বিদেশি বৈমানিক নিয়োগ দিতেই কি বিমানের ‘বিজ্ঞপ্তি’?
১৫ ডিসেম্বর ২০২২ ২২:২১
ঢাকা: সম্প্রতি বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ৭৮৭ উড়োজাহাজের জন্য ক্যাপ্টেন এবং ফার্স্ট অফিসার পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বাংলাদেশ বিমান। কিন্তু বিজ্ঞপ্তিতে যে শর্ত দেওয়া হয়েছে তাতে বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের-ই আবেদন করার যোগ্যতা নেই। ফলে বিজ্ঞপ্তিতে সুক্ষ্ম কারচুপির গন্ধ পাচ্ছেন অনেকেই। এই পদে নিয়োগ পেতে আগ্রহীরা বলছেন, বাংলাদেশ বিমান যেন বিদেশি বৈমানিকদের নিতেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে! কারণ, বোয়িং ৭৮৭ উড়োজাহাজ একমাত্র বাংলাদেশ বিমান ছাড়া অন্য কোনো সংস্থার নেই। তাই অন্য কোনো বিমান সংস্থার ক্যাপেন্ট বা ফার্স্ট অফিসার এসব পদে আবেদন করার যোগ্যতা রাখেন না।
যদিও বাংলাদেশ বিমানের দেওয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ক্যাপ্টেন পদে বাংলাদেশের নাগরিক ও বিদেশি নাগরিকরা আবেদন করতে পারবেন। আবেদনকারী বৈমানিককে অবশ্যই বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন, আইকাউ, ইয়াসা, আমেরিকা এটিপিএল লাইসেন্স থাকতে হবে। যেখানে ক্যাপ্টেন হিসেবে উড্ডয়ন অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে- ৭৮৭ উড়োজাহাজে ৮ হাজার ঘণ্টা। এছাড়া পিআইসি (পাইলট ইন কমান্ড) অভিজ্ঞতা কমপক্ষে ৩ হাজার ঘণ্টা এবং পিআইসি অন টাইপ (বোয়িং ৭৮৭ বিমানের ক্যাপ্টের হিসেবে) অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে কমপক্ষে ১ হাজার ঘণ্টা।
এছাড়া, ফার্স্ট অফিসার হিসেবে উড্ডয়ন অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে ৪ হাজার ঘণ্টা, পি-২ অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে কমপক্ষে ৩ হাজার ঘণ্টা এবং পি-২ অন টাইপ অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে কমপক্ষে ৫০০ঘণ্টা। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ৬২ বছরের নিচে যেকোনো বৈমানিক আবেদন করতে পারবেন। ফলে প্রশ্ন হচ্ছে উঠেছে- যেখানে বাংলাদেশ বিমান ছাড়া অন্য কোনো সংস্থার বোয়িং ৭৮৭ উড়োজাহাজ নেই, সেখানে বাংলাদেশি নাগরিকরা এই অভিজ্ঞতা কোথায় পাবেন?
জানা গেছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো যেমন- কাতার এয়ারওয়েজ, এমিরেটস, সৌদিয়া, ওমান এয়ারওয়েজ, টার্কিস এয়ারলাইন্স তাদের দেশীয় বৈমানিকদের জন্য আবেদন করার জন্য যে যোগ্যতা চায় সেই যোগ্যতাগুলোও বাংলাদেশ বিমানের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে রাখা হয়নি। ফলে বাংলাদেশি কোনো বৈমানিক আবেদন-ই করতে পারবেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশিদের চেয়ে বাংলাদেশি বৈমানিক নিয়োগ দিয়ে বিমান ভালো সেবা পেত। সেইসঙ্গে মাসিক ব্যয় বহুলাংশে কমাতে পারত। কিন্তু সম্প্রতি যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে তাতে বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের এই সময়ে প্রচুর অর্থ বিদেশে চলে যাবে। বিমানের এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাংলাদেশি বৈমানিকদের বঞ্চিত করেছে।
বিমানের পাইলট নিয়োগের নীতিমালায় বলা আছে, অভিজ্ঞ বৈমানিকের ক্ষেত্রে যোগ্যতা কী হবে। ওএম পার্ট এ-র প্যারা ২.১.৪.৭.৪ (বি) তে বলা আছে, এটিপিএল লাইসেন্স সিভিল এভিয়েশন অথিরিটি থেকে ইস্যুকৃত হতে হবে, কোনো দুর্ঘটনা থাকা যাবে না শেষ ৫ বছরে, ক্লাস-১ মেডিক্যাল- যা সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অনুমোদিত মেডিকেল ও চিকিৎসক হতে হবে।
এছাড়া স্বদেশি বৈমানিকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন তথ্য এবং পরিবর্তনে ওএমএ প্যারা ২.১.৪.৭.৭-এ উল্লেখ করা আছে। বিমানের নিজস্ব বৈমানিকদের ৭৮৭ বা ৭৭৭ এর ক্যাপ্টেন পদের জন্য যোগ্যতা অপারেশনাল ম্যানুয়াল পার্ট-ডি এর ৩.৪.১-এ উল্লেখ করা আছে। যেখানে বলা হয়েছে, সর্বনিম্ন ৬ হাজার ঘণ্টা উড্ডয়নের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে এবং ড্যাশ-৮ বা সমকক্ষীয় বিমানের ৫০০ ঘণ্টা ক্যাপ্টেন হিসেবে উড্ডয়নের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। যার ওপর ভিত্তি করে সর্বশেষ বোয়িং ৭৭৭ বিমানের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় বাংলাদেশ বিমান।
অপরদিকে, ফার্স্ট অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে বলা আছে, বোয়িং ৭৭৭ বা ৭৮৭ এর ফার্স্ট অফিসারদের ক্ষেত্রে যোগ্যতা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন থেকে ইস্যুকৃত কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স থাকতে হবে। সর্বনিম্ন এক হাজার ঘণ্টা উড্ডয়ন অভিজ্ঞতা থাকতে হবে এবং ৭৫০ ঘণ্টা ড্যাশ ৮ বা সমকক্ষীয় এয়ারক্রাফটে উড্ডয়ন অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সেইসঙ্গে এটিপিএল-এ সব বিষয়ে পাস থাকতে হবে। আর এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ বিমান কিছু বৈমানিককে নিয়োগও দিয়েছে এর আগে।
তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ বিমানের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এমনভাবে দেওয়া হয়েছে যাতে কোনো বাংলাদেশি অভিজ্ঞ বৈমানিক কোনো বিমান সংস্থা থেকে আবেদন করতে না পারে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির প্যারা রোমান সংখ্যা-৩ এর ক্যাপ্টেন (সি) প্যারাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ১ হাজার ঘণ্টা বোয়িং ৭৮৭ বিমানে পিআইসি (পাইলট ইন কমান্ড থাকতে হবে) এবং ফার্স্ট অফিসারের ক্ষেত্রে ৫০০ ঘণ্টা ৭৮৭ বিমানে উড্ডয়ন অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আবেদনে সবোর্চ্চ বয়স সীমা দেওয়া হয়েছে ৬২ বছর (ক্যাপ্টেন এর জন্য)।
সারাবাংলার অনুসন্ধান বলছে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ইতোমধ্যে ১৩ জন বিদেশি বৈমানিক আবেদন করেছেন। এই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কোনো বিদেশি ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পেলে তাকে মাসিক বেতন ও খরচ ট্যাক্সসহ প্রায় ২৭ হাজার ডলার বা ২৭ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ১০০ করে) এবং ফার্স্ট অফিসারকে প্রায় ১৮ হাজার ডলার বা ১৮ লাখ টাকা দিতে হবে। সেখানে বাংলাদেশি একজন ক্যাপ্টেনের বেতন সব মিলিয়ে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আর একজন ফার্স্ট অফিসার মাসিক বেতন পান সব মিলিয়ে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা।
সারাবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলোতে পদোন্নতির জন্য এক পদে কমপক্ষে তিন বছর কাজ করতে হয়। এতে বৈমানিকরা যেমন অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তেমনি বিমান সংস্থাগুলো তাদের প্রশিক্ষণের জন্য যে টাকা ব্যয় করে তা উঠে আসে। কিন্তু বাংলাদেশ বিমানে অনভিজ্ঞদের দ্রুত পদোন্নতি দেওয়ার কারণে নানা দুর্ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি বাড়ছে প্রশিক্ষণ ব্যয়ও। সেইসঙ্গে প্রশিক্ষণে বার বার অকৃতকার্যও হচ্ছেন বৈমানিকরা।
এছাড়া অনিরাপদভাবে বিমান পরিচালনার অভিযোগ পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে। কিছুদিন আগে দোহা বিমানবন্দরে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার তদন্তে প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে- বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেনদের নিম্নমানের প্রশিক্ষণ আর ফার্স্ট অফিসারের স্বল্প অভিজ্ঞতা। শুধু তাই নয়, বিদেশি বৈমানিক নিয়োগে দুর্নীতি বাণিজ্যে কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত বলেও জানা গেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও শফিউল আজিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি মাত্র কয়েকদিন হলো বিমানে জয়েন করেছি। বিষয়টি সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত নই। তবে যেহেতু জানলাম এ বিষয়ে তদন্ত করব। এই নিয়োগে যদি কোনো ধরনের অনিয়মের সম্ভাবনা থাকে, কিংবা বাংলাদেশি নাগরিকদের বঞ্চিত করা হয়, তাহলে এর সঙ্গে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই। এটা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করবে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যদি অনিয়ম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে তা বাতিল করা হবে।’
সারাবাংলা/এসজে/পিটিএম