Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাবিতে বাড়ছে ছিনতাই, অভিযোগ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে

রাহাতুল ইসলাম রাফি, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২০:২৩

ঢাকা: গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে রাজধানীর শহিদ মিনার এলাকায় মারধর ও ছিনতাইয়ের শিকার হন এক দম্পতি। কিল-ঘুষি দিয়ে আহত করার এক পর্যায়ে নগদ ২২ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় মামলা করেন ভুক্তভোগী দম্পতির এক নিকটাত্মীয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, গত এক মাসে শহিদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, পলাশী, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ আশেপাশের এলাকায় এমন অন্তত এক ডজন ছিনতাই ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় সবকটি ঘটনার সঙ্গেই জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এসব ঘটনায় অভিযোগের পাশাপাশি শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে তিনটি। ওই তিন মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়— দায়েরকৃত প্রতিটি মামলাতেই যাদের আসামি করা হয়ে তাদের রয়েছে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততা।

এ সব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নড়ে-চড়ে বসলেও ছাত্রলীগকে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এদিকে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রেরণা থেকে এই ধরনের ঘটনা ঘটায় শিক্ষার্থীরা।

১ মাসে শাহবাগ থানায় ৩ মামলা

গত ১৫ জানুয়ারি রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক দম্পতিকে মারধর ও হেনস্তা করে স্বর্ণালংকার ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে ঢাবি শিক্ষার্থী তানজির আরাফাত তুষার এবং রাহুল রায়ের বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় ভুক্তভোগী মামলা করলে দু’দিন পর গ্রেফতার হন তানজির আরাফাত তুষার। তবে একদিনের ব্যবধানে ছাড়া পেয়ে যান তিনি।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ৩টার দিকে কাভার্ড ভ্যান আটকে ১৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালানোর পথে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী। ফজলে নাবিদ সাকিল, মো. রাহাত রহমান ও সাদিক আহাম্মদ নামেরওই তিন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী চালক ডাকাতির মামলা করলে পুলিশ তাদের কোর্টে পাঠায়।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে শহিদ মিনার এলাকায় এক দম্পতিকে মারধর করে ২২ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে শাহবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগীর এক নিকটাত্মীয়। মামলায় দুই ঢাবি শিক্ষার্থী ফাহিম তাজওয়ার ও সাজিদ আহমেদসহ অজ্ঞাত ১০ থেকে ১২ জনকে আসামি করা হয়।

সংযুক্ততা থাকলেও নির্বিকার ছাত্রলীগ

১৫ জানুয়ারির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় যে দু’জনকে আসামি করা হয় তারা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ওই মামলার আসামি তানজির আরাফাত তুষার কবি জসীমউদ্দিন হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের সঙ্গে রাজনীতিতে সক্রিয়। অন্য আসামি রাহুল রায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য এবং বর্তমানে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে রাজনীতি করেন।

শহিদ মিনারে ছিনতাই ও হেনস্তার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার দুই আসামি ফাহিম তাজওয়ার ও সাজিদ আহমেদ। এরা দুজনই মাস্টার দা সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সদস্য। গত ৪ ফেব্রুয়ারি পলাশী এলাকায় কাভার্ডভ্যান আটকে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামিদের দুজন ফজলে নাবিদ সাকিল ও মো. রাহাত রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর শাখা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। এদের দুজনই ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের সঙ্গে রাজনীতিতে সক্রিয়।

এ সব ঘটনায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততা থাকলেও কোনো ধরনের ব্যবস্থাই নিতে দেখা যায়নি শীর্ষ নেতাদের। কিন্তু ‘অপরাধীদের স্থান ছাত্রলীগে নেই’— বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এই বক্তব্যই ঘুরেফিরে শোনা যাচ্ছে শীর্ষ নেতাদের মুখে।

এ সব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই ধরনের কাজে যারা যুক্ত, তাদের স্থান ছাত্রলীগে হবে না। ভবিষ্যতে কোনো ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রমে তাদের যুক্ত করা হবে না। আমরা ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা তাদের বলেছি, আইন অনুযায়ী যেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতা করব।’

ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত সারাবাংলাকে বলেন, “যারা ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে এ ধরনের কাজ করবে, তাদের ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ থাকবে৷ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও আমরা এসব ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছি।”

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ধরনের ফৌজদারি অপরাধে যুক্তদের স্থান বাংলাদেশ ছাত্রলীগে হবে না। তাদের ব্যাপারে আমাদের জিরো টলারেন্স থাকবে সবসময়।’

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করেছি, যাতে তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়। আমরা নিজেদের মতো করে তদন্ত করছি। কারও কোনো সম্পৃক্ততা পেলেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কেন জড়াচ্ছে শিক্ষার্থীরা?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অপরাধবিজ্ঞানী ড. জিয়া রহমান মনে করেন, শিক্ষার্থীদের এসব ঘটনায় জড়ানোর পেছনে ‘পলিটিক্যাল মোটিভেশন’ ও ‘প্যাট্রোনাইজেশন’ অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, ‘পলিটিক্যাল মোটিভেশন ও প্যাট্রোনাইজেশন থেকে এই ধরনের অপরাধে জড়িতে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এক্ষেত্রে দেখা যায়, এদের মধ্যে এক ধরনের হিরোইজম কাজ করে। এক ধরনের লেভেলিং কাজ করে। অপরাধ করে জেলে যায়, আবার বেরিয়ে আসে। পুনরাবৃত্তি হয়। এক পর্যায়ে এটিকে পেশা বানিয়ে ফেলে বলা যায়।’

ছিনতাইয়ের কারণ হিসেবে মাদকের বিষয়টি উল্লেখ করে অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘দেখা যায়, মাদক কেনার টাকায় টান পড়লেও ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। এ ধরনের ঘটনা সমাজের অন্য অনেক স্তরেও দেখা যায়।’

এসব অপরাধ বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে কার্যক্রম বাড়ানোর পাশাপাশি ইতিবাচক কাজে শিক্ষার্থীদের সংযুক্ততা বাড়াতে হবে বলে মত দেন অধ্যাপক জিয়া। তিনি বলেন, ‘সচেতনতা বাড়ানোর জন্য গঠনমূলক কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত করতে হবে। ইতিবাচক কাজকর্মে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসতে হবে। ভালো কাজের পুরস্কার থাকতে হবে। আমরা তো সেগুলো করতে পারছি না।’

নড়ে-চড়ে বসেছে ঢাবি প্রশাসন ও পুলিশ

এদিকে, ছিনতাই-হেনস্তার ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ। দু’টি মামলার ঘটনায় গ্রেফতারও করা হয়েছে চার শিক্ষার্থীকে। গত ১৫ জানুয়ারি তারিখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘটে যাওয়া ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত তানজির আরাফাত তুষারকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া অন্য ঘটনাগুলোতেও ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেসব ঘটনা ঘটেছে, এগুলো খুব দুঃখজনক। মেধার পাশাপাশি সততার বিষয়টিও শিক্ষার্থীদের লালন করতে হবে। এই জায়গায় ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। তারা কি আগে থেকেই এমন, নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে খারাপ চক্রের সংস্পর্শে এসে অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে?— সেটাও ভাববার বিষয়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীকেও বলা আছে, তথ্য-প্রমাণ থাকলে অবশ্যই যাতে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সুস্পষ্ট নির্দশনা দিয়েছি, কাউকে যেন ছাড় দেওয়া না হয়। ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপকর্ম রোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমরা টহল ও নজরদারি বাড়িয়েছি। অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত কেউ শনাক্ত হলে দ্রুতই তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

শাহবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নূর মোহাম্মদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সব সময়ের মতোই তৎপর আছি। এ ধরনের ঘটনায় ভুক্তভোগী মামলা করতে এলেই আমরা গ্রহণ করি। আমরা সবসময় তৎপর থাকব।’

সারাবাংলা/আরআইআর/পিটিএম

ছাত্রলীগ ছিনতাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

এখনো সালমানকে মিস করেন মৌসুমী
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৩৩

সম্পর্কিত খবর