Wednesday 20 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘হাসপাতালই ভুগছে ক্যানসারে’, বন্ধ এক্সরে-এমআরআই-রেডিওথেরাপি

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০০:০৯

ঢাকা: সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীরা আসেন রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। তবে প্রতিষ্ঠানটির ছয়টি রেডিওথেরাপি মেশিনের মধ্যে গত সপ্তাহ পর্যন্ত মাত্র একটি দিয়ে সেবা দেওয়া হচ্ছিল। সেই একটি মেশিনও ১১ ফেব্রুয়ারি নষ্ট হয়ে গেছে।

হাসপাতালের এক্সরে বিভাগের সামনে ঝুলছে তালা। কারণ মেশিন নষ্ট। এমআরআই মেশিনও অকেজো হয়ে আছে। সেখানেও সেবা বন্ধ। রেডিওথেরাপি ভবনের দুটি লিফটই নষ্ট। হাসপাতালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মেশিন সারানোর জন্য প্রকৌশলী থাকার কথা থাকলেও একজন চিকিৎসককে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কবে থেকে রোগীরা চিকিৎসাসেবা পেতে পারে?— সেই বিষয়েও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য নেই।

বিজ্ঞাপন

এমন অবস্থায় কুষ্টিয়া থেকে চিকিৎসা নিতে আসা ক্যানসার রোগী রমিজ উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাসপাতালে সিট পাওয়ার জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যখন সিট পেলাম, শুনি রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট। এক্সরে করতে গিয়ে দেখি সেখানেও তালা। এমআরআই মেশিন নষ্ট। আমি দুর্ভোগ পোহাচ্ছি। বেসরকারিতে তো আর অত টাকা খরচ দিয়ে চিকিৎসা করাতে পারব না। এখানে এসে দেখি হাসপাতাল নিজেই ক্যানসারের রোগী হয়ে গেছে।’

তার আক্