উন্নয়ন জয়যাত্রা অব্যাহত রাখতে ফের নৌকায় ভোট চাইলেন শেখ হাসিনা
২৯ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৩৯
ঢাকা: আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গত নির্বাচনে আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছেন। আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফের আহ্বান জানাব, আগামী নির্বাচনেও আপনারা সরকারের উন্নয়ন জয়যাত্রা অব্যাহত রাখতে নৌকা মার্কায় ভোট দিন। যাতে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে পারি।
রোববার (২৯ জানুয়ারি) বিকেলে রাজশাহীর মাদ্রাসা মাঠে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
জনসভায় ভাষণের আগে সরকারের ১৪ বছরে উন্নয়নে বদলে যাওয়া রাজশাহীবাসীর জন্য ২৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ছয়টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। উন্নয়ন কর্মসূচির উদ্বোধনের অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল। প্রায় ১১ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ৩২টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ৩৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা।
প্রকল্পগুলো উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন শেষে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা গত ১৪ বছরে ১০ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি উন্নয়ন অবকাঠামো তৈরি করেছি। একটু আগেই ১ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকার প্রকল্প উদ্বোধন করেছি। এর মধ্যে ২৬টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন এবং ছয়টির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন।’
দেশের মানুষসহ রাজশাহীর উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা জনগণের কল্যাণে কাজ করি। কিন্তু এই রাজশাহীর কি অবস্থা ছিল আপনারা একবার চিন্তা করে দেখেন? ২০০১ সালের কথা চিন্তা করে দেখেন। বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষমতার সময় প্রতিনিয়ত রাজশাহীতে খুন, হত্যা, সন্ত্রাস, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটতো। রাজশাহীর ফাহিমা, মহিমা আজুফা- কিভাবে তাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডারবাহিনী। একটা বাচ্চা মেয়েকে গ্যাং রেফ করা হলো। তার বাবা-মা নৌকায় ভোট দিয়েছে, সেই কারণে।’
তিনি বলেন, ‘আরে নৌকায় ভোট না দিলে দেশ স্বাধীন হতো না। দেশ স্বাধীন না হলে তোমাদের নেতা জিয়াউর রহমান মেজর থেকে মেজর জেনারেলে প্রমোশন পেত না। এটা তারা ভুলে যায়। আর দেশ স্বাধীন না হলে কোনোদিন ক্ষমতায়ও আসতে পারতো না খালেদা জিয়া। প্রধানমন্ত্রীও হতে পারত না। সেই নৌকার ওপর এত রাগ কেন? অথচ নৌকায় ভোট দিয়ে মানুষ আজ খাদ্যের নিশ্চয়তা পাচ্ছে, পরনের কাপড় পাচ্ছে, রোগে চিকিৎসা পাচ্ছে। বাড়ির পাশে কমিউনিটি ক্লিনিকে মা-বোনরা চিকিৎসা পাচ্ছে। বিনা পয়সায় ওষুধ পাচ্ছে। সেই ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ সরকার করে দিয়েছে।
অবকাঠামোগত উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ‘একই দিনে একশ সেতু, একই দিনে একশ সড়ক উদ্বোধন কোন সরকার করতে পেরেছে। কোনো সরকার পারেনি। আওয়ামী লীগ সরকার, নৌকা মার্কার সরকার করতে পেরেছে। আর কেউ করতে পারেনি।’ করোনাকালীন জনগণের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়েও তার সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। করোনা অতিমারি পরবর্তী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মানুষের কষ্ট লাঘবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও তুলে ধরেন তিনি।’
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ তার সরকারের মেয়াদে নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নসহ প্রতিটি উপজেলায় মডেল মসজিদ ও ইসলামিক কালচারাল সেন্টার নির্মাণের প্রসঙ্গও তুলে ধরেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোন সরকার করেছে? বিএনপির খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির এরশাদ- কেউ করেছে? কেউ করে নাই। করে শুধু আওয়ামী লীগ। আমরা ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় করে দিয়েছি। দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের মর্যাদা দিয়েছি। কারণ মাদরাসায় যারা পড়ে তারা অবহেলার পাত্র নয়। তারা ভালোভাবে পড়াশোনা যাতে করতে পারে সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তারা যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে সেই ব্যবস্থাটা আওয়ামী লীগ করে দিয়েছে।’
এ সময় তিনি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার জন্য প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় বড় জেলাগুলোতে মেডিকেল কলেজ, নার্সিং গ্রাজুয়েশন কোর্স চালু করার প্রসঙ্গও তুলে ধরেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা মানুষের জন্য কিছু করতে পারে না। তাদের কাজ খালি নিজেরা লুটেপুটে খাবে। যখন জিয়াউর রহমান মারা গেল, তখন দেখানো হলো কিচ্ছু রেখে যাই নাই। একটা ভাঙা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি ছাড়া। পরে দেখা গেল ভাঙা স্যুটকেস কোথায়? খালেদা জিয়ার মূল্যবান ফ্রেঞ্চ শিফন শাড়ি ফ্রান্স থেকে কিনে আনে। তারেক জিয়াদের কোকো-১, কোকো-২ লঞ্চ, ইন্ড্রাস্টি। এত টাকা চুরি করে বিদেশে পাচার করেছে যে, এখন বিদেশে আয়েশি জীবন যাপন করছে। আর আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি। সেই ডিজিটাল মাধ্যমে আমাদের গীবত গায়, আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায় আর মানুষকে উসকানি দেয়। এটাই তাদের কাজ। বাংলাদেশের মানুষের কোনো ভালো তারা সহ্য করতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত যত রকমের অপকর্ম, লুটপাট, সন্ত্রাস করতে পারে। বাংলা ভাই সৃষ্টি করে। যারা প্রকাশ্য দিবালোকে এই রাজশাহীতে ট্রাকে অস্ত্র হাতে মিছিল করে। আর পুলিশ তাদের পাহারা দেয়। এই তো খালেদা জিয়ার কারবার ছিল ২০০১ থেকে ২০০৬ বলে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপির দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, লুটপাট, সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচারের ফলে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা। তা না হলে এমার্জেন্সি হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য এটা হয়েছে।’
আওয়ামী লীগ সরকারে এলে মানুষের শান্তি থাকে, দেশের উন্নতি হয় দাবি করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা যে ওয়াদা দিই সেই ওয়াদা রক্ষা করি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বলেছিলাম, ২০২১ সালে রূপকল্প বাস্তবায়ন করব। আল্লাহর রহমতে তা করেছি। ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী আর ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী করে আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। আগামীতে বাংলাদেশকে আমরা আরও উন্নত করতে চাই।’
এক সময় রাজশাহীতে মানুষের কর্মসংস্থানের তেমন ব্যবস্থা ছিল না জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখানে শিল্পকারখানা হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করে দিচ্ছি। এখানকার মানুষের ভাগ্যের আরও উন্নয়ন হবে। রাজশাহীতে স্টেডিয়াম করে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হয় না। কারণ, এখানে কোনো উচ্চ মানের হোটেল নেই। অনেক বিত্তশালী আছেন রাজশাহীর। তাদের বলব, আপনারা একটা উন্নত মানের হোটেল করেন। আমরা যেন আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট এখানে আনতে পারি।’ রাজশাহী আমে ভরপুর। রাজশাহীর সিল্কের অনেক ঐতিহ্য ছিল তাই সেই ঐতিহ্যগুলো যেন আবার ফিরে আসে সে আশাবাদও করেন প্রধানমন্ত্রী।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আমরা চ্যালেঞ্জ দিয়ে পদ্মাসেতু নির্মাণ করেছি। এর আগে যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ করে দিয়েছিলাম। সমস্ত বাংলাদেশে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এসে গেছে। প্রত্যেকটা এয়ারপোর্ট চালু করে দিয়েছি। আমরা চাই আমাদের দেশ এগিয়ে যাক। দেশের উন্নতি হোক।’ প্রধানমন্ত্রী রাজশাহীর জনসভায় আসার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, ‘করোনার সময় আসতে পারিনি। আজ আপনাদের মাঝে এসে অত্যন্ত আনন্দিত। আপনারা ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। গত নির্বাচনে নৌকায় আপনারা ভোট দিয়েছেন। আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফের আহ্বান জানাব, আগামী নির্বাচন আসবে। এই বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতে। আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন কি না ওয়াদা চাই।’ এ সময় উপস্থিত জনতা হাত তুলে নৌকা নৌকা স্লোগানে ভোট দেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
প্রসঙ্গত, প্রায় পাঁচ বছর পর আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে উন্নয়নের বার্তা নিয়ে পদ্মা পাড়ে ভোট প্রার্থনায় আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তার আগে দুপুরে মাদ্রাসা মাঠের জনসভার শুরুতে পবিত্র কোরআন, গীতা, বাইবেল, ত্রিপিটক থেকে পাঠ করা হয়। এরপর দলের প্রয়াত নেতাদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে স্থানীয় নেতাদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ভাষণ পর্ব শুরু হয়। পরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর শেষে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে জনসভা মঞ্চে আসন গ্রহণের আগে হাত নেড়ে উপস্থিত জনতাকে অভিবাদন জানান প্রধানমন্ত্রী। জনসভাকে সফল করার লক্ষ্যে বিশেষ ট্রেন, বাস, মিনিবাসসহ বিভিন্ন যানবাহনে রাজশাহী বিভাগের আওতাধীন জেলাগুলো থেকে নেতাকর্মীরা জনসভায় এসে যোগ দেন।
রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ যৌথভাবে এই জনসভার আয়োজন করে। রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামালের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন, দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাতসহ স্থানীয় নেতারা। জনসভা পরিচালনা করেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ডাবলু সরকার ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ দারা।
সারাবাংলা/এনআর/পিটিএম