Thursday 28 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সর্ববৃহৎ ইয়াবা চালানের তদন্তে গাফিলতি, আদালতের অসন্তোষ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৩ নভেম্বর ২০২২ ২২:২৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: পাঁচ বছর আগে মায়ানমার থেকে নৌপথে আনার সময় গভীর সাগরে মাছ ধরার ট্রলারে অভিযান চালিয়ে ২০ লাখ ইয়াবার একটি চালান আটক করেছিল র‌্যাব। এখন পর্যন্ত দেশে আটক হওয়া সর্ববৃহৎ ইয়াবার চালান এটিই, যার খবর পেয়ে চট্টগ্রামে ছুটে এসেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। কিন্তু চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এই ইয়াবার চালানের মামলার তদন্ত নিয়ে অসেন্তাষ প্রকাশ করেছেন আদালত।

বিজ্ঞাপন

যে ট্রলার থেকে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে, সেটির প্রকৃত মালিককে শনাক্ত করে অভিযোগপত্রে আসামি না করায় আদালত বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। পর্যায়ক্রমে তদন্তের দায়িত্ব পালন করে যাওয়া তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছেন আদালত।

বিজ্ঞাপন

রোববার (১৩ নভেম্বর) চট্টগ্রাম চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শরিফুল আলম ভুঁইয়া এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে পর্যবেক্ষণে আদালত তদন্তের ত্রুটি ও তদন্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতির বিষয়টি তুলে ধরেন।

অভিযোগপত্রে মামলার আসামি ছিল মোট ১৭ জন। এর মধ্যে ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বাকি ছয় আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী ওমর ফুয়াদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এজাহার ও তদন্ত প্রতিবেদনে ট্রলারের মালিক বলা হয়েছে একজনকে। কিন্তু আদালতে সাক্ষ্যপ্রমাণে প্রকৃত মালিক হিসেবে আরেকজন শনাক্ত হয়েছেন। আদালত পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন, ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় ট্রলারের মালিক দায় এড়াতে পারেন না। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তারা প্রকৃত মালিককে শনাক্তে কোনো ভূমিকাই রাখেননি। তদন্তে গাফিলতি হয়েছে বলে মনে করছেন আদালত।’

পর্যায়ক্রমে যে তিনজন কর্মকর্তা মামলাটির তদন্ত করেছেন, তারা হলেন- নগরীর পতেঙ্গা থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) গাজী মুহাম্মদ ফৌজুল আজিম, র‌্যাব-৭ এর তৎকালীন সিনিয়র সহকারী পরিচালক এএসপি মো. জালাল উদ্দিন আহম্মদ এবং পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিন।

জানা গেছে, পুলিশ পরিদর্শক ফৌজুল আজিম বর্তমানে পিবিআইয়ের ফেনী জেলা ইউনিটে কর্মরত আছেন। জালাল উদ্দিন আহম্মদ গাজীপুর জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে আছেন। মঈন উদ্দিন পিবিআই থেকে গত বছর অবসরে যান।

২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল ভোরে গভীর সাগরে এফভি মোহছেন আউলিয়া নামে একটি মাছ ধরার ট্রলারে অভিযান চালিয়ে ২০ লাখ ইয়াবাসহ আটজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তারা হলেন— মকতুল হোসেন, আব্দুর নূর, হেলাল, আব্দুল খালেদ, জানে আলম, লোকমান, এনায়েত উল্লাহ ও নুরুল মোস্তফা। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই দিনই নগরীর পাঁচলাইশ থানার সুগন্ধা আবাসিক এলাকার বাড়ি থেকে র‌্যাব গ্রেফতার করে মোজাহার মিয়া নামে আরেকজনকে।

অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া র‌্যাব-৭ এর তৎকালীন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, মোজাহার মিয়া ইয়াবা চালানের মূল মালিক। ট্রলারের মালিক পলাতক আব্দুল জলিল ওরফে লবণ জলিল।

এ ঘটনায় র‌্যাবের চট্টগ্রাম জোনের উপ সহকারী পরিচালক (ডিএডি) অমল চন্দ বাদী হয়ে নগরীর পতেঙ্গা থানায় মামলা করেছিলেন।

মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় জানা গেছে, মামলাটি প্রথমে তদন্তের দায়িত্ব পালন করেন পতেঙ্গা থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) গাজী মুহাম্মদ ফৌজুল আজিম। কিন্তু এক সপ্তাহের মাথায় থানা থেকে তদন্তভার নিয়ে নেয় র‌্যাব। র‌্যাব-৭ এর তৎকালীন সিনিয়র সহকারী পরিচালক এএসপি মো. জালাল উদ্দিন আহম্মদ তদন্ত করে ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল ১১ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।

আদালত অভিযোগপত্র নাকচ করে অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দেন পিবিআইকে। সংস্থার চট্টগ্রামের মেট্রো ইউনিটের ওই সময়কার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিন তদন্ত করে ২০১৮ সালের ৭ মার্চ সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে আরও ছয়জনকে আসামি হিসেবে যুক্ত করে মোট ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

মামলার এজাহার ও অভিযোগপত্রে ট্রলারের মালিক হিসেবে আব্দুল জলিলের নাম উল্লেখ আছে। কিন্তু আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন, সামুদ্রিক মৎস্য অধিদফতর থেকে ইস্যু করা লাইসেন্সে ট্রলারটির মালিকের নাম জনৈক ‘নেজাম উদ্দিন, পিতা- মো. ইউসুফ’ উল্লেখ আছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের শুল্ক আদায়ের রশিদ, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের অর্থ বিভাগের কনজারভেন্সি চার্জের পরিশোধ সংক্রান্ত ছাড়পত্র এবং নৌ বাণিজ্য অধিদফতরের পরিদর্শন সনদে ফিশিং ট্রলারের মালিকের নাম ‘নেজাম উদ্দিন, পিতা- মো. ইউসুফ’ উল্লেখ আছে।

’২০ লাখ ইয়াবার চালান যে ট্রলার থেকে জব্দ করা হয়েছে, সেই ট্রলারের মালিক এই ঘৃণ্য অপরাধের দায় এড়াতে পারেন না। কিন্তু আশ্বচযর্জনকভাবে তিনজন তদন্তকারী কর্মকর্তার কেউই এই বিপুল পরিমাণ মাদক সরবরাহকারী ফিশিং বোটটির মালিক নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেননি অথবা অভিযোগপত্রে নীরব থেকেছেন। এই চালান ফিশিং ট্রলারের মালিকের জ্ঞানের বাইরে হওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করে আদালত। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে কাগজে-কলমে নেজাম উদ্দিনের নাম থাকার পরও তদন্তকারী কর্মকর্তারা কেউই আগ্রহ দেখাননি। এ বিষয়ে অভিযোগপত্র ও সম্পূরক অভিযোগপত্রে কোনো ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়নি।’

বিষয়টি তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে মারাত্মক অবহেলা ও গাফিলতি বলে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে।

তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আইজিপির ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছেন আদালত।

আদালত পর্যবেক্ষণে মাদক সংক্রান্ত মামলা অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের ‘ইন হাউজ প্রশিক্ষণ’ জোরদারের তাগিদ দিয়েছেন। এছাড়া তদন্তের অসঙ্গতিগুলো নজরে আনার জন্য চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে রায়ের কপি পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।

উল্লেখ্য, মামলার রায়ে যে ১১ আসামির সাজা হয়েছে তারা সবাই তৎকালীন র‌্যাব কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন আহম্মদের দাখিল করা অভিযোগপত্রভুক্ত। সম্পূরক অভিযোগপত্রে যে ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে তাদের খালাস দিয়েছেন আদালত।

আদালতের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে পিবিআইয়ের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিনের বক্তব্য জানতে পেরেছে সারাবাংলা। তিনি বলেন, ‘পতেঙ্গা থানার ইন্সপেক্টর মাত্র সপ্তাহখানেক তদন্ত করেছিলেন। এরপর র‌্যাব নিজেরাই তদন্তভার নেয়। মূল তদন্ত তারাই করে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। আদালত শুধুমাত্র এজাহারে নাম উল্লেখ থাকা ছয়জন আসামি, যাদের র‌্যাব বাদ দিয়েছে, তাদের বিষয়ে তদন্ত করার জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই মোতাবেক তদন্ত করে আমি ছয়জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করি। মালিক নির্ধারণের কোনো বিষয় আদেশে ছিল না। কারণ মালিকের বিষয়টি র‌্যাবের তদন্তেই উল্লেখ ছিল।’

ছয় আসামির খালাস পাওয়া প্রসঙ্গে মঈন উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এরা সবাই মাঝিমাল্লা ছিল। যেহেতু ইয়াবা উদ্ধারের সময় তারাও ট্রলারে ছিল, তাদের হেফাজত বা দখল থেকে যেহেতু ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে, আমি তাদের আসামি করেছিলাম। কিন্তু আদালত যেহেতু তাদের নির্দোষ মনে করেছেন, তাদের খালাস দিয়েছেন। এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’

সারাাবংলা/আরডি/এনএস

চট্টগ্রাম সর্ববৃহৎ ইয়াবা চালান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর