ধুলায় ধূসর বইমেলা
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২০:৪৯
ছুটির দিনে অমর একুশে বইমেলার প্রথম প্রহরটা ছিল ছিমছাম। সকালবেলা মেলাচত্বর জুড়ে পানি ছিটানোয় ধুলার উড়াউড়ি ছিল না। বাতাসে ছিল না বাড়াবাড়ি রকম দূষণ। কিন্তু দ্বিতীয় প্রহরে এসে বইমেলার ‘১২টা’ বাজিয়ে দিয়েছে ধুলা।
বিকেলে টিএসসি সংলগ্ন মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের প্রবেশ পথে এক অস্বস্তিকর দৃশ্য চোখে পড়ে। আর্চওয়ে দিয়ে মেলায় প্রবেশরত প্রত্যেকটা মানুষের হাত নিজ নিজ নাকের ডগায়। আর আশপাশের পরিবেশ একেবারে ধুলায় ধূসর।
‘বৃষ্টিপাতহীন মাঘ-ফাল্গুন মাসে ধূলা থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মেলা শুরুর আগে কর্তৃপক্ষ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ‘ধুলা দূর করতে প্রতিদিনই পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ছিটানো হবে’— তার কী খবর? সকালবেলা মেলা চত্বরে পানি ছিটিয়ে ধূলা মারতে পারলে, বিকেল বেলা কেন নয়?— ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন তরুণ লেখক, গবেষক মেহেদী হাসান।
ফরিদপুর থেকে কয়েক ঘণ্টা ভ্রমণ শেষে টিএসসি সংলগ্ন গেট দিয়ে মেলায় প্রবেশের মিনিট পাঁচেক পর বেরিয়ে আসেন তিনি। টিএসসির বেদিতে দাঁড়িয়ে এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘এই ধুলার গল্প বলতে বলতে আমাদের চোখ ধূসর হয়ে যাবে। মেলা কর্তৃপক্ষ ধুলা দূর করতে পারবে না। বিগত মেলাগুলোতেও এই একই সমস্যা পড়তে হয়েছে আমাদের।’
মেহেদী হাসানের মতো যারা একা একা মেলায় ঢুকেছেন, তারা হয়ত বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। কিন্তু যারা পরিবার-পরিজন নিয়ে মেলায় ঢুকেছেন, তারা তো চাইলেই বের হতে পারছেন না। কারণ ছুটির দিনের জমজমাট মেলায় ঢোকাও যেমন কঠিন, বের হওয়াও তেমনি কঠিন।
মেলার সোহরাওয়ার্দী উন্যানে ১৮ নম্বর প্যাভিলিয়নের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় খায়রুল ইসলামের সঙ্গে। স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে মেলায় ঢুকে ধুলার যন্ত্রণায় নাকাল তিনি।
গোপীবাগ থেকে মেলায় আসা খায়রুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেলার এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে ধুলা উড়ছে না। এ বিষয়টি তো আগেই মাথায় রাখা দরকার ছিল। এত ধুলার মধ্যে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে মেলায় থাকা যায়? চেষ্টা করছি যতদ্রুত সম্ভব বের হয়ে যাওয়ার।’
মিরপুর থেকে মেয়েকে নিয়ে মেলায় আসা স্কুল শিক্ষিকা রাশিদা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘যাদের অ্যাজমাটিক সমস্যা আছে, তাদের উচিত হবে না আর এক মুহূর্ত মেলায় অবস্থান করা। মাস্ক যতই পরুক, এই ধুলা ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছাবেই। কিন্তু কী করার। দীর্ঘ লাইন পার হয়ে মেলায় ঢুকেছি। এখন তো চাইলেই বের হতে পারব না। তাই কষ্ট হলেও পছন্দের বই কিনে বাসায় ফিরব।’
তবে ধুলা বালি যাই হোক, তৃতীয় দিনে এসে পুরোপুরি উঠেছে মেলা। বিকেল চারটার পর মেলায় ছিল উপচেপড়া ভিড়। পাঠক এবং দর্শনার্থীরা স্টলে স্টলে ঘুরে বই নেড়েচেড়ে দেখেছেন। কেউ কেউ কিনেছেন বই। তবে মেলায় ভিড়ের তুলনায় বই বিক্রি কম হয়েছে।
মেলা থেকে খালি হতে বের হওয়ার সময় কথা হয় আজিজুল ইসলামের সঙ্গে। আজিমপুর থেকে মেলায় আসা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেবল তো মেলা শুরু হলো। চলবে আরও ২৫ দিন। সব বই আসুক। পরে এসে দেখে-শুনে বই কেনব।’
মেলায় ধুলা বিড়ম্বনা সম্পর্কে বাংলা একাডেমির বক্তব্য জানতে চাইলে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সকালে কিন্তু পানি ছিটানো হয়েছিল। বিকেলে এসে মেলায় প্রচুর মানুষের সমাগমের ধুলা একটু বেড়েছে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। সামনের দিনগুলোতে এ সমস্যা সমাধানে আমাদের আন্তরিক চেষ্টা থাকবে।’
এদিকে বাংলা একাডেমির দেওয়া তথ্যমতে, মেলায় তৃতীয় দিনে নতুন বই এসেছে ৯৬টি। তবে মেলায় গত তিন দিনে বেচা-বিক্রি নিয়ে কোনো তথ্য দেয়নি তারা।
শুক্রবার বিকেল ৪ টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘আবুল মাল আবদুল মুহিত’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কুতুব আজাদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন, জালাল ফিরোজ এবং এম আবদুল আলীম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নূহ-উল আলম লেনিন।
প্রাবন্ধিক বলেন, ‘লেখক-পাঠক-ভাবুক-বিশ্লেষক-গবেষক-অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিক আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন এক বর্ণিল ও বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী। ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ ছিল তার জীবন চলার পাথেয়। তার বিপুল গ্রন্থরাজি, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নানা প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও গবেষণাপত্র পাঠককুলের সঙ্গে তাকে মেলবন্ধনে আবদ্ধ করে। সব কিছু ছাপিয়ে তিনি ছিলেন একজন সংস্কৃতিবান ও রুচিবান আত্মনিবেদিত দেশকর্মী। নানা বিবেচনায় মনস্বী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নির্মোহ মূল্যায়ন প্রয়োজন।’
সভাপতির বক্তব্যে নূহ-উল আলম লেনিন বলেন, ‘আবুল মাল আবদুল মুহিত একজন বিরলপ্রজ বাঙালি। মেধা-মননে, শিক্ষাদীক্ষায় আলোকিত তিনি কেবল একজন সার্থক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, মানুষ হিসেবেও ছিলেন সত্যনিষ্ঠ, সত্যবাদী এবং দেশপ্রেমিক। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী তার জীবন ও কর্ম তরুণ প্রজন্মকে সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা জোগাবে।’
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন আহমদ বশীর, সুজন বড়ূয়া, রাজীব সরকার এবং হারিসুল হক।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পড়েন কবি তারিক সুজাত, কুমার চক্রবর্তী এবং সুপ্রিয়া কুণ্ডু। আবৃত্তি করেন আবৃত্তিশিল্পী রেজিনা ওয়ালী, ঝর্ণা সরকার এবং আহসানউল্লাহ তমাল। নৃত্য পরিবেশন করেন নৃত্যসংগঠন ‘বুলবুল একাডেমী অব ফাইন আর্টস (বাফা)’-এর নৃত্যশিল্পীরা। সংগীত পরিবেশন করেন সাজেদ আকবর, সালমা আকবর, শাহনাজ নাসরিন ইলা, মো. হারুন অর রশীদ এবং আব্দুর রশীদ। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ পাল (তবলা), ইফতেখার হোসেন সোহেল (কী-বোর্ড), অসিত বিশ্বাস (এসরাজ) এবং নাজমুল আলম খান (মন্দিরা)।
শনিবার বইমেলা শুরু হবে সকাল ১১ টায়। চলবে রাত ৯ টা পর্যন্ত। সকাল ১১ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত শিশুপ্রহর। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘ড. আকবর আলি খান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আমিনুল ইসলাম ভুইয়া। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ফারুক মঈনউদ্দীন, মো. মোফাকখারুল ইকবাল এবং কামরুল হাসান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মোহাম্মদ সাদিক।
সারাবাংলা/এজেড/একে