শীতের তীব্রতার সঙ্গে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ
৯ জানুয়ারি ২০২৩ ১১:৫৬
ঢাকা: রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জেঁকে বসেছে শীত। একদিকে দিনের উত্তাপ কমে আসা আর অন্যদিকে শীতের তীব্রতায় বিপর্যস্ত জনজীবন। এমন অবস্থায় শীতের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানা রোগ। শীতকালীন রোগ বলে পরিচিত সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি’র পাশাপাশি টনসিলাইটিস, ব্রঙ্কিওলাইটিস, সাইনোসাইটিসের রোগীদের চিকিৎসা দিতে বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যস্ততা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের।
সরেজমিনে রাজধানীর একাধিক হাসপাতালে দেখা যায়, শুধুমাত্র ঢাকা থেকেই নয় বরং দেশের অন্যান্য এলাকা থেকেও রোগীদের নিয়ে হাসপাতালে ছুটে আসছেন স্বজনরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিভিন্ন কারণে শীতকালীন বিভিন্ন রোগের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। আর এ জন্য জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে সচেতনতার অভাবকেও দায়ী করছেন তারা। আর এমন পরিস্থিতিতে শিশু ও বয়স্কদের জন্য আলাদা যত্ন নেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে আলাদা যত্ন নেওয়ার পরামর্শ তাদের। শীতের সঙ্গে অপুষ্টির কারণে শিশুরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকায় রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে নানাভাবে। আর তাই শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার পাশাপাশি শিশুদের পুষ্টির দিকেও নজর দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান কী বলছে?
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সর্বশেষ ৭ জানুয়ারি থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ঠান্ডাজনিত কারণে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এই ২৪ ঘণ্টায় দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছে ৯৪৯ জন।
দেশে চলতি শীত মৌসুমে ঠান্ডাজনিত নানা রোগের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা বেড়ে ৪৭ হাজার ৯৮২ জনে দাঁড়িয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় রোটাভাইরাসজনিত ডায়রিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার ২০৭ জন। এই নিয়ে গত বছরের ১৪ নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ডায়রিয়া রোগী তিন লাখ ২৪ হাজার ৮১৮ জনে পৌঁছেছে।
একইসঙ্গে গত ২৪ ঘণ্টায় ঠান্ডাজনিত রোগে মারা গেছেন আরও চারজন। এই নিয়ে গত প্রায় দুই মাসের ঠান্ডাজনিত রোগে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭৩ জনে ঠেকেছে। একই সময়ে ডায়রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে তিনজনের।
অধিদফতরের তথ্যমতে, ঠান্ডাজনিত রোগে হাসপাতালে ভর্তি রোগী সবচেয়ে বেশি ১৭ হাজার ৭১৯ জন চট্টগ্রামে। সবচেয়ে কম এক হাজার ৩৭৮ জন রংপুর বিভাগে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, ঢাকা শিশু হাসপাতালে আসা রোগীদের ৩০ শতাংশের বেশি নিউমোনিয়ার রোগী বলে জানিয়েছে। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরের শুরু থেকে শীতের প্রকোপ শুরু হলে রোগীর চাপ বাড়তে থাকে হাসপাতালটিতে। ওই মাসে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ৪৩৩ জন শিশুকে ভর্তি করা হয়। যা মোট রোগীর ৩০ শতাংশের বেশি। গত মাসে প্রতিষ্ঠানটিতে চিকিৎসাধীন শিশুদের মধ্যে ১৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে নিউমোনিয়ায় ৪৬ জন।
চলতি জানুয়ারির প্রথম সাত দিনে নিউমোনিয়ায় ভোগা ৮২ জন শিশুকে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ছয় শিশুর।
রাজধানীর তিন হাসপাতালের পরিস্থিতি
৫ জানুয়ারি রাজধানীর শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের অধিকাংশই শীতের ঠাণ্ডাজনিতে অসুখে আক্রান্ত। পাশেই থাকা শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালেও প্রায় একই অবস্থা। তবে এখানে তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধ বয়সী রোগীদের বেশি দেখা গেছে।
শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য টিকেট কাউন্টারের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন রশীদ ইসলাম ও তার স্ত্রী।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘পটুয়াখালী থেকে প্রথমে বাচ্চাকে রেফার্ড করা হয় বরিশাল মেডিকেল হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে শয্যা না পাওয়ায় এক আত্মীয়ের পরামর্শে বাচ্চাকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন।’
বাচ্চার শারীরিক সমস্যার কথা জানাতে গিয়ে রশীদ ইসলাম বলেন, ‘ওর জ্বর আসে কয়েকদিন আগে। এরমাঝে ওর মুখে দেখা যায় একধরণের ঘায়ের মতো। ফলে সে কিছুই খাচ্ছে না। আর কান্নাকাটি করতে থাকে যখন তখনই খিঁচুনির মতো হয়ে যায়। এমন অবস্থা গত কয়েকদিন আসলে ওর মাও ওকে কিছু খাওয়াতে পারে নাই।’
পাশেই থাকা মারজিয়া খাতুন নামে আরেক অভিভাবক টিকেট কাউন্টারে অপেক্ষা করছিলেন। রাজধানীর বসিলা থেকে মারজিয়া খাতুন এসেছেন তার দুই বছরের মেয়ে সোমাইয়াকে নিয়ে।
তিনি জানান, চার থেকে পাঁচ দিন ধরেই ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত ছিল সোমাইয়া। কাঁশি দিলেই বমি করতো আর তার পাশাপাশি গলায় কফ জমেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে গতকাল থেকে ডায়রিয়াও শুরু হয়েছে। আর তাই বাসায় না রেখে হাসপাতালে নিয়ে আসা।
শিশু হাসপাতালের অন্ত:বিভাগে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। এখানে ভর্তি বিভিন্ন রোগীর অভিভাবকরা তাদের সন্তানের সেবায় ব্যস্ত। তাদের চিকিৎসাসেবায় ব্যস্ত চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা।
প্রতিষ্ঠানটির বিশেষায়িত নিউমোনিয়া রিসার্চ সেন্টারে দেখা যায়, ১৬টি শয্যা থাকলেও তার কোনটাই খালি নেই। অন্যান্য কেবিন, ওয়ার্ড ও পেয়িং বেডের অধিকাংশতেই নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্তদের সংখ্যাই বেশি। এর পাশাপাশি ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুদেরও এখানে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
শুধুমাত্র শিশুদের নিউমোনিয়া চিকিৎসার জন্য আই হাসপাতালের সপ্তম তলার একটি বড় কক্ষকে আলাদাভাবে ওয়ার্ডে রূপান্তর করা হয়েছে। চালুর পর থেকে এখানে নভেম্বর থেকে কোনো বেড খালি ছিল না বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।
এই ইউনিটের দায়িত্বরত চিকিৎসক উম্মে নুসরাত আরা সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাসপাতালের সব ওয়ার্ডেই ঠান্ডাজনিত রোগী ভর্তি। সাধারণ সময়ের চেয়ে শীতে শিশুদের শ্বাসকষ্টসহ নিউমোনিয়ার মতো রোগ বেড়ে যায়। দিনে যত রোগী আসছে, এর বড় অংশই ঠান্ডাজনিত সমস্যা নিয়ে।’
একই অবস্থা সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও।
এই হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে জানা যায়, শিশু-রোগীর মাঝে অনেকেই আসছে যাদের মাঝে নিউমোনিয়ার পাশাপাশি ব্রনবিউলাইটিসে আক্রান্ত রোগীদেরও পাওয়া যাচ্ছে। ব্রনবিউলাইটিস রোগীরা ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে থাকে। এর সঙ্গে রয়েছে ডায়রিয়া, ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা, শ্বাসকষ্টের রোগী। তবে শিশুদের পাশাপাশি বৃদ্ধরাও আসছেন এখানে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমাসহ নানা রোগের চিকিৎসা নিতে।
৬ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) বহির্বিভাগ ও অন্তঃবিভাগের পরিস্থিতিও প্রায় একই। হাসপাতালের ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, মেঝেতেও রোগীদের ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আর বিভিন্ন বয়সসীমার এসব রোগীদের অধিকাংশই হাসপাতালে এসেছেন মূলত শীতকালীন নানা রোগের আক্রান্ত হয়ে। হাসপাতালের মেঝেতেও রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে দরিদ্র এই শিশুদের অভিভাবকরা জানায় তাদের সন্তানের কষ্টের কথা।
দেশের অন্যান্য স্থানের হাসপাতালে কী অবস্থা?
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দু’টি শিশু ওয়ার্ডে শয্যা ১৭৮টি হলেও বর্তমানে (৫ জানুয়ারি পর্যন্ত) সেখানে ৪৫৮ জন রোগী ভর্তি আছে। এসব রোগীর মাঝে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১৫টি শিশু ও নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে, যাদের বয়স ১৯ দিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে।
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে শয্যা সংখ্যা ৩৬টি। তবে এখানে ৬ জানুয়ারি চিকিৎসাধীন ছিল ১৩৪ শিশু। শয্যাসংখ্যার অতিরিক্ত রোগী হওয়ার মেঝেতে রেখেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
কী বলছে কর্তৃপক্ষ?
বরিশাল শের-ই-বাংলা হাসপাতালের সহকারি পরিচালক মনিরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি শয্যাসংখ্যা বাড়ানোর জন্য। কিন্তু রোগীর সংখ্যা তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। তবু আমরা কাজ করে যাচ্ছি যত বেশি সম্ভব রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য।’
রংপুর মেডিকেলের শিশু ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রার ডা. ফখরুল আলম বলেন, ‘হাসপাতালে শয্যার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি শিশু বর্তমানে ভর্তি আছে। শীতকালীন নানা রোগ নিয়ে আসা এসব রোগীর বেশির ভাগই গ্রাম থেকে আসা। এসব হতদরিদ্র পরিবারের সচেতনতার অভাব রয়েছে।’
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. নাজমুস সিহান সারাবাংলাকে বলেন, ‘শীতকালে শিশুদের ঠান্ডাবাহিত রোগ বৃদ্ধি পাওয়া হাসপাতালে বাড়ছে রোগির সংখ্যা। বিশেষ করে ডাইরিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি।’
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারি পরিচালক নিয়াজ মুস্তাফি চৌধুরী বলেন, ‘অন্যান্য বছরের মতো এবারও শীতের সময় অন্যান্য রোগীর তুলনায় ঠান্ডাজনিত রোগী বেড়েছে। অধিকাংশ শিশুর শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা, তবে ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশু রোগীও রয়েছে। এ ধরনের রোগীর বয়স দুই মাস থেকে ছয় মাসের মধ্যে। প্রতিদিনই ২৭০ থেকে ২৮০ জনের মতো শিশু রোগী ভর্তি হচ্ছে।’
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘প্রতি বছরই শীত আসা ও যাওয়ার সময় সর্দি, ঠান্ডা, কাশি ও জ্বর দেখা যায়। একইসঙ্গে হাঁপানি, গলাব্যথা বা টনসিলাইটিস ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাওয়ার জন্য।’
ঢামেকের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দু’গুণের বেশি রোগী ভর্তি আছেন হাসপাতালে। কারণ আমরা কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দিই না। কোনো কোনো ওয়ার্ডের শয্যায় তিনজন রোগীকে রেখেও আমরা চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছি। হাসপাতালে শয্যা খালি নেই বলে আমরা যদি রোগী ভর্তি বন্ধ করে চিকিৎসা না দিই তবে এই অসহায় রোগীগুলো কোথায় যাবে? তাই আমাদের শয্যা খালি না থাকলেও আমরা কোনো রোগীকে ফেরৎ পাঠাই না। প্রথম দিকে শয্যা পেতে রোগীদের একটু কষ্ট হলেও পরে তাদের ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হয়।’
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
শীতজনিত রোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে এম আর খান শিশু হাসপাতালের ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফরহাদ মনজুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘শীতের কারণে শিশু এবং বয়স্কদের নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা বেড়ে যায়। এ সময় রোগী বেড়ে যাওয়ায় তাদের সেবা দিতে চিকিৎসক-নার্সদের ওপর অনেক চাপ পড়ে। শীত, কুয়াশা, আবহাওয়ার পরিবর্তন, বায়ু দূষণসহ অসচেতনার ফলেই এসব রোগ বেড়ে যায়। এ সময় অবশ্যই সবাইকে মাস্ক পরে চলাচল করা উচিৎ। শিশুদের যাতে ঠান্ডা না লাগে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে বাবা-মায়েদের।’
শীতকালে রোগ বাড়ার কারণ বিষয়ে জানিয়ে শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘শীত মৌসুম আসা ও যাওয়ার সময় বেশ কিছু ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। এগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে। এছাড়া আমাদের দেশের বাতাসে প্রচুর ধূলিকণা থাকে। ধূলিকণার আশ্রয়ে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া বেঁচে থাকে। এটা শীতজনিত রোগের অন্যতম কারণ।’
ঢাকা শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ও সহকারী অধ্যাপক ডা. রিজওয়ানুল আহসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আসলে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শীতকালীন রোগের প্রার্দুভাব বেড়ে গিয়েছে। নিউমোনিয়া, ঠাণ্ডা-কাশি জ্বর নিয়ে শিশুরা বহির্বিভাগে বেশি আসছে। সেই সঙ্গে রয়েছে শীতকালীন ডায়রিয়া।’
তিনি বলেন, ‘শীতের আগে বহির্বিভাগে প্রতিদিন রোগীদের যে সংখ্যা হতো শীতের এই সময়টায়ে সে সংখ্যা সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে শিশুরা নিউমোনিয়া বা ডায়রিয়া আক্রান্ত। অ্যাজমা আক্রান্ত শিশুরাও আসছে। শীতে আবহাওয়া যেহেতু শুষ্ক এবং শহরে ধুলোর পরিমাণে বেড়ে যাওয়ার কারণে বাইরে বের হওয়া শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে অ্যাজমাতে।’
তিনি বলেন, ‘শীতকালীন ডায়রিয়া, ঠাণ্ডা-কাশিতে আক্রান্ত শিশুদের বেলায় বাবা-মাকে একটু বেশি সচেতন এবং সতর্ক থাকতে হবে। সকাল থেকে রাতে ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত শিশুদেরকে হালকা কুসুম গরম পানি খেতে দিতে হবে এবং প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাকসবজি খেতে হবে। সেই সঙ্গে খেতে হবে রঙিন ফল।’
ঠাণ্ডা-কাশি জ্বর হলে প্রচুর তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ডা. রিজওয়ানুল আহসান বলেন, ‘পাতলা আরামদায়ক পোশাক পরাতে হবে শিশুদের। আর নবজাতক শিশুদের বেলাতে আরও সতর্ক থাকতে হবে কারণ, সবদিক দিয়েই তারা খুব স্পর্শকাতর। ঠাণ্ডা যেন না লাগে, গরম কাপড় সব সময় গায়ে থাকাতে অনেক সময় শিশুরা ঘেমে যায় এবং সেই ঠাণ্ডাটাও কিন্তু নিউমোনিয়ার অন্যতম কারণ। তাই শিশুদের পোশাক হতে হবে নরম এবং ঢোলা জাতীয়।’
উষ্ণ আরামদায়ক কাপড় আর এ সময়ে শিশুদের মাস্ক পরতে হবে এবং ধুলো এড়িয়ে চলতে হবে, তাইলেই এ সময়ের রোগবালাই থেকে দূরে থাকা যাবে বলে মন্তব্য করেন ডা. রিজওয়ানুল আহসান।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শফি আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ শীতকালীন বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে আবহাওয়ার পরিবর্তন, বায়ুদূষণের কারণে শিশু ও বয়স্ক মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘শীতে শিশু ও বৃদ্ধদের অ্যাজমা, হাঁপানি, ব্রংকিওলাইটিস, নিউমোনিয়া থেকে বাঁচাতে পর্যাপ্ত গরম কাপড়সহ হাতমোজা, পা মোজা পরিয়ে রাখতে হবে। সব সময় কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। তারপরেও যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে, শ্বাসকষ্টে ঘুমাতে না পারে, বুক স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ওঠানামা করে তাহলে অবশ্যই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউর) বক্ষব্যাধি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, ‘আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে শীতকালীন রোগব্যাধি কিছুটা বাড়ে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ফুসফুসের রেজিস্ট্যান্স কম থাকে। এ কারণে শিশু ও বয়স্করাই শীতকালীন রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘শিশু ও বয়স্কদের আবার নিউমোনিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি বেশি। এ ছাড়া যাদের সিওপিডি, ব্রংকাইটিস, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ শ্বাসতন্ত্রের রোগ রয়েছে, তারাও শীতকালীন রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। যাদের ডায়বেটিস, হৃদরোগ ও কিডনি রোগ রয়েছে, তাদের ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। তারাও সর্দি, জ্বর ও কাশিসহ ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হন।’
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কম বয়সী শিশু ও বেশি বয়সী বৃদ্ধদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হয়ে থাকে। আর তাই তারা ঠান্ডাজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। তাই ঠান্ডাজনিত রোগগুলো যেন না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। প্রয়োজন মতো গরম কাপড় পড়া, তীব্র শীতের সময় কান-ঢাকা টুপি পরা এবং গলায় মাফলার ব্যবহার করা এবং ধুলাবালি এড়িয়ে চলতে হবে। আর শীতে সচরাচর কিছু রোগব্যাধি দেখা দেয় কিন্তু এর বাইরে কিছু রোগ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।’
সারাবাংলা/এসবি/ইআ