Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জাপানি মায়ের আবেগঘন চিঠি, আদালতে মিমাংসা চান বাবা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৬ ডিসেম্বর ২০২২ ২৩:৪৬

ফাইল ছবি: আদালতে ২ শিশু

ঢাকা: জাপানি দুই শিশুর বিষয়ে পারিবারিক আদালতে মিমাংসা চান শিশুদের বাবা ইমরান শরীফ। আর বাংলাদেশে দীর্ঘদিন অবস্থান করে দুই মেয়েকে ফিরে পেতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া জাপানি মা নাকানো এরিকো এক আবেগঘন চিঠি লিখেছেন।

সোমবার (২৬ ডিসেম্বর) হাইকোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে শিশুদের বাবা ইমরান শরীফ আদালতের মাধ্যমে ফয়সালার দাবি জানান।

মায়ের কাছ থেকে এক মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছেন এমন অভিযোগ সম্পর্কে ইমরান শরীফ বলেন ‘আমি আমার মেয়েকে নিয়ে আসিনি, সে আমার কাছে আশ্রয় চেয়েছে। মেয়েকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়ার আগে বলা হয়নি যে, দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া হচ্ছে। তখন সে শকড হয়ে গিয়েছিল। মেয়ে আমাকে এসব কথা বলেছে।’

তিনি বলেন, ‘গত ২৩ ডিসেম্বর রাতে আমাকে যখন জানানো হলো, দুই মেয়েকে নিয়ে উনি (নাকানো এরিকো) দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন, তখন আমি মোহাম্মদপুর থেকে মাত্র ১৫ মিনিট বাইকে করে এয়ারপোর্টে গিয়েছি। আমার মেয়ে আমাকে দেখে দৌড়ে আমার কাছে চলে এসেছে। তখন মেয়ে বলেছে, আমাকে বাসায় নিয়ে যাও। আমার মেয়ে আমার কাছে আশ্রয়ের জন্য এসেছে। আমি কীভাবে না বলি। আমি কীভাবে তাকে ফিরিয়ে দিই।’

তিনি আরও বলেন, ‘নাকানো এরিকো দেশ ছেড়ে চলে যাবেন এ বিষয়ে আমাকে কিছুই জানায়নি। চার মাস আগে আমার দুই মেয়ের কাছ থেকে জোর করে সই নিয়ে নতুন পাসপোর্ট বানিয়েছেন নাকানো। এ বিষয়ে আমাদের সর্বোচ্চ আদালত ও পারিবারিক আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে যে, শিশুদের নিয়ে বিদেশ যেতে পারবে না। নতুন পাসপোর্ট করে আদালতকে তা না জানিয়ে বিদেশ যাওয়ার ব্যর্থ পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি।’

বিজ্ঞাপন

ইমরান শরীফ আরও অভিযোগ করেন, ‘আমার দুই বাচ্চাকে বেগুনি রঙের ক্যাপ পরিয়ে উনি নিজে মেকআপ করে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলেন। উনার (নাকানো এরিকো) উদ্দেশ্য একটাই, আমাকে নিঃসন্তান করে উনি যেভাবেই হোক না কেন বিদেশে চলে যাবেন।’

এর আগে, গত ১ ডিসেম্বর আমার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পারিবারিক আদালত আমাকে শিশুদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য প্রতিদিন দুই ঘণ্টার জন্য অনুমতি দেন। এরপর হঠাৎ একদিন তিনি হারিয়ে গেলেন। উনি গায়ের হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না যে, তিনি চলে যাবেন। আমিতো ভেবেছিলাম পরদিন তাদের গিয়ে দেখতে পারব। রাতে ফোন পেলাম তারা এয়ারপোর্টৈ বসে আছেন। বিদেশ চলে যাবেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমিতো ভুক্তভোগী বাবা। বাচ্চাদের মঙ্গলের জন্য আমি বার বার মিমাংসার আহ্বান জানিয়েছি।’ এ বিষয়ে কী সমাধান চান, জানতে চাইলে ইমরান শরীফ বলেন, ‘সমাধান খুবই সাধারণ, উনি (নাকানো এরিকো) যেন আমাকে বাচ্চাদের জীবন থেকে মুছে না দেন। উনি যদি সেই কথা দেন তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু উনি যে বাচ্চাদের জীবন থেকে আমাকে মুছে দিতে চান, তার প্রমাণ হলো আমার ছোট মেয়েটি জাপানে আছে। গত দেড় বছরে বাচ্চাটির সঙ্গে একদিনও আমাকে কথা বলতে দেয়নি।’

এ সময় কাঁদতে কাঁদতে ইমরান শরীফ বলেন, ‘আমি জানি না, আমার ছোট মেয়েটি কোথায় আছে? আমিতো বাবা। আমার বাচ্চা কোথায় আছে তা আমি জানি না!’ তিনি বলেন, ‘আমার বড় দুই মেয়ের জীবন থেকে আমাকে মুছে দিতে চেষ্টা করা হয়েছে। আমি দুই মেয়েকে ছিনতাই করেছি; এটা উনি কিভাবে বলেন?’

