‘ভাষা আন্দোলন থেকেই বাংলাদেশ, বাংলার স্বাধীনতা’
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:৪১
অধ্যাপক আবদুল গফুর। ভাষা আন্দোলনের একজন অগ্রসেনানী। একুশে পদকপ্রাপ্ত। বর্তমানে বয়স ৯৪ বছর। কথা বলতে কষ্ট হয়। কথা বলেন আস্তে আস্তে। হারনো দিনের স্মৃতি বলতে পারেন ভেঙে ভেঙে। থাকছেন রাজধানীর মাতুয়াইলের কোনাপাড়ায়। অধ্যাপক আব্দুল গফুরের ছেলে সাংবাদিক মোস্তফা তারিক আল বান্না।
অমর একুশে ফ্রেব্রুয়ারির মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস উপলক্ষ্যে সারাবাংলা ডট নেট তার একটি সাক্ষাৎকার নেয়। সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন সারাবাংলা ডট নেটের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট আজমল হক হেলাল। সঙ্গে ছিলেন ফটো সাংবাদিক মো. সুমিত আহমেদ সোহেল।
সারাবাংলা ডটনেট: আপনি শিক্ষাজীবন কোথায় কাটিয়েছেন?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: ১৯৪৭ সালে আমি আইএ পাস করি। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হই। জায়গীর থাকি ভাটি মসজিদের কাছে। আমার জায়গীর বাড়ির কাছেই আজিমপুর রোডের ১৯ নম্বর বাসাটি ছিল প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম সাহেবের। শুরুতে সেই বাসাতেই উঠেছিলাম। এর আগে স্কুল জীবনের ফরিদপুর ময়েজ উদ্দিন হাই মাদরাসায় লেখাপড়া করি। ওখান থাকতেই পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। মাদরাসায় আমার সিনিয়র ছাত্র ছিলেন হাফেজ মতিউর রহমান, এনামুল হক প্রমুখ। তারা পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। তারা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মাদরাসার হোস্টেলে থাকতাম। মেধাবী স্টুডেন্ট হিসেবে আমার কোনো খরচ দিতে হতো না।
সারাবাংলা: ভাষা আন্দোলনে আপনাদের প্রেরণার উৎস কী ছিল?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: ভাষা আন্দোলনে আমাদের প্রেরণার উৎস ছিল আল-কুরআন। সুরা ইবরাহিমের চতুর্থ আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, ‘আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পারে।’ কোনো জাতির মাতৃভাষা আল্লাহপাকের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এই আয়াতে তা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
সারাবাংলা: তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট কী ছিল? কারা এর সাথে জড়িত ছিলেন?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম সাহেব। পাকিস্তান আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করার আগেই তিনি পাকিস্তানের কালচারাল মুভমেন্ট কী হবে সেটা নিয়ে ভাবছিলেন। সমমনা কয়েকজনকে নিয়ে একটি ইসলামি বিপ্লবী কালচারাল অর্গানাইজেশনের পরিকল্পনা করেছিলেন।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর ১ সেপ্টেম্বর আবুল কাসেম সাহেব সৈয়দ নজরুল ইসলাম (পরে মুজিনগর সরকারের অ্যাক্টিং প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন), শামসুল আলম এবং ফজলুর রহমান ভূঁইয়াকে (১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হয়েছিলেন) নিয়ে ‘পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস’ গঠন করেন। পাকিস্তানের জাতীয় সাংস্কৃতি বিকাশের জন্যই মূলত এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা হয়।
আবুল কাসেম সাহেব ছিলেন ফাউন্ডার সেক্রেটারি। শুরুতে তমদ্দুন মজলিসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কোনো পদ ছিল না, সেক্রেটারি-ই ছিলেন সংগঠনের প্রধান ব্যক্তি।
এই কমিটি করার সময় অনেক বেগ পেতে হয়েছে। ওই সময় বলা হতো বাংলা হিন্দুদের ভাষা। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পর ঢাকায় এর প্রভাব বেশী পরে। এজন্য আমাদের ফাইট করতে হতো। ১৯৪৭ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর তমুদ্দন মজলিসের জন্ম হয়। আর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী ছাত্রলীগের জন্ম। শেখ মুজিব সাহেব তখন ছাত্রলীগের নেতা। তিনি তমদ্দুন মজলিস কমিটির সদস্য ছিলেন। শেখ মুজিব সাহেব ভাষা আন্দোলনের সময় সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। জেলে থেকে আন্দোলনের সমর্থন দেন।
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদের বৈঠকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সংসদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাতে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দানের দাবি করেন। কিন্তু সে দাবি নাকচ হয়ে যায়। এর প্রেক্ষিতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদকে সম্প্রসারিত করা হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি। এটার আহবায়ক করা হয় শামসুল আলমকে। তিনি তমদ্দুন মজলিস এবং মুসলিম ছাত্রলীগেরও মেম্বার ছিলেন। এই কমিটির উদ্যোগেই ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহবান করা হয়। হরতালে পিকেটিংয়ের সময় ছাত্র এবং পুলিশের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে আবুল কাসেম সাহেবসহ অনেকে আহত হন। পুলিশ অলি আহাদ, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেককে আটক করে। এরপর থেকে প্রতিদিনই মিছিল-মিটিং চলতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ১৫ মার্চ সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে তাদের সব দাবি মেনে নিয়ে ৮ দফা চুক্তি করেন।
সারাবাংলা: ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে কখনও গ্রেফতার হয়েছেন?
অধ্যাপক আব্দুল গফুর: আমাকে গ্রেফতার করতে একদিন রাত তিনটায় পুলিশ আসে। বাসার পেছনে ছিল ডোবা। ডোবায় পচা পানি। বাসার পেছনে সেই পচা ডোবার পানি সাতরিয়ে তেজগাঁও যাই। তেজগাঁওয়ে কাসেম সাহেব থাকেন। পরের দিন চলে যাই ময়মনসিংহ। পুলিশ টের পায় আমি ময়মনসিংহে আছি। এ জন্য ওখান থেকে চলে যাই কুষ্টিয়ায় ডা. সদরুদ্দিন আহমেদের বাড়ী। পুলিশ জানতে পারে আমি কুষ্টিয়ায়। পরে ওখান থেকে চলে যাই ভেড়ামারা। যখন জানলাম পুলিশ শান্ত হয়েছে তখন আবার ঢাকায় ফিরি। তবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিলে আমিও ছিলাম। ওই দিন প্রাণে রক্ষা পেয়েছি।
সারাবাংলা: ভাষা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা কেমন ছিল?
অধ্যাপক আব্দুল গফুর: ওই সময় কমিউনিস্ট দলটি ছিল না। তাদের যুবলীগ বলা হতো। ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ যারা করতেন তারাই কমিউনিস্ট। ওই সময় সরদার ফজলুল করিম কমিউন্সিট পার্টি করতেন। আব্দুল মতিন (ভাষা মতিন), শহীদ আবুল বরাকতসহ অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। ভাষা আন্দোলনের সময় তারা প্রকাশ্যে এবং গোপনে… দুরকমই ভূমিকা পালন করেছেন। তবে প্রকাশ্যে কম, গোপনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে কমিউনিস্ট পার্টি।
১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের একটি বৈঠক হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়। বৈঠকে আমরা ১৫ জন উপস্থিত ছিলাম। বৈঠকে আলোচনা হয় ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে কি হবে না সে বিষয়ে। এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কেউ বলেছেন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা ঠিক হবে না। পরে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার বিষয় নিয়ে ভোটাভুটি হয়। ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে ১১টি ভোট পরে। আর ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে ৪টি ভোট পরে। ওই চার জন যারা ভোট দিয়েছিলেন তারা হলেন ভাষা মতিন, অলি আহাদ, গোলাম মাওলা ও কমরুদ্দিন। এসময় ভাষা মতিনসহ বাকি ৩ জন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘আজ আমরা যদি ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গি তাহলে পাকিস্তান সরকার পরবর্তিতে আমাদের গলা টিপে ধরবে। তাই আমরা সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গবো।’ …এবং তাই হলো।
’৫২ সালের চূড়ান্ত আন্দোলনের সময় আমার সম্পাদনাতেই প্রকাশিত হতো ‘সৈনিক’ পত্রিকা। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি পর পর তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল সৈনিক পত্রিকার। এর একটা অফিস ছিল ৪৮ নম্বর কাপ্তান বাজারে, আরেকটা অফিস ছিল ১৯ নম্বর আজিমপুর রোড আবুল কাসেম সাহেবের বাসায়। শুরুতে এটা বিভিন্ন প্রেস থেকে ছাপা হতো। বছর দুই পরে নিজেদের একটা প্রেস হয়। কবি শামসুর রাহমান তখন ছাত্র। তার লেখাসহ সেই সময়ের প্রায় সব কবি-সাহিত্যিকের লেখা ছাপা হতো সৈনিক পত্রিকায়।
ভাষা আন্দোলন থেকেই আজ বাংলাদেশ। বাংলার স্বাধীনতা। শেখ মুজিব সাহেবের বিরুদ্ধে একটি গুঞ্জন উঠে তিনি পাকিস্তান ভাঙতে চান। শেখ সাহেব আমার ৬ বছরের বড় ছিলেন। একদিন তাকে ওই গুঞ্জন ধরে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘মুজিব ভাই, পাকিস্তান কি ভাঙা হবে? জবাবে তিনি বলেছিলেন, নতুন প্রজন্ম ও দেশের জনগণ চাইলে তাই হবে।’
সারাবাংলা: একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে ভাষা সৈনিক বলা হয়। আসলে কি তিনি ভাষা সৈনিক?
অধ্যাপক আব্দুল গফুর: গোলাম আযম ছিলেন দোদুল্যমনা। অর্থাৎ দু’মুখি ভূমিকায় ছিলেন। টাকা যে দিকে থাকতো সেই দিকে তিনি থাকতেন। গোলাম আযম ভয়ে আমাদের সামনে আসতেন না। আমাদের ভয় পেত। তমদ্দুন মজলিস কমিটিতে গোলাম আযম থাকলেও তার ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। গোলাম আযম টাকার আন্দোলনে বিশ্বাস করতেন। একদিন তিনি তমদ্দুন মজলিস কমিটির সদস্যদের অর্থাৎ আমাদের জানালেন, ‘জামায়াতে ইসলাম মাসে ২০০ টাকা দিবে। আমি (গোলাম আযম) সেখানে যাবো।’ এক পর্যায়ে তিনি তমদ্দুন মজলিস কমিটি ছেড়ে ২০০ টাকার আশায় জামায়াতে ইসলামীতে সার্বক্ষণিক সময় দেওয়া শুরু করেন। গোলাম আযম টাকার রাজনীতি করতেন। গোলাম আযম স্বাধীনতার পর নিজেই করাচিতে বসে সাংবাদিকদের প্রশ্নে জবাবে বলেছেন ভাষা আন্দোলনে যোগদান করার সিদ্ধান্তটি ছিল ভুল।
সারাবাংলা: একজন ভাষা সৈনিক হিসেবে কি পেয়েছেন কি হারিয়েছেন?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: ভাষা আন্দোলন থেকে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। আমাদের আত্মত্যাগ এখন আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। (হেসে বললেন) জীবনে টাকা-কড়ি সম্পদ অর্জন করতে পারেনি, তবে আমি অনেক সুনাম অর্জন করেছি।
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং নবীন প্রজন্মের জন্য তা প্রদর্শনের ব্যবস্থা এখনও করা যায়নি। সরকার চাইলে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারকে ঘিরে একটি ‘ভাষা আন্দোলন কমপ্লেক্স’ করতে পারে। যেখানে একটি জাদুঘর থাকবে। জাদুঘরে আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্নগুলো বিশেষত, তমদ্দুন মজলিস প্রকাশিত পুস্তিকা, সৈনিক পত্রিকার কপিগুলোসহ আর যা পাওয়া যায় সেসব সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে। এতে ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে মানুষ অবহিত হতে পারবে।
আমতলা থেকে ইউনেস্কোর আরও খবর:
ভাষার মাস শুরু
‘২০০ টাকার লোভে জামায়াতে যোগ দেয় গোলাম আযম’
ভাষা আন্দোলনে বামপন্থীরা ছিল মুখ্য ভূমিকায়
অতঃপর কবি এসে মেলার উদ্যান অংশে দাঁড়ালেন
একুশের প্রথম কবিতার রচয়িতার নামে চসিকের লাইব্রেরি
কিভাবে তৈরি হয়েছিল একুশের সেই অমর গান?
বছরজুড়ে ১৫০০ কোটি টাকার ফুল বাণিজ্য
‘বাপ-মা নেই’ দেশের কোনো শহীদ মিনারেরই
সারাবাংলা/এএইচএইচ/রমু