রাজ্জাক ভাই হঠাৎ বঙ্গবন্ধু হতে চেয়েছিলেন: মোশাররফ
১৫ ডিসেম্বর ২০২২ ১৯:৫৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্মরণসভায় এসে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাকের কঠোর সমালোচনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আব্দুর রাজ্জাক হঠাৎ ‘বঙ্গবন্ধু’ হতে চেয়েছিলেন- এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘রাজ্জাক ভাইয়ের কূটকৌশল মোকাবিলায় এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।’
বৃহস্পতিবার (১৫ ডিসেম্বর) সকালে নগরীর কাজির দেউড়ির ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে এ স্মরণসভার আয়োজন করে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ।
এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বর্ষীয়ান রাজনীতিক মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘১৯৭৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসক জিয়া যখন ক্ষমতায়, তখন একটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছিল। আমাদের আবদুর রাজ্জাক ভাই, সেদিন হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধু হতে চেয়েছিলেন। তিনি ইচ্ছেমতো তার মাইম্যানদের নমিনেশন দিয়েছিলেন। তখন মহিউদ্দিন চৌধুরী ফেরারি ছিলেন। গভীর রাতে আমার বাসায় আসতেন। দলের অবস্থা ও রাজ্জাক ভাইয়ের কূটকৌশল নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা করতাম।’
সেই কঠিন সময়ে মহিউদ্দিনের ভূমিকার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘মহিউদ্দিন ভাই সেসময় এমন কিছু সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, যেগুলো কাজে এসেছিল। বঙ্গবন্ধুকে যারা ভালোবাসতেন, তারা যেন নমিনেশন পান, সেজন্য আমাকে উদ্যোগী হতে বলেছিলেন। আমাকে ঢাকায় গিয়ে রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে কী করতে হবে সে ব্যাপারেও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।’
‘তিনি এ’ও বলেছিলেন, আমি যাদের পছন্দ করি তাদের নিয়ে ঢাকায় যেতে। আমি মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বলেছিলাম- আমার সঙ্গে যারা ঢাকায় যাবে, তাদের রাজ্জাক ভাই নমিনেশন দেবেন না। মহিউদ্দিন ভাই বলেছিলেন- হাল ছাড়বেন না। আমি হাল ছাড়িনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, চট্টগ্রামে ২৩টি আসনের একটিতেও আওয়ামী লীগ জিততে পারেনি। এমনকি মীরসরাইতে আমার পরিবর্তে যাকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছিল, ওই ব্যক্তিকে আমি যথেষ্ট সাহায্য সহযোগিতা করার পরও তিনি জঘন্যভাবে ধরাশায়ী হয়েছিলেন।’
আব্দুর রাজ্জাক দলের অনেক ক্ষতি করেছেন মন্তব্য করে মোশাররফ বলেন, ‘আজ না বলে পারছি না, রাজ্জাক ভাই দলের অনেক ক্ষতি করেছেন। শেখ হাসিনা নির্বাসন শেষে দেশে ফিরে দলের হাল ধরলেন। সেসময়ও রাজ্জাক ভাই দলকে টুকরো করেছেন এবং আলাদা দল করেছেন। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে রাজ্জাক ভাইকে নমিনেশন দিয়েছিলেন। দল ক্ষমতায় গেলে রাজ্জাক ভাইকে পানিসম্পদ মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা প্রতিশোধ পরায়ণ ছিলেন না।’
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি বাকশালের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের পর তিনি ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে নিজের অনুসারীদের নিয়ে পৃথক রাজনৈতিক দল ‘বাকশাল’ গঠন করেন। ১৯৯১ সালে বাকশাল বিলুপ্ত করে আবার দলে ফেরেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি পানিসম্পদ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
২০০৭-০৮ সালে জরুরি অবস্থায় দলের ভেতর সংস্কার প্রস্তাব তুলে সমালোচিত হন আব্দুর রাজ্জাক। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভায় তিনি ঠাঁই পাননি। ২০১১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বর্ষীয়ান এই রাজনীতিকের জীবনাবসান হয়।
স্মরণসভায় এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সন্তান শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘বাবা আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে অন্তরে ধারণ করেছেন। পিতাকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। আজ আমরা একটি কঠিন সময়ের মুখোমুখি। বিদেশি লবিস্ট নিয়োগ করে নানামুখী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কিভাবে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টা করছে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি বিএনপি-জামায়াত। এই চক্রান্ত রুখতে হলে নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে সাংগঠনিক ভিত্তি সুদৃঢ় করে জনগণের মাঝে যেতে হবে।’
নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দীন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান মাহমুদ হাসনীর সঞ্চালনায় স্মরণসভায় আরও বক্তব্য রাখেন- সহ-সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, খোরশেদ আলম সুজন, জহিরুল আলম দোভাষ, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আইন সম্পাদক শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, সদস্য বখতিয়ার উদ্দীন খান এবং মহিউদ্দিনের ছোট ছেলে বোরহানুল হাসান চৌধুরী সালেহীন।
এদিকে দিনভর ফুলেল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে স্মরণ করেছে বীর চট্টলা। সকালে নগরীর চশমাহিলে মহিউদ্দিনের কবরে নগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি নানা শ্রেণিপেশার মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে যান প্রয়াত নেতার কবরে। এসময় ফুলে ফুলে ঢেকে যায় কবর। দিনভর মানুষের আনাগোণা ছিল চশমাহিলে মহিউদ্দিনের বাসভবনে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী টানা ১৭ বছর দায়িত্ব পালন করা সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এসময় মেয়র রেজাউল বলেন, ‘যে কোনো রাজনৈতিক নেতা জনগণের চাহিদা কী সেটা বুঝতে পারলে তিনিই হয়ে ওঠেন প্রকৃত জননেতা। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী জনগণের আস্থা অর্জন করেছিলেন বলেই তার মৃত্যুর পরও চট্টগ্রামের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তিন বার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। মেয়র মহিউদ্দিনের কর্মকাণ্ডকে অনুসরণ করতে পারলে চসিকের ভাবমূর্তি সবসময় উজ্জ্বল থাকবে।’
এসময় উপস্থিত ছিলেন, প্যানেল মেয়র গিয়াস উদ্দিন, কাউন্সিলর আবদুস সালাম মাসুম, আবুল হাসনাত মো. বেলাল, শফিউল আজিম, আবদুল মান্নান, শেখ জাফরুল হায়দার চৌধুরী, নুরুল আলম, কাজী নূরুল আমিন এবং চসিক মেয়রের একান্ত সচিব মুহাম্মদ আবুল হাসেম।
প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি
প্রতিষ্ঠাতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সকালে তার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. অনুপম সেন, উপ-উপাচার্য কাজী শামীম সুলতানা, ট্রেজারার একেএম তফজল হক, কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন মোহীত উল আলম, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শেখ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, রেজিস্ট্রার খুরশিদুর রহমান।
এসময় অনুপম সেন বলেন, ‘চট্টগ্রামকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন। চট্টগ্রামের উন্নয়নে তার ভূমিকা ছিল বিরাট। বিশেষভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে তার অবদান বিশাল। তিনি প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ পর্যায়ে পঞ্চাশটিরও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। চট্টগ্রামে উচ্চশিক্ষার প্রসারের জন্য প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও স্বার্থরক্ষার জন্য তার আপসহীন ও সাহসী ভূমিকা তাকে চট্টলবীরে পরিণত করে।’
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা পরিষদ
প্রতিষ্ঠাতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্মরণসভা করেছে ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা পরিষদ’। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নগরীর জিমনেশিয়াম প্রাঙ্গনে বিজয় মঞ্চে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ, বিজয়মেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, আওয়ামী লীগ নেতা খোরশেদ আলম সুজন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন নিজামী, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবু সুফিয়ান, সাবেক যুবলীগ নেতা মহিউদ্দিন বাচ্চু, হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এম আর আজিম, আরশেদুল আলম বাচ্চু ও নুরুল আজিম রনি।
নাগরিক উদ্যেগ
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন ‘নাগরিক উদ্যোগের’ ব্যানারে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
এসময় সুজন বলেন, ‘মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামবাসীর স্বার্থে কোনোদিন পিছপা হননি। চট্টগ্রামের স্বার্থবিরোধী কিছু হলে প্রথমেই গর্জে উঠতেন তিনি। চট্টলাবাসীর হৃদয়ের মণিকোঠায় অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।’
এসময় নাগরিক উদ্যোগের সংগঠক মো. ইলিয়াছ, শাহাব উদ্দিন, মোহাম্মদ হোসেন, মো. শাহজাহান ছিলেন।
ছাত্রলীগ
এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি ধর্মীয় বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা পালন করেছে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ। এসময় নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর, শফিকুল ইসলাম পারভেজ, রেজাউল করিম রিটন, এম হাসান আলী, সৈয়দ আনিসুর রহমান, শরফুল আনাম জুয়েল, তোফায়েল আহমেদ মামুন, হাবিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিমেল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়
চট্টগ্রাম ভেটোরিনারি এন্ড অ্যানিমেল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ড. মো. কামালের নেতৃত্বে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সিভাসু শিক্ষক সমিতি, প্রগতিশীল শিক্ষক ফোরাম এবং অফিসার সমিতির পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়।
২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকা অবস্থায় জীবনাবসান হয় এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর।
সারাবাংলা/আইসি/আরডি/এনএস
আওয়ামী লীগ ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম