Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অযত্ন-অবহেলায় শহীদ বরকত স্মৃতি জাদুঘর

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:১৯

ঢাকা: অযত্ন-অবহেলায় থেকেও নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে ভাষা শহীদ আবুল বরকতের নামে গড়ে তোলা স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকার পলাশী মোড়ে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরটির আকার খুবই ছোট। সংগ্রহশালায় নেই খুব বেশি স্মৃতিচিহ্নও। জাদুঘরের অভ্যন্তর অপরিচ্ছন্ন। মাত্র তিনজন অফিস সহকারি দিয়ে জাদুঘরটি পরিচালিত হচ্ছে। প্রায় বছর খানেক আগে জাদুঘরের গাইড (প্রদর্শক) মারা যান। এই পদে এখনও নতুন করে নিয়োগ হয়নি। জাদুঘরের পরিচালকও সেখানে নিয়মিত পা রাখেন না! সব মিলিয়ে অযত্ন ও অবহেলায় রয়েছে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে থাকা ভাষা শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালাটি। ফলে জাদুঘরটি অনেকটাই দর্শনার্থীশূণ্য!

বিজ্ঞাপন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০১২ সালের ২৫ মার্চ জাদুঘরটির যাত্রা শুরু। ঢাবি’র ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন জাদুঘরটির পরিচালক পদে রয়েছেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সাধারণত এই অল্প জায়গায় জাদুঘর হয় না। আর এখানে ভবনটি এমনভাবে করা হয়েছে সেটি ভবিষ্যতে বর্ধিতও করা যাবে না।’ খুব দেরিতে জাদুঘরটি শুরু হয়েছে বলে সেখানে শহীদ বরকতের খুব বেশি স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহে রাখা সম্ভব হয়নি বলেও জানান তিনি। তবে ভবিষ্যতে জাদুঘরটিতে ডিজিটাল ডিসপ্লে স্থাপন করা হবে, যেখানে বরকতের বিভিন্ন ছবি ও নানান স্মৃতিচিহ্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে তুলে ধরা হবে।

বিজ্ঞাপন

জাদুঘরটির কার্যক্রম সম্পর্কে উষ্মা প্রকাশ করে খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই সংগ্রশালাটি কেন করেছে তা আমরা জানি না। এটা সম্পর্কে আমরা কেউ কিছু জানি না। এর সঙ্গে কারা জড়িত সেটিও আমাদের জানা নেই। যাওয়া আসার পথে মাঝেমধ্যে এটি চোখে পড়ে। এর বাইরে কিছু জানি না।’ করণীয় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই ইতিহাসবিদ বলেন, ‘এটিকে সত্যিকার অর্থে জাদুঘর বা সংগ্রহশালা যদি করতে হয় তাহলে খুব মনযোগ দিয়ে কাজটি করতে হবে।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, যেখানে জাদুঘরের নামটি লেখা রয়েছে, তার পাশেই বাউন্ডারিতে কাটাতারের বেড়া থাকায় নাম ফলকটিই অনেকটা অদৃশ্যমাণ। জাদুঘরটি দর্শনার্থীদের জন্য সব সময় উন্মুক্ত থাকে না। ছুটির দিনগুলোতে বন্ধ থাকে। দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। এই সময়েরও মধ্যে আবার দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত খাবার বিরতি। সব মিলিয়ে দিনে মাত্র ৫ ঘন্টা জাদুঘরটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

জাদুঘরে থাকা ‘ভাষা শহীদ’ নামের ফলকটির লেখাগুলো প্রায় মুছে গেছে। ফলে ফলকে যা লেখা রয়েছে তা অনেকটাই অদৃশ্যমাণ। আর সংগ্রশালার নিচতলার ওয়াশরুমটি চোখ পড়লে মনে হবে সেখানে মানুষের পা পড়ে না এক যুগ!

জাদুঘরে বাবাকে লেখা বরকতের চিঠি, তার শিক্ষাগত যোগ্যতার বিভিন্ন সার্টিফিকেটের অনুলিপি ও দুর্লভ ছবি সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়া ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের খবর রয়েছে এমন পত্র-পত্রিকার কিছু কাটিং সংক্ষণ করা হয়েছে জাদুঘরটিতে। কিছু স্মৃতিচিহ্ন, হাতঘড়ি ও একুশে পদকও সংরক্ষিত রয়েছে।

দোতলা ভবনের নিচতলায় আবুল বরকতের ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্রও রয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, ভাষা শহীদ আবুল বরকতের স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী সার্টিফিকেটের অনুলিপি রয়েছে। ১৯৫১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে পাস করেন তিনি। এছাড়া শহীদ আবুল বরকতের ব্যবহৃত ৩টি কাপ ও পিরিচ সংরক্ষিত রয়েছে। ২০০০ সালে ভাষা শহীদ আবুল বরকত একুশে পদক (মরণোত্তর) পেয়েছিলেন, সেটিও সংরক্ষিত আছে সেখানে। এছাড়া ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের কপি রয়েছে এই জাদুঘরে। এছাড়া জাদুঘরের দু’তলায় রয়েছে একটি লাইব্রেরি, সেখানে ভাষা শহীদদের উপর লেখা ৪০০ এর বেশি বই রয়েছে।

জাদুঘরে কর্মরত অফিস সহায়কদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাদুঘরে তিনজন সিকিউরিটি গার্ড রয়েছেন। তারা তিন শিফটে দায়িত্ব পালন করেন। আর একজন পিয়ন রয়েছেন। জাদুঘরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বছর খানেক আগে মারা গেলেও নতুন করে এই পদে আর কেউ বসেনি। জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক ড. আবু. মো দেলোয়ার হোসেনও জাদুঘরে তেমন আসেন না। জাদুরঘরটিতে দর্শনার্থী আসেন না একেবারেই। দিনে ১০ থেকে ১৫ জন কিংবা কখনও এরও কম দর্শনার্থীর দেখা মেলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী আবিদ হাসান সারাবাংলাকে বলে, ‘মানুষকে আগ্রহী করবে, এমন কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। খুব ভালো করে খেয়াল না করলে মানুষ বুঝতেও পারবে না যে এখানে একটি জাদুঘর আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী হয়ত জানেনও না এখানে একটি জাদুঘর আছে।’

অন্য এক শিক্ষার্থী আল আমিন ইসলাম বলেন, ‘প্রথম বর্ষে পড়াকালীন একবার সেখানে গিয়েছিলাম। খুব কম পরিমাণ সংগ্রহ আছে সেখানে। আকর্ষণীয় করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ থাকলেও কখনোই কিছু করতে দেখিনি’

জানতে চাইলে ঢাবি’র ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান এবং ভাষা শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রশালার পরিচালক অধ্যাপক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১২ সালে এই জাদুঘরটি শুরু হয়। আমরা তো অনেক পরে শুরু করেছি। যেহেতু জাতীয় জাদুঘর আগে শুরু করেছে তারা সব পেয়েছে। এটা তো দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপার। বরকতের লেখা আরও কিছু চিঠি আমরা এখানে যুক্ত করবো। ভাষা আন্দোলনের উপর তিনটি এমফিল ও ৩টি পিইচডি গবেষণা হয়েছে। এর মধ্যে একটি পিএইচডি গবেষণা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাকি দুটি ঢাবি থেকে। যারা গবেষণা করতে আসেন তারা এই পাঠাগার ব্যবহার করেন।’

তিনি বলেন, ‘বরকতের জন্ম মুর্শিদাবাদে। সব ভাষা শহীদদের নিজ মাতৃভূমিতে সরকার একটি করে জাদুঘর করে দিয়েছে। যেহেতু বরকতের জন্ম এ দেশে নয়, তাই ঢাবিতে জাদুঘর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজি হলে সেখানে অল্প জায়গায় এক বছরের মধ্যেই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণত এই অল্প যায়গায় জাদুঘর হয় না। আর এখানে ভবনটি এমভাবে করা হয়েছে সেটি আর বর্ধিত করাও যাবে না।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, ‘দর্শনার্থী সত্যিই কম। ঢাবি’র শিক্ষার্থীদের আমরা নিয়ে যাই। আর জাদুঘরই বলুন, বই পড়ার কথা বলুন- সেটা একেবারেই কমে গেছে। শিশুদের অভিভাবকরা এসে এখানে আড্ডা দিতে চায়, কিন্তু সেটা তো হতে দেওয়া যায় না। তবে ফেব্রুয়ারিতে দর্শনার্থী বাড়বে।’

জাদুঘরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বছর খানেক আগে মারা গেলেও এই পদে নতুন করে নিয়োগ হয়নি কেন জানতে চাইলে জাদুঘরের পরিচালক বলেন, ‘উনি তৃতীয় গ্রেডের কর্মচারী ছিলেন। উচ্চমান সহকারি, তার আসল পদবী ছিলো প্রদর্শক। ঢাবির অধীনে এই জাদুঘর পরিচালিত হয়। এই পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য আমরা চিঠি দিয়েছি।’

ওয়াশরুম খুবই অপরিচ্ছন্ন থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দ্রুতই তা পরিষ্কারের ব্যবস্থা করা হবে।’ তিনি নিজে জাদুঘরে অনিয়মিত কেন এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এটা তো আমরা ফুল টাইম অফিস না। আমি ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান। সেখানে যাওয়ার কথা না। সেটি ফুল টাইম বৈতনিক জবও না।’ এখন পর্যন্ত জাদুঘরের পরিচালক হিসাবে কোন বেতন নেননি বলেও জানান তিনি।

কিছু পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেহেতু জায়গাটি খুবই ছোট, আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে একটি টাচ স্ক্রিন স্থাপন করা। সেখানে টাচ করলে বিভিন্ন ইতিহাস ও ছবি দেখা যাবে। ডিজিটাল ডিসপ্লে স্থাপনের লক্ষ্যও রয়েছে। ১৯৫৬-৫৭ সালের পত্রিকার ক্রোড়পত্র সংগ্রহ করছি। আমরা বরকতের মুর্শিদাবাদের (ভারত) বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানকার কিছু ছবি তুলে নিয়ে এসেছি। সেখানে তার নামে ভাস্কর্য ও ছোট্ট একটি মিউজিয়াম রয়েছে। উনাদের কিছু জমি ছিলো যা ওয়াকফ করে দেওয়া হয়েছে। বরকতের মা হাসিনা বেগম মুক্তিযুদ্ধের পর এদেশে চলে আসেন, গাজীপুরে উনার কবর রয়েছে। বাবার কবর ওই দেশেই। বরকতের দুই চাচাত ভাই গাজীপুরে বসবাস করছেন, সরকার তাদের জমি দিয়েছে। সব মিলিয়ে আমরা এখনও অনেক কিছু সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে সংগ্রহ করা সেসব ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট জাদুঘরে প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

প্রসঙ্গত, ভাষা শহীদ আবুল বরকতের জন্ম ১৯২৭ সালের ১৬ জুন ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায়। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে আবুল বরকত ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। ভাষা আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন তিনি স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। সেই সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে মিছিলে সামিল হয়। বায়ান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে বর্তমান শহীদ মিনার এলাকায় পাকিস্তানি পুলিশ মিছিলকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে মারাত্মকভাবে আহত হন অনেকে। সেদিনের মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সালাম, জব্বার, রফিক, সফিক, সফিউর, আবুল বরকত, আব্দুল আউয়াল, অহিউল্লাহ (কিশোর) ও সিরাজুদ্দিনসহ নাম না জানা আরও অনেকে।

আমতলা থেকে ইউনেস্কোর আরও খবর:
‘ভাষা আন্দোলন থেকেই বাংলাদেশ, বাংলার স্বাধীনতা’
ভাষার মাস শুরু
‘২০০ টাকার লোভে জামায়াতে যোগ দেয় গোলাম আযম’
ভাষা আন্দোলনে বামপন্থীরা ছিল মুখ্য ভূমিকায়
অতঃপর কবি এসে মেলার উদ্যান অংশে দাঁড়ালেন
একুশের প্রথম কবিতার রচয়িতার নামে চসিকের লাইব্রেরি
কিভাবে তৈরি হয়েছিল একুশের সেই অমর গান?
বছরজুড়ে ১৫০০ কোটি টাকার ফুল বাণিজ্য
‘বাপ-মা নেই’ দেশের কোনো শহীদ মিনারেরই

সারাবাংলা/ইএইচটি/রমু

আমতলা থেকে ইউনেস্কো ভাষা আন্দোলন শহীদ বরকত শহীদ বরকত স্মৃতি জাদুঘর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর