বছরজুড়ে ১৫০০ কোটি টাকার ফুল বাণিজ্য
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৮:৩১
ঢাকা: প্রতি বছর দেশে ফুলের চাহিদা বাড়ছে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই চার মাস ফুলের ব্যাপক চাহিদা থাকে। বিভিন্ন উৎসবের কারণে বছরের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় ফেব্রুয়ারি মাসে ফুলের চাহিদা থাকে আকাশচুম্বী। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারিতে বসন্ত উৎসব, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে এই সময়ে সারাদেশে ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়।
এ ছাড়াও বছরজুড়ে বিভিন্ন উৎসব বিশেষ করে জন্মদিন, বিয়ে, কুলখানি, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে সারা বছরজুড়ে ফুল বাণিজ্য চলে। এতে প্রতি বছর দেশে এক হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার ফুল বাণিজ্য হয়। দেশে মোট ফুলের চাহিদার ৯৫ শতাংশ পূরণ করা হয় দেশীয় ফুল দিয়ে। বিভিন্ন ফুল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।
রাজধানীর শাহবাগের বিভিন্ন ফুল ব্যবসাযীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছর গড়ে ২০ শতাংশ হারে দেশে ফুল উৎপাদন বাড়ছে। একটি জেলা থেকে ফুল উৎপাদন শুরু হলেও বর্তমানে ২৪টি জেলায় ফুল উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ফুল চাষ হয় যশোর জেলার গদখালি, ঝিকরগাছা, আনিসারা, কালিহাতপুর, কালিগঞ্জ। অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গা, নারায়ণগঞ্জের সাবদি বন্দর, গাজীপুর, ব্রহ্মণবাড়িয়া, মানিকগঞ্জের সিঙ্গার, সাভাবের গোলাপ গ্রাম ফুল চাষ হচ্ছে। এই ফুলগুলো দেশের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে। তবে বিভিন্ন ধরনের অর্কিড, লিলি ফুল, চাইনিজ জিপজি এই ধরনের কিছু ফুল দেশে চাষ হচ্ছে না। ফলে এই ধরনের কয়েকটি ফুল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়।
জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে দেশের অভ্যান্তরীন বাজারে ১০০ থেকে ১২০ কোটি টাকার ফুল বাণিজ্য হলেও বর্তমানে তা বেড়ে দাড়িযেছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। আগে অনেক বেশি ফুল আমদানি হলেও বর্তমানে তা কমে আসছে। বিশেষ করে ১৯৯৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার মতো ফুল আমদানি হতো। বর্তমানে তা কমে বছরে মাত্র ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার ফুল আমদানি হয়। এক সময় দেশের চাহিদার ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ফুল আমদানি করা হতো বর্তমানে তা কমে ৫ থেকে ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এদিকে দেশের ফুল কারিগররা ফুল শিল্পকে বিকশিত করার চেষ্টা করছে। উন্নত বিশ্বে যেখানে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ফুলের বিনিয়োগ করছে। কিন্তু বাংলাদেশের ফুল কারিগররা দেখে দেখে ফুল ব্যবসা শিখছে। তারপরেও আমাদের ফুলের মান খারাপ না।
তবে বর্তমানে কর্পোরেট কালচারের বিকাশের কারণে ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ীরা হুমকির মুখে পড়েছেন। বিশেষ করে বেশ কিছু ইভেন ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গড়ে উঠেছে। যারা কৃত্রিম ফুল দিয়ে বিভিন্ন হোটেল রেষ্টুরেন্টসহ বড় বড় অনুষ্ঠান সাজানোর কন্টাক্ট নিয়ে নিচ্ছেন। এতে করে কাঁচা ফুল ব্যবসা কিছুটা ঝুঁকের মুখে পড়েছে। ফলে ব্যবসায়ীরা কুত্রিম ফুল আমদানি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে বর্তমানে ফুল বাণিজ্য বিকশিত করতে এবং শাহবাগের ফুল ব্যবসায়ীদের সহায়তা করতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শাহবাগ ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ীদের ৪০টি স্থায়ী দোকান করে দেওয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বর্তমানে আর্থিক সংকটের কারণে ৮টি থেকে ৯টি দোকান করার পর বাকি কাজ বন্ধ রয়েছে। প্রকল্পটি দ্রুত শেষ করার দাবি জানিয়েছেন শাহবাগের ফুল ব্যবসায়ীরা।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি বাবুল প্রসাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফুলের মৌসুম। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বসন্ত উৎসব, বিশ্ব ভালোবাসা। পরপর তিন-চারটি বড় উৎসব থাকায় বছরজুড়ে মোট ফুল বিক্রির ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বিক্রি হয় ফেব্রুয়ারি মাসে।
তিনি আরও বলেন, ‘বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়, বিশেষ করে বিয়ে-শাদি থাকে, স্কুল কলেজে বিদায় অনুষ্ঠান হয়, বিভিন্ন সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হয়। ফলে এই সময়ে ব্যাপক ফুলের চাহিদা থাকে। ফলে আমরা হিসাব করে দেখেছি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, পহেলা লা ফালগুন সব মিলিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে সারাদেশে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। আর বছর হিসাবে অভ্যান্তরীন বাজারে প্রতি বছর এক হাজার ২০০ কোটি থেকে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা।’
বাবুল প্রসাদ আরও বলেন, ‘দেশে অভ্যান্তরীনভাবে ব্যবহার করা ফুলের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ফুল দেশেই উৎপাদন হয়। কিছু ফুল রয়েছে যেগুলো আমরা দেশে উৎপাদন করতে পারি না। কিংবা ওইসব ফুল উৎপাদনের আর্থিক সক্ষমতা কিংবা টেকনোলজি আমাদের নেই। বিশেষ করে জারবেরা, থাই গোলাপ, চায়না গোলাপ, লিলিয়াম, অর্কিড এসব ফুলের উৎপদিন করতে হলে অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু আমাদের চাষিদের সেই সামর্থ নেই। কারণ এসব ফুল উৎপাদনের জন্য প্রতিটি শেড করতে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। ফলে কিছু ফুলের ঘাটতি থাকে। এসব ফুল আমাদের বাইরে থেকে আনা হয়। তবে এটা খুবই নগন্য। এটা মোট চাহিদা ৫ থেকে ৭ শতাংশ।’
বর্তমানে ফুল ব্যবসার সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফুল শিল্পের জন্মের পর থেকেই সমস্যা। কারণ আমাদের ফুল শিল্পের কোনো পাইকারি মার্কেট নেই। নিজস্ব কোনো স্থায়ী দোকান নেই। সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও কিছু কিছু লোকের কারণে তা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ফুল ব্যবসায়ীদের জন্য প্রধানমন্ত্রী একটি প্রকল্প নিয়েছিলেন। প্রকল্পটি চলমান থাকলেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। আমরা অস্থায়ীভাবে ফুল ব্যবসা করার কারণে ঝড় বৃষ্টিতে আমাদের ফুলেল ৩০ শতাংশ লোকসান হয়।’
অন্যদিকে শাহবাগ বটতলা ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. বিল্লাল হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফুল মার্কেট শাহবাগ ফুল মার্কেট। এখন থেকে কিছু ব্যবসায়ী ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে গিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুল ব্যবসা করছে। প্রসিদ্ধ ফুল বাবসায়ীক স্থান হিসেবে শাহবাগ এখনও তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এখানে সারা বছর দিনে-রাতে ২৪ ঘন্টা ফুল বেচা-কেনা হয়। বিশষ করে ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি, এই তিন মাসে বিয়েসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও সামিজিক অনুষ্ঠানের কারণে ফুলের ব্যপক চাহিদা থাকে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের ফুলের চাহিদার একটা অংশ গত দশ বছর আগে ভারত, হল্যান্ড ও নেদারল্যান্ড থেকে ফুল আমদানি করা হতো, বর্তমানে এখন আর ফুল আমদানি করতে হয় না বললেই চলে। বর্তমানে দেশে যেভাবে ফুলের উৎপাদন বাড়ছে সেভাবে চাহিদাও বাড়ছে।’
বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘ফুলের মৌসমে ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই তিন মাসে কেবল শাহবাগে দৈনিক ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয়। তবে ২০ ফেব্রুয়ারির দিন দেড় থেকে ২ কোটি টাকায় ছাড়িয়ে যায়। এসব ফুলের প্রায় সবই দেশি ফুল। তবে বর্তমানে ভারতীয় কিছু আর্টিফিসিয়াল ফুলের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। কাগজের শুকনো ফুল। এসব কাগজের কৃত্রিম ফুল ভারত ও চীন থেকে ফুল আসায় দেশের ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া বিশেষ দিনগুলোতে কিছু কাঁচা ফুল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এই সংখ্যা খুবই সীমিত। তবে বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে তা প্রায় বন্ধ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার ঢকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শাহবাগ ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ীদের জন্য ৪০টি স্থায়ী দোকান করে দেওয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বর্তমানে আর্থিক সংকটের কারণে ৮টি থেকে ৯টি দোকান করার পর বাকি কাজ বন্ধ রয়েছে। আমরা দাবি জানাচ্ছি প্রকৃত ফুল ব্যবসায়ীদের জন্য যেন এই দোকানগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়।’
শাহবাগের অনিন্দ্য পুস্প‘র স্বত্বাধিকারী ফাতেমা খানম বলেন, ‘প্রাধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের অনুরোধ তিনি যেভাবে ক্যাসিও নির্মূল করেছেন। একইভাবে যেন ফুল ব্যবসার সিন্ডিকেট বন্ধ করতে উদ্যোগ নেন। বিশেষ করে কিছু ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ফুল ব্যবসাকে করপোরেট ব্যবসায় রুপান্তর করছে। তারা কৃত্রিম ফুল দিয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠান সাজানোর কন্ট্রাক্ট নিচ্ছে। এতে ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।’
আমতলা থেকে ইউনেস্কোর আরও খবর:
‘২০০ টাকার লোভে জামায়াতে যোগ দেয় গোলাম আযম’
ভাষা আন্দোলনে বামপন্থীরা ছিল মুখ্য ভূমিকায়
অতঃপর কবি এসে মেলার উদ্যান অংশে দাঁড়ালেন
একুশের প্রথম কবিতার রচয়িতার নামে চসিকের লাইব্রেরি
কিভাবে তৈরি হয়েছিল একুশের সেই অমর গান?
সারাবাংলা/জিএস/ইআ