‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন প্রয়োজন’
৩১ জানুয়ারি ২০২৩ ২২:৫১
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ভূ-রাজনৈতিক খেলা থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অবিলম্বে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মোহাম্মদ শাহআলম।
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি’র ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে মঙ্গলবার (৩১ জানুয়ারি) বিকেলে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চত্বরে এক সমাবেশে সিপিবি সভাপতি এ আহ্বান জানান। চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নসহ পাঁচ দফা দাবিতে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ আয়োজিত এ সংহতি সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের ওর্য়ার্কাস পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
২৫ বছরেও চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে শাহআলম বলেন, ‘যে সরকার এই চুক্তি করেছে সেই সরকার আজ ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায়। তারা বাস্তবায়ন করছে না কেন? তাহলে সরকারের মধ্যে কি অন্য কোনো সরকার আছে ? তারা কি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়েও বড় ? না হলে কেন চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারছে না।’
অশান্তি জিইয়ে রাখলে বিদেশি শক্তি নানা খেলা খেলবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি জিওপলিটিক্সের এলাকা। রাঙ্গামাটির সঙ্গে ভারতের যেমন সীমানা আছে, মিয়ানমারেরও আছে। আবার ওদিকে রোহিঙ্গা এসেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত রাখলে যেকোনো সময় আগুন জ্বলতে পারে। এখানে অশান্তি রাখলে নানা বিদেশি শক্তি এদের নিয়ে খেলবে। যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা আছে। সরকারকে বলব, আগুন নিয়ে খেলবেন না।’
চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে আমেরিকার ‘খেলা আছে’- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে সিপিবি সভাপতি বলেন, ‘কোয়াডের সদস্য করতে বাংলাদেশকে আমেরিকা বারবার চাপ দিচ্ছে। আমেরিকা তো নানাভাবে খেলতে পারে। সরকারের মধ্যে যে সরকার আছে সেখানেও আমেরিকার সোর্স থাকতে পারে, যারা চুক্তি বাস্তবায়ন করতে দিচ্ছে না। এই ভূ-রাজনৈতিক খেলা থেকে বের হতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অবিলম্বে চুক্তি বাস্তবায়ন করা দরকার।’
পাহাড়িদের ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সিপিবি শান্তিচুক্তির পক্ষে ছিল। এখন চুক্তি বাস্তবায়নের পাঁচ দফার সঙ্গেও আছে। আপনারা চুক্তির সময় এক ছিলেন। এখন আপনাদের মধ্যে নানা বিভক্তি। হয়তো বাইরের শক্তি হাত ঢুকিয়েছে- সেজন্য এত বিভক্তি। রক্তক্ষয়ী অন্তর্ঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আপনাদের আবারও ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। পাহাড়ি-বাঙালি, পাহাড়ের মানুষ, সমতলের মানুষ সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করতে হবে। এছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ নেই।’
সভাপতির বক্তব্যে কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ায় জটিল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার বাস্তবায়নের লড়াইয়ের মধ্যে এখন জঙ্গিবাদের উদ্ভব দেখা যাচ্ছে। একটি অঞ্চলকে যদি আমরা অশান্ত রাখি, সেখানকার অধিবাসীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যদি আমরা বানচাল করে রাখি, তাহলে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হতে বাধ্য। যারা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নেয়, তারা সেটাকে কাজে কাজে লাগাতে দেরি করে না। সুতরাং যে উদ্দেশ্য নিয়ে শান্তিচুক্তি হয়েছিল, সে উদ্দেশ্য মাথায় রাখতে হবে। পাহাড়ের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন এবং ভূমির অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। এ কাজগুলো বকেয়া রেখে লোকদেখানো পদে বসিয়ে দিলেই গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না।’
রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আজ আমরা উদ্বিগ্ন, পাহাড় আজ আবার অশান্ত। জঙ্গিরা সেখানে ট্রেনিং নিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যুবকদের পাহাড়ে নিয়ে সশস্ত্র ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। তাদের টার্গেট ছিল কাশিমপুর জেল। কারণ সেখানে জঙ্গিরা আছে। অর্থাৎ পাহাড়ের অশান্তি এখন সারাদেশের অশান্তি। অবাক লাগে, প্রধানমন্ত্রী এ চুক্তির জন্য ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার পান।’
‘জিয়াউর রহমান পার্বত্য সমস্যার সমাধানে সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা নিয়েছিল। দেশের সাধারণ নিরীহ মানুষকে এনে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসিয়ে দিয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে কয়েক হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। শান্তিচুক্তিতে তাদের পুনর্বাসনের কথা ছিল। সেটা হওয়া দূরে থাক, পুনর্বাসনের বিষয় নিয়ে সেখানে গিয়ে কথাও বলা যায় না।’
মেনন আরও বলেন, ‘পাহাড়ে আজ অলিখিত সামরিক শাসন চলছে। সেখানে শুধু সেনাবাহিনী নয়, এপিবিএন, নতুনভাবে পুলিশের ক্যাম্প করা হচ্ছে। এই পাহাড় দেশের এক দশমাংশ। একদিন খালেদা জিয়া বলেছিল, দেশের এক দশমাংশ চুক্তি করে ভারতের হাতে তুলে দেবে। ২৫ বছর হয়েছে, সেটা হয়নি। আজ যদি সরকারও একই যুক্তি দেয়, বিচ্ছিন্নতার কথা বলে, তাহলে পাহাড়ে শান্তি আর আসবে না।’
চট্টগ্রাম জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহানের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন- বাসদ কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য রণজিৎ দে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য সৌখিন চাকমা, জাসদ নেতা জসিম উদ্দিন বাবুল, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন, ঐক্য ন্যাপের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হারুন রশিদ ভুঁইয়া, ন্যাপ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মিঠুল দাশগুপ্ত, আদিবাসী ফোরামের প্রতিনিধি অলিক মৃ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সুমন মারমা প্রমুখ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রঁদেভূঁ শিল্পীগোষ্ঠীর গণসঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশ শেষে গণমিছিল নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম