উদ্যানে ‘মূলমেলা’ নিঃসঙ্গ ‘মূলমঞ্চ’
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:৩৯
‘আমি সংগীতের ওপর লেখা-পড়া করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত পড়াই। আমি যদি রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলি, ভাই আমি একটা লেকচার দেব, একটা ক্লাস নেব। আপনারা কেউ দাঁড়াবেন না। কিন্তু আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হয়ত শুরু করলাম, ‘‘তারে ডাকলে কি আর প্রাণ জুড়াবে রে/ না দেখলে নয়নে/ কর বন্ধু যা লয় তোমার মনে/বন্ধুরে তুমি হইলা বটবৃক্ষ আমি তরুলতা/প্রাণেতে প্রাণ মিশাইয়ারে/ আমি কইছি মনের কথা/বন্ধুরে তুমি ভিন্ন আমি ভিন্ন এই না মনে/থাকতে যদি না পাই দেখা রে/ আমার জন্ম অকারণে রে বন্ধু/বন্ধুরে তোমার সাথে প্রেম করিয়া ঘুরি বনে বনে/ দূরবীণ শাহ কয় রইলাম আসায় রে/দেখা দিও নিরজনেরে বন্ধু/কর বন্ধু যা লয় তোমার মনে’— দেখবেন সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। ইটস অ্যা ম্যাজিক! মিউজিক হচ্ছে একটা ম্যাজিক।’
অমর একুশে বইমেলার অষ্টম দিন বুধবার বিকেল ঠিক ৫টা। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রবেশ করার পর মূলমঞ্চ থেকে ভেসে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষক কমল খালিদের দরাজ কণ্ঠের গান এবং গানের আগে পরে সংগীত নিয়ে তার এমন জাদুকরী বক্তব্য শোনার পর শরীর এবং মন অবশ হয়ে আসছিল।
প্রতিদিনের মতো আজও বইমেলার মূলমঞ্চে চলছিল আলোচনা আনুষ্ঠান। আজকের বিষয় ছিল ‘জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: ওস্তাদ আলি আকবর খান’। সাইম রানার উপস্থাপন করা মূলপ্রবন্ধের ওপর আলোচনা করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীতের শিক্ষক কমল খালিদ এবং ছায়ানটের সংগীতের শিক্ষক আলী এফ. এম. রেজওয়ান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করছিলেন বাংলা সংগীতের আরেক কিংবদন্তি শেখ সাদী খান।
শুধু আলোচনা নয়, আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে সংগীতের দুই শিক্ষকের কণ্ঠে প্রাসঙ্গিক গানগুলো মাঘের বিকেলটাতে এক অপার্থিব আবেশ সৃষ্ট করছিল। কমল খালিদ যখন খালি কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন ‘রজনী হইসনা অবসান/আজ নিশিতে আসতে পারে/বন্ধু কালাচাঁন।/কত নিশি পোহাইলো/মনের আশা মনে রইলোরে/ কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান/আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন/ বাসর সাজাই আসার আশে/আসবে বন্ধু নিশি শেষে/দারূণ পিরিতের বিষে ধরিল উজান/ আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন/ মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে/ কেমনে থাকি একা ঘরে/ সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান/ আজ নিশিতে আসতে বন্ধু কালাচাঁন’— তখন শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল। এই গানের ‘রাগভৈরবী’ সুর সম্পর্কে যে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তিনি তুলে ধরলেন, তাতে গানটার প্রতি প্রেমাচ্ছন্ন হয়ে পড়া ছাড়া উপায় নেই।
কিন্তু এই আলোচনা শোনার জন্য মঞ্চের সামনে দর্শক সারিতে লোক ছিল সর্বসাকুল্যে ২০ জন। প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন প্যান্ডেলে ২০ জন মানুষের উপস্থিতি টাঙ্গুয়ার হাওরে ভাসমান ছোট্ট একটা ডিঙ্গি নৌকার মতো।
তার মানে এই নয় যে, সংগীত বিষয়ক আলোচনা, গান, কবিতা, নৃত্যের প্রতি মানুষের কোনো আগ্রহ নেই। ২০১৪ সালে বইমেলা উদ্যানে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ‘মূলমঞ্চ’ এ রকম নিঃসঙ্গ ছিল না। প্রতিদিনের অনুষ্ঠানে শত শত লোক মন্ত্রমুগ্ধের মতো আলোচনা, গান, কবিতা, নৃত্য উপভোগ করত। সেসব দিনগুলোতে মঞ্চের সামনে চেহারে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করা ছিল রীতিমতো সৌভাগ্যের ব্যাপারে। আর আজ দশ সিটের সোফা পুরোটাই ফাঁকা। আড়াই শ’ চেয়ারের মধ্যে ফাঁকা পড়ে আছে ২৩০ টা!
মেলার পুরোটাই উদ্যানে পাঠিয়ে দিয়ে মূলমঞ্চ বাংলা একাডেমিতে রেখে আলোচনা অনুষ্ঠানের এমন দৈন্যদশায় রূপ দেওয়ার পেছনে কী যুক্তি থাকতে পারে, সেটি বাংলা একাডেমি ভালো বলতে পারবে। তবে মূলমঞ্চে বসে শেখ সাদী খান যখন দেখেন, তার সামনে সর্বসাকুল্যে দর্শক-স্রোতা মাত্র ২০ জন, তখন সারাজীবনের সাধনা নিয়ে তিনি লজ্জায় পড়ে যান বৈকি!
বইমেলার মূলমঞ্চের যখন এই দৈন্যদশা, তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পা’ ফেলার জায়গা নেই। সন্ধ্যা ছয়টায় টিএসসি গেট দিয়ে স্রোতের মতো মানুষ মেলায় ঢুকছে। তরুণ-তরুণী, যুবক-যবুতী, শিশু-কিশোর এবং পরিবার পরিজন নিয়ে নানা বয়সের হাজার হাজার মানুষ অমর একুশে বইমেলায় হাজির। আর উদ্যানের জলাধারের তিন পাশে কত শত জোড়া প্রেমিকযুগল যে মেলার শোভা বর্ধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে, তার লেখাজোঁকা নেই।
নানা কিসিমের, নানা আঙ্গিকের, নানা চিন্তার, নানা ধরনের মানুষ নিজ নিজ প্রয়োজনে, তাগিদে এবং উদেশ্যে বইমেলায় এসে বইমেলাটাকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রেমে, অপ্রেমে অথবা অভ্যাসগত কারণে এদের মধ্যে কেউ কেউ ‘বিশ্বস্ত বন্ধু বই’ কিনে ঘরে ফিরছে। আর এতেই হাজার হাজার, লাখ লাখ টাকা লগ্নি করে মেলায় স্টল-প্যাভিলিয়ন নেওয়া প্রকাশকেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন।
কথা হয় বই হাতে বাসায় ফেরা সৈয়দ ইফতাখারুল ইসলামের সঙ্গে। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘বই নিত্যদিনের সঙ্গী। সারা বছরই বই কেনা হয়। তবে মেলা থেকে বই কেনার মধ্যে বাড়তি একটা আনন্দ আছে। এখানে কমিশন পাওয়া যায় বেশি। নতুন বইয়ের কালেকশন থাকে অনেক। সব প্রকশনী ঘুরে পছন্দের বই কেনার সুযোগও মেলে।’
তাম্রলিপির বিক্রয়কর্মী শোয়েব মিথুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেলায় আসা সব মানুষ বই কিনবে— এমনটি আমরা কখনো ভাবি না। তবে মানুষ বেশি হলে স্বাভাবিক ভাবেই বিকিও বেশি হয়। সে কারণে আমরা চাই, মানুষ বেশি বেশি করে বই মেলায় আসুক।’
আজ লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন হাবিব আনিসুর রহমান, গাজী আজিজুর রহমান, রাসেল রায়হান, ইসমত শিল্পী।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি মাকিদ হায়দার, জাহিদ হায়দার, স্মৃতি আক্তার। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী মো. শাহাদাৎ হোসেন, এনামুল হক বাবু এবং চৈতালী হালদার। ফয়জুল্লাহ সাঈদের পরিচালনায় ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘শিল্পবৃত্ত’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী সাইদুর রহমান বয়াতি, আলম দেওয়ান, মমতা দাসী বাউল, মো. আবুল বাশার, ফারজানা আফরিন ইভা, পাগলা বাবলু, মো. আনোয়ার হোসেন এবং সন্ধ্যা রানী দত্ত।
যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন বেণু চক্রবর্তী (তবলা), আনোয়ার সাহাদাত রবিন (কী-বোর্ড), সুমন কুমার শীল (দোতারা), মো. শহীদুল ইসলাম (বাঁশি)।
আগামীকাল অমর একুশে বইমেলার ৯ম দিন। মেলা শুরু হবে বিকেল ৩ টায়, চলবে রাত ৯ টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: কবীর চৌধুরী এবং জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: সাংবাদিক-সাহিত্যিক জহুর হোসেন চৌধুরী শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আবদুস সেলিম ও জাহীদ রেজা নূর। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, খায়রুল আলম সবুজ, মনজুরুল আহসান বুলবুল এবং মুস্তাফিজ শফি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন শফি আহমেদ।
ছবি তুলেছেন: হাবীবুর রহমান, সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট
সারাবাংলা/এজেড/একে