দুই শিশুকে বিদেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশি দু’জন ব্যক্তি নাকানো এরিকোকে সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ করেন ইমরান শরীফ। তিনি বলেন, ‘আমার চাওয়া হচ্ছে, পারিবারিক আদালতে এটা যেন তাড়াতাড়ি মিমাংসা করা হয়।’

বিজ্ঞাপন

এ সময় ইমরান শরীফের আইনজীবী মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘দুই শিশুকে নিয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা করা- এটা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট অবমাননা। আদেশের অবমাননা। আদেশে বলা আছে, আদালতের অনুমতি ছাড়া বাচ্চাদের নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়া যাবে না।’

এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘এখন উচ্চ আদালতে অবকাশ চলছে। আর এই মামলা যেহেতু পারিবারিক আদালতে চলছে। এটি পারিবারিক আদালতের দৃষ্টিতে আনব এবং তারপর প্রয়োজন হলে উচ্চ আদালতেকে তা অবহিত করা হবে।’

আইনজীবী মোস্তাক আহমেদ আরও বলেন, ‘বর্তমানে ঢাকার পারিবারিক আদালতে মামলাটির শুনানি চলছে। শুনানি শেষে রায় হবে। পারিবারিক আদালতেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে। আদালতে যে আদেশ দেবেন আমরা তা মেনে নেব।’

আরও পড়ুন:

এর আগে, জাপানি মা নাকানো এরিকো, দুই মেয়েকে ফিরে পেতে এদেশে অবস্থান করে আইনি লড়াই করাসহ নানা প্রসঙ্গে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। সোমবার (২৬ ডিসেম্বর) নাকানো এরিকোর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরের মাধ্যমে পাঠানো ওই চিঠি সংবাদ কর্মীদের হাতে এসেছে।

নাকানো এরিকো আবেগঘন চিঠি

আমি এরিকো নাকানো, একজন অসহায় জাপানি মা; এখানে কঠিন সময়ের মুখোমুখি। আজ আমার অবস্থা নিম্নরূপ-

ইমরান শরীফ ২৩ ডিসেম্বর রাতে আমার ছোট মেয়েকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। আমি তার হদিস জানি না। বার বার ই-মেইল করেও জবাব পাচ্ছি না।

আমার মা ৭৬ বছর বয়সী এবং তিনি তীব্র শ্বাসযন্ত্রের রোগে ভুগছেন। সম্প্রতি তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে এবং তিনি কাগাঅ রোসাই হসপিটালে (Kagaw Rosai Hospital) চিকিৎসারত আছেন। তিনি অধীর আগ্রহে শেষবারের মতো আমার এবং নাতনিদের সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমার মায়ের অসুস্থতার কারণে আমার তৃতীয় মেয়ে সোনিয়া কার্যত একা এবং সে আমার জন্য প্রতিনিয়ত কাঁদছে।

এখন সুপ্রিম কোর্ট এবং পারিবারিক আদালত ছুটিতে রয়েছে এবং পারিবারিক মামলার পরবর্তী তারিখ আগামী ১১ জানুয়ারি তাই আমি মৌখিকভাবে ইমরান শরীফের সাথে শেয়ার করেছি যে, আমি এই ছুটিতে অল্প সময়ের জন্য মেয়েদের সাথে জাপান যেতে চাই এবং আগামী ১০ জানুয়ারি তারিখের মধ্যে ফিরে আসতে চাই।

উল্লেখ্য যে, ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট পারিবারিক আদালতকে ৩ (তিন) মাসের মধ্যে মামলাটি শেষ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু ইমরান বিলম্ব করছে এবং এটি প্রায় এক বছর হয়ে গেছে এবং এখনও বিচার চলছে। তাই আমার মা এবং তৃতীয় মেয়ে সোনিয়ার সাথে দেখা করা আমার জন্য অত্যাসন্ন। এখানে আমার অবর্তমানে মেয়েদের দেখাশোনার জন্য আমার কেউ নেই। এমতাবস্থায় তাদের সাথে নিয়ে আমার মুমূর্ষু মাকে দেখতে যেতে চেয়েছিলাম।

অধিকন্তু, ইমরান আমার ব্যক্তিগত জীবন সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করার জন্য বেশকিছু গুপ্তচর/গোয়েন্দা নিযুক্ত করেছে। এমনকি আমরা কাছাকাছি শপিং মলেও যেতে পারি না। বিষয়টি আমি থানা ও পারিবারিক আদালতকে জানালেও তারা কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করেনি।

ইমরান আমার ড্রাইভার, অনুবাদক, বন্ধু এবং আইনজীবীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা/অভিযোগ দায়ের করেছে। এমনকি সে আমার বাসার রিয়েল এস্টেট ম্যানেজারকে হুমকি দিয়েছে।

ইমরান মেয়েকে আদালত কর্তৃক নির্ধারিত সময় ও স্থানের বাইরে নিয়ে গিয়ে ক্রমাগত আদালতের আদেশ অমান্য করেছে। এমনকি বেশ কয়েকবার আমাকে প্রকাশ্যে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও করেছে।

ভিসা কর্তৃপক্ষ আমাকে সহযোগিতা করেনি। তারা মূলত আমার ভিসা প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করে এবং অপ্রয়োজনে বিভিন্ন প্রমাণপত্র দেখতে চায়।

পরিশেষে এখানে জীবন দুর্বিষহ। আমি বাংলাদেশে এখন বন্দি জীবনযাপন করছি। আমি আমার চাকরি হারিয়েছি এবং মাকে হারাতে যাচ্ছি। মাকে দেখতে কেউ আমাকে সহযোগিতা করছে না। বাকিটা আপনাদের বিবেকের ওপর ছেড়ে দিলাম।

এদিকে, আইনজীবী শিশির মনির সংবাদকর্মীদের কাছে ইমরান-নাকানো দম্পতির বড় মেয়ের একটি চিঠি সরবরাহ করেছেন। ওই চিঠিতে বড় মেয়ে বলেছে

আমি জাপানে ফিরে যেতে চাই; যেখানে আমি এখানে আসার আগে জীবনযাপন করেছি। আমার ছোট বোন সেখানে আছে। সেখানে আমার অসুস্থ নানি শয্যাশায়ী অবস্থায় আছেন। আমি আমার নানিকে মারা যাওয়ার আগে দেখতে চাই। আর আমার এখানে স্থিতিশীল শিক্ষা জীবন নেই। আমি জাপানে যে আমেরিকান স্কুলে যেতাম ওই স্কুলের শিক্ষার মান অনেক ভালো। আমি আমার সব বোনের সাথে বড় হতে চাই। আমি তাদের ছেড়ে যেতে চাই না। আমি জাপানে ফিরে যেতে চাই; যেখানে আমার বাড়ি। আমাদের সাহায্য করুন। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।

তবে আজকের সংবাদ সম্মেলনে ওই চিঠি ইমরান শরীফকে দেখিয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই চিঠির লেখা আমার মেয়ের নয়, এটি মেয়ের মায়ের (নাকানো এরিকোর) হাতের লেখা।’

এর আগে, গত ২৪ ডিসেম্বর (শুক্রবার) দুই সন্তান নিয়ে ঢাকা ছাড়ার চেষ্টা করেন। তবে ইমিগ্রেশন পুলিশ জাপানি নারী নাকানো এরিকোসহ তিনজনকেই হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেয়।

২৪ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১২টার দিকে বিমানবন্দর থেকে তাদের ফেরানো হয়। আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

২০০৮ সালের ১১ জুলাই জাপানের নাকানো এরিকো ও বাংলাদেশি আমেরিকান ইমরান শরীফ জাপানি আইন অনুযায়ী বিয়ে করেন। বিয়ের পর তারা টোকিওতে বসবাস শুরু করেন। ১২ বছরের সংসারে তারা তিন কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে বড় দুই মেয়ে ঢাকায় রয়েছে। আর ছোট মেয়ে জাপানে তাদের নানির কাছে আছে।

বড় দুই মেয়েকে নিয়ে ঢাকার আদালতে মামলা চলছে। এবং আদালতের অনুমতি ছাড়া তাদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

সারাবাংলা/কেআইএফ/পিটিএম

নাকানো এরিকো

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর