Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভাষা আন্দোলনে বামপন্থীরা ছিল মুখ্য ভূমিকায়

আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৭:০৬

১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির আগে ও পরে প্রবল প্রতিকূলতা ও অধিকাংশ বামপন্থী নেতা আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে আন্দোলনের ধারাকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল। এমনটাই জানালেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-এর সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খান।

মঞ্জুরুল আহসান খান বলেন, বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার ইস্যুতে ২০ ফ্রেব্রুয়ারি তমুদ্দুন মজলিসের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে ১৫ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে ১১ জন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে ভোট দেন। ৩ জন ভোট দেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে। মোহাম্মদ তোয়াহা ভোট দানে বিরত থাকেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গে পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন অলি আহাদ, আবদুল মতিন (ভাষা মতিন) ও গোলাম মাওলা। পক্ষে ভোট দেয়া আব্দুল মতিন, অলি আহাদ ও গোলাম মাওলা ছিলেন তৎকালীণ বাম ঘরানার ছাত্রনেতা। এরমধ্যে আব্দুল মতিন কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় নেতা ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

তিনি জানান, ওই দিন আব্দুল মতিন প্রকাশ্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষ নিয়ে বলেছিলেন, “১৪৪ ধারা ভঙ্গ না কেরলে পাকিস্তানিরা আমাদের চেপে ধরবে।” ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে আঁচ করা যায়, ওই দিন ভাষা মতিন-সহ বাম ঘরানার নেতারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপরীতে মত দিলে ইতিহাস অন্যরকম হতো, বাংলা রাষ্ট্রভাষা হতো না। শুধু তাই নয়, ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ আবুল বরকত ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব বলয়ের একজন কর্মী।

ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায়, বামঘরানার নেতারা ওই সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রকাশ্যে ও গোপনে তৎপরতা চালাতেন।

বিজ্ঞাপন

ভাষা আন্দোলনের সময় প্রথমে তমুদ্দুন মজলিসের কমিটি গঠিত হয় ২৮ জন সদস্য দিয়ে। ইতোমধ্যেই ২৭ জন মারা গেছেন। জীবিত আছেন তৎকালীন ছাত্রনেতা অধ্যাপক আব্দুল গফুর। তার বয়স এখন ৯৪ বছর। তিনি এখন চলাফেরা করতে পারেন না।

একুশে ফ্রেব্রুয়ারি সম্পর্কে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ভাষা আন্দোলনে বাম বা কমিউনিস্ট পার্টির তৎপরতা ছিল গোপনে। তাদের বলিষ্ঠ ভুমিকা ছিল। পিছু হটেননি তারা। ভাষা আন্দোলনে তৎকালীণ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রয়েছে।

এছাড়া রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব কতটুকু ছিল, তা আঁচ করা যায় পাকিস্তান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, আমলা, সরকার সমর্থক রাজনীতিবিদদের বক্তব্য এবং সরকার-সমর্থক পত্র-পত্রিকার সংবাদ থেকে। স্বয়ং নূরুল আমীন এই আন্দোলনকে কমিউনিস্টদের কারসাজি বলে বিবৃতি দেন।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ধর্মঘট সম্পর্কে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় বলা হয়: ‘সমস্ত আন্দোলনটি ঢাকার কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের চক্রান্তের ফল।… পুলিশ যাহাদের গ্রেফতার করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে ঢাকা ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি দেবপ্রসাদ মুখার্জ্জি, ছাত্র ফেডারেশন নেতা কমল বসু ও নীহার দত্ত মজুমদার অন্যতম।’ ১৯৫২ সালের ৩ মার্চ পূর্ববঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন বেতার ভাষণে ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর সরকারের দমন-পীড়নের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে সব দায় কমিউনিস্টের ওপর চাপিয়ে দেন।

ইতিহাস বলছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সঠিক পথে পরিচালনায় অন্যতম ভূমিকায় ছিলেন আবুল কাসেম, আবদুল গফুর, আবদুল জব্বার (ভাষা শহীদ), আবদুস সালাম (ভাষা শহীদ), আবুল বরকত (ভাষা শহীদ), কমলা ভট্টাচার্য, কানাইলাল নিয়োগী, কুমুদরঞ্জন দাস, চন্ডীচরণ সূত্রধর, জগন্ময় দেব, তরণী দেবনাথ, দিব্যেন্দু দাস, বিজন চক্রবর্তী, বীরেন্দ্র সূত্রধর, রফিকউদ্দিন আহমদ (ভাষা শহীদ), শচীন্দ্রচন্দ্র পাল, সফিউর রহমান (ভাষা শহীদ), সত্যেন্দ্রকুমার দেব, আবদুস সালাম (ভাষা শহীদ), সুকোমল পুরকায়স্থ, সুনীল সরকার, হিতেশ বিশ্বাস, শওকত আলী, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, নূরুল হক ভূঁইয়া, লিয়াকত আলি খান, সামসুল হক ,হামিদুর রহমান, মোহাম্মদ তোয়াহা, আব্দুল মতিন (ভাষা মতিন), আব্দুল মালেক উকিল, এ কে ফজলুল হক, আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অলি আহাদ, আবুল হাশিম, আবুল কালাম, শামসুদ্দীন, কাজী গোলাম মাহবুব, গাজীউল হক, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী, জহির রায়হান, মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মোহাম্মদ সুলতান, আব্দুল লতিফ, আলতাফ মাহমুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, নুরুল আমিন, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, শেখ মুজিবুর রহমান ও মুনির চৌধুরী।

১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দ শহরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নবগঠিত পাকিস্তানে স্লোগান তোলা হয়, ‘ইয়ে আজাদি ঝুট হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’, ‘সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তুলে এই সরকার হটাও’। মোট কথা ‘ভুয়া স্বাধীনতার’ বিরুদ্ধে ধর্মঘট, জঙ্গি মিছিল, সভা ও সশস্ত্র সংগ্রাম প্রভৃতির আহ্বান জানানো হয়। দলের এই ‘বাম-হঠকারী লাইন’ গ্রহণ করায় পাকিস্তান সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। পরে বাস্তবতা বিবেচনা করে দল পরিচালনার জন্য পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কমিটিতে রদবদল আনা হয়। ‘বাম-হঠকারী লাইন’ পরিত্যাগ করে ১৯৫১ সালে মণি সিংহকে সাধারণ সম্পাদক; বারীণ দত্ত, নেপাল নাগ, সুখেন্দু দস্তিদার ও খোকা রায়কে সম্পাদকমন্ডলী এবং শেখ রওশন আলী, শহীদুল্লা কায়সার ও শচীন বোসকে সদস্য করে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির নতুন কমিটি গঠন করা হয়।

ভাষা আন্দোলনে শহীদুল্লা কায়সার কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে ছাত্র আন্দোলনে পার্টির কর্মীদের নির্দেশনা প্রদান ও পরিচালনা করতেন। এছাড়া বাম রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী মুনীর চৌধুরী, কল্যাণ দাশগুপ্ত, নাদেরা বেগম, তাজউদ্দীন আহমদ, আখলাকুর রহমান ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হন।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীদের ওপর মুসলিম লীগ সরকার কঠোর দমন-পীড়ন চালালেও এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হন। পাকিস্তান সরকারের দমন-পীড়নে ভাষা আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীরা কোণঠাসা অবস্থার মধ্যেও বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রত্যক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেন এবং ‘সকল ভাষার সমান অধিকারের’ প্রশ্নে অটল থাকেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ধর্মঘটকে পাকিস্তান সরকার এবং তাদের দোসররা কমিউনিস্টদের ‘উস্কানি’ বলে অভিহিত করে। ১৯৪৮ সালের ১২ মার্চ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘ধর্মঘটের পশ্চাতে কমিউনিস্টদের উস্কানি’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশ করা হয়। ১৯৪৮ সালের ১২ মার্চ মুসলিম লীগের গুণ্ডারা পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কাপ্তান বাজার ও কোর্ট হাউস স্ট্রিটের অফিসে আক্রমণ চালায় ও তছনছ করে। ১৩ মার্চ রণেশ দাশগুপ্ত এবং ধরণী রায়কে গ্রেপ্তার করা হয়।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টনের জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা পুনর্ব্যক্ত করলে চারদিকে প্রতিবাদ শুরু হয় এবং ভাষা আন্দোলন প্রবল রূপ ধারণ করে। এমন পরিস্থিতিতে ‘পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি’ ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ্য বিবৃতি দেয়। যাতে বলা হয়: ‘লীগ সরকার উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষারূপে চালু করার চেষ্টা করিয়া বাঙালির অধিকার ও কৃষ্টির উপরই আক্রমণ করিতেছেন। ইহাতে পাকিস্তানের সামগ্রিক উন্নতি ব্যাহত হইবে। তাই “বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা ও সকল ভাষার সমমর্যাদা দান” পাকিস্তানের সকল ভাষাভাষী ব্যক্তির দাবি। এই দাবির পিছনে বাঙালি-অবাঙালি সকল জনসাধারণকে সমবেত হওয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানাইতেছি।’

দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ধারার একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিবাদী ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার যে প্রয়োজনীয়তার কথা সে সময় তীক্ষ্ণভাবে অনুভূত হয়েছিল, তার পটভূমি রচনা করেছিল বায়ান্নর ভাষা-সংগ্রাম। বায়ান্নর সংগ্রামের সেই নির্যাসকে অবলম্বন করেই একুশে ফেব্রুয়ারির মাত্র ২ মাসের মাথায়, পেছনে থাকা কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নতুন ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন। একুশের চেতনার নির্যাস হলো ছাত্র ইউনিয়নের মূলনীতি।

ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে সিপিবির সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৯৫২ সালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করলে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি ভাষা আন্দোলনে মুখ্য ভুমিকা পালন করেছে। ওই সময় আমার বয়স ৪/৫ বছর। আমার বাবা ঢাকায় সরকারি চাকরিতে কর্মরত ছিলেন। তিনি ওই দিন বাসা থেকে বেরিয়ে অফিসে যাচ্ছিলেন। অফিসে যাওয়ার পথে প্রচণ্ড গোলাগুলি, পুলিশের লাঠিচার্জ ধরপাকড় দেখে আবার বাসায় ফিরেন। বাবা আসায় এসে আমাদের জানান, ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছে। পুলিশের গুলিতে অনেক ছাত্র নিহত হয়েছে।’

তিনি বলেন, আবুল বরকত কমিউন্সিট পার্টির সক্রিয় নেতা ছিলেন। বরকত আামাদের আত্মীয় ছিলেন। আবুল বরকতের বাবা, মা ঢাকায় শহীদ মিনারে ফুল দিতে এলে আমাদের বাসায় উঠতেন।

আরও পড়ুন: ভাষার মাস শুরু

অতঃপর কবি এসে মেলার উদ্যান অংশে দাঁড়ালেন

একুশের প্রথম কবিতার রচয়িতার নামে চসিকের লাইব্রেরি

কিভাবে তৈরি হয়েছিল একুশের সেই অমর গান?

 

সারাবাংলা/এএইচএইচ/রমু

১৯৫২ সাল আমতলা থেকে ইউনেস্কো বামপন্থী ভাষা আন্দোলন ভাষার মাস শুরু

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর