Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মেলার জৌলুশ বাড়িয়েছে প্যাভিলিয়ন

আসাদ জামান
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:০৫

বইমেলার ষষ্ঠ দিন অদ্ভূত এক অভিজ্ঞতা হলো। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জলাধারের দক্ষিণ পাশে মেলার বঙ্গবন্ধু চত্বরে দাঁড়িয়ে আছি। ষাটোর্ধ্ব দুই ভদ্রলোক ইতি-উতি করতে করতে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

আপনারা কিছু খুঁজছেন?— দু’জনেই সমস্বরে উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, অনন্যা প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নটা কোনো দিকে, বলতে পারবেন?

প্রতিদিন মেলায় গেলেও সব প্যাভিলিয়নের লোকেশন এবং নম্বর তো আর মুখস্ত করে রাখিনি। তাই একটু মনে করার চেষ্টা করছিলাম। ইত্যাবসরে ওই দুই ভদ্রলোকের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলেন, ‘আন্দাজে কিছু বলেন না। না জানলে বলে দিন, জানি না।’

ভদ্রলোকের এমন আচরনে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী অবাক করা কাণ্ড! সাহায্য চাইলেন, আবার বিন্দুমাত্র সময় না দিয়েই রূঢ় ভাষায়…। কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। দেহ এবং মন আড়ষ্ট হয়ে আসিছল।

 

মাঘের ‍দিনগুলো হয় স্বল্প দৈর্ঘের। বিকেল পৌনে ৬ টার মধ্যেই সূর্য চোখের আড়ালে চলে যায়। মানুষ তার প্রয়োজনের তাগিদে কৃত্রিম আলোয় ভাসে। দুই ভদ্রলোকের অদ্ভূত আচরণে ভাবনার আকাশে যখন আঁধার নেমে আসছিল, ঠিক তখন স্টল-প্যাভিলিয়নের বৈদ্যুতিক বাতিগুলো জ্বলে উঠল। বিশেষ করে প্যাভিলিয়নের আর্কিটেকচারাল লাইটের বিম অ্যাঙ্গেলগুলো আমার চিন্তার অ্যাঙ্গেলটাও ঘুরিয়ে দিল।

যে জায়গাটাতে দাঁড়িয়েছিলাম, ঠিক তার বাম দিকের সারিতেই ‘অনন্যা প্রকাশনী’র প্যাভিলিয়ন। অসাধারণ রূপবিন্যাসে সাজানো হয়েছে প্যাভিলিয়নটি। এর অদূরেই ‘অন্যপ্রকাশ’র প্যাভিলিয়ন। পুরাকীর্তির অনুকৃতিতে তৈরি প্যাভিলয়টা মনোযোগ কেড়েছে পাঠক-দর্শনার্থীদের।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া ‘অনিন্দ্য প্রকাশ’, ‘অনুপম প্রকাশনী’, ‘অন্বেষা প্রকাশন’, ‘অন্যপ্রকাশ’, ‘অবসর প্রকাশনা সংস্থা’, ‘আগামী প্রকাশনী’, ‘ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ’, ‘ঐতিহ্য’, ‘কথাপ্রকাশ’, ‘কাকলী প্রকাশনী’, ‘চারুলিপি প্রকাশন’, ‘জার্নিম্যান বুকস’, ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’, ‘জ্ঞানকোষ প্রকাশনী’, ‘তাম্রলিপি’, ‘দি ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড’, ‘নালন্দা’, ‘পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স’, ‘পাঠক সমাবেশ’, ‘পার্ল পাবলিকেশন্স’, ‘পুঁথিনিলয়’, ‘প্রথমা প্রকাশন’, ‘বাংলাপ্রকাশ’, ‘বিশ্বসাহিত্য ভবন’, ‘ভাষাচিত্র’, ‘মাওলা ব্রাদার্স’, ‘মিজান পাবলিশার্স’, ‘শব্দশৈলী’, ‘শোভা প্রকাশ’, ‘সময় প্রকাশন’ এবং স্টুডেন্ট ওয়েজ-এর নান্দনিক প্যাভিলয়ন মেলার জৌলুশ বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।

সে কারণেই হয়তো মেলায় এসে বই কিনুক, বা না কিনুক সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষেরা প্যাভিলিয়নে ঢু মারতে ভুল করেন না। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে স্থান পাওয়া ৩৮টি প্যাভিলিয়নের প্রায় প্রত্যেকটির সামনেই সব সময় ভিড় লেগে থাকে। বিশেষ করে ‘মাওলা ব্রাদার্স’, ‘তাম্রলিপি’, ‘অন্বেষা প্রকাশন’, ‘পুঁথিনিলয়’ এবং ‘জার্নিম্যান বুকস’ এবারের বইমেলায় তাদের প্যাভিলিয়ন এমন অনিন্দ্য সুন্দর রূপবিন্যাসে সাসিয়েছে যে, সব সময় সেখানে তরুণ-তরুণীর সেলফিবাজি চলতেই থাকে।

মাওলা ব্রাদার্সের সামনে সেলফি তুলছিলেন ঢাকার লালবাগ থেকে মেলায় আসা সুমাইয়া ইসলাম অর্পা। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছরই মেলার প্যাভিলিয়নগুলো দারুণভাবে সাজায়। একেবারে বাণিজ্যমেলার মতো। এগুলোকে টাইমলাইনে রেখে দেওয়ার জন্য ছবি তুলে রাখি। গত বছর যেগুলো তুলেছিলাম, সেগুলো এখনো আমার টাইমলানে আছে।’

বিজ্ঞাপন

রামপুরা থেকে মেলায় আসা কামরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্যাভিলিয়নগুলোর সাজসজ্জা বইমেলার আভিজাত্য বাড়িয়ে দিয়েছে। একটা বনেদি চেহারা পেয়েছে বইমেলা। আগামীর দিনগুলোতে প্যাভিলিয়ন সংখ্যা বাড়লে মেলার সৌন্দর্যও বেড়ে যাবে।’

বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে যতদূর জানা যায়, ২০১৫ সাল থেকে প্যাভিলিয়ন যুগে প্রবেশ করে বইমেলা। প্রথম বছর ১১টি প্রতিষ্ঠানকে ১২টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেবার ‘দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লি:’, ‘পাঠক সমাবেশ’, ‘অনন্যা’, ‘সময় প্রকাশ’, ‘সাহিত্য প্রকাশ’, ‘অন্যপ্রকাশ’, ‘অনুপম প্রকাশ’, ‘কাককলী প্রকাশনী’, ‘আগামী প্রকাশনী’ ও ‘মাওলা ব্রাদার্স’ প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ পায়। প্যাভিলিয়ন যুগে প্রবেশ ফলে বইমেলার আঙ্গিক সৌন্দর্য বেড়ে যায়। পাঠক, প্রকাশক, লেখক, দর্শনার্থীদের প্রসংশায় ভাসে মেলা কর্তৃপক্ষ।

সেই থেকে প্যাভিলিয়নের চাহিদা বেড়েছে। বেড়েছে ভাড়া ও খরচের পরিমাণও। এ বছর মেলায় ছোট প্যাভিলিয়নের (দৈর্ঘ ২০ ফুট, প্রস্ত ২০ ফুট) জন্য ভ্যাটসহ ভাড়া ১ লাখ ৫১ হাজার ৮০০ টাকা এবং বড় প্যাভিলিয়নের (দৈর্ঘ ২৪ ফুট, প্রস্ত ২৪ ফুট) জন্য ভ্যাটসহ ভাড়া ১ লাখ ৮৬ হাজার ৩০০ টাকা করে নিয়েছে বাংলা একাডেমি।

প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভাড়া এবং সাজসজ্জার খরচ বাবদ একটা প্যাভিলিয়নে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা খরচ হয়। তারা বলছেন, আর্থিক বিবেচনায় প্যাভিলিয়ন ব্যয়বহুল ও অলাভজনক প্রজেক্ট। কিন্তু পাঠকের আগ্রহ, মেলার সৌন্দর্য এবং নিজেদের ডিগনিটি ধরে রাখতে প্যাভিলিয়ন সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঐতিহ্য প্রকাশনের সত্ত্বাধিকারী আরিফুর রহমান নাঈম সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুরো প্রকাশনা শিল্পটার মধ্যেই একটা নান্দনিকতার ব্যাপার আছে। এ বিষয়গুলোকে শুধু অর্থমূল্য দিয়ে চিন্তা করলে হবে না। বইমেলায় প্যাভিলিয়নগুলো আলাদা আবেদন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। প্যাভিলিয়নের কারণে মেলাল জৌলুশ অনেকগুণ বেড়ে গেছে। তবে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ আমাদের দিকটা বিবেচনা করে প্যাভিলিয়নের ভাড়া কমালে এ কাজে আমরা আরও উৎসাহ পাব। প্যাভিলিয়নটা আরও নান্দনিক সাজে সাজাতে পারব।’

মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান

বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘কাজী রোজী এবং দিলারা হাশেম’ শীর্ষক আলোচনা। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নাসির আহমেদ ও তপন রায়। আলোচনায় অংশ নেন করেন আসলাম সানী, শাহেদ কায়েস, আনিসুর রহমান এবং শাহনাজ মুন্নী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অসীম সাহা।

প্রাবন্ধিকদ্বয় বলেন, কবি, গীতিকার, নাট্যকার, গল্পকার কাজী রোজী আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের এক প্রগতিশীল সাহসী নারী, সদা প্রাণোচ্ছ্বল এক লড়াকু জীবনযোদ্ধা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সকল প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে সম্মুখসারির কর্মী ছিলেন তিনি। অপরদিকে, বাংলাদেশের খ্যাতিমান ঔপন্যাসিকদের মধ্যে দিলারা হাশেম একটি বিশিষ্ট নাম। ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, কবি, অনুবাদক, সংবাদ পরিবেশক, সংগীতশিল্পী ইত্যাদি নানা অভিধায় তাকে অভিহিত করা যায়। তিনি মূলত নগরজীবন ও বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের সুখ-দুখ, স্বপ্ন-সাধ, ভালোবাসা, হতাশ ও জীবনের বাস্তবতা তার সাহিত্যে তুলে এনেছেন।

সভাপতির বক্তব্যে অসীম সাহা বলেন, ‘জীবনের নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে কাজী রোজী যে নিরন্তর সংগ্রাম চালিছেন, তাতে তিনি সফল হয়েছেন। জীবনের অন্তর্গত রহস্য ও নিম্ন শ্রেণির মানুষের সংগ্রাম দিলারা হাশেমের সাহিত্যকর্মে ওঠে এসেছে। আমাদের উচিত যথাসময়ে তাদের মতো গুণী মানুষের কাজের স্বীকৃতি ও সম্মান প্রদর্শন।’

আজ লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন মোজাম্মেল হক নিয়োগী, রহীম শাহ, সত্যজিৎ রায় মজুমদার এবং তুষার কবির। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি মাহবুব সাদিক, ফারুক মাহমুদ এবং আতাহার খান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, মাহিদুল ইসলাম এবং অনন্যা লাবনী।

এছাড়া ছিল সাইমন জাকারিয়ার পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ভাবনগর ফাউন্ডেশন’র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী আজগর আলীম, আবুবকর সিদ্দিক, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, রহিমা খাতুন, শান্তা সরকার।

যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন আব্দুল আজিজ (তবলা), ডালিম কুমার বড়ুয়া (কী-বোর্ড), অরূপ কুমাল শীল (দোতারা) এবং মো. শহিদুল ইসলাম (বাঁশি)।

আগামীকাল অমর একুশে বইমেলার সপ্তম দিন। মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায়, চলবে রাত ৯ টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে মাহবুব তালুকদার এবং আলী ইমাম শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন গাজী রহমান ও আহমাদ মাযহার। আলোচনায় অংশ নেবেন লুৎফর রহমান রিটন, ড. নিমাই মণ্ডল, আমীরুল ইসলাম ও ওমর কায়সার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন ফরিদুর রেজা সাগর।

সারাবাংলাংলা/এজেড/পিটিএম

প্যাভিলিয়ন বইমেলা ২০২৩

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর