সবুজ কারখানার তকমা পেয়েছে। কারখানাটি একটি প্লাটিনাম ক্যাটাগরির সবুজ কারখানা। ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ডিজাইন (এলইইডি) গ্রিন ফ্যাক্টরি বা সবুজ কারখানার সার্টিফিকেশন দিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য মতে, বাংলাদেশে এখন গ্রিন ফ্যাক্টরি ১৭৬টি। এর মধ্যে প্লাটিনাম ক্যাটাগরির ৫৭টি, গোল্ড ১০৫টি, সিলভার ১০টি ও সার্টিফাইড চারটি। এছাড়া ৫৫০টির বেশি কারখানা গ্রিন ফ্যাক্টরি হতে রেজিস্ট্রেশন বা পাইপলাইনে রয়েছে। আর দীর্ঘদিন ধরেই সবুজ কারখানার তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা অ্যাপারেলস থেকে ছবিগুলো তুলেছেন সারাবাংলার সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট হাবিবুর রহমান
সারাবাংলা/ইএইচটি/এনএস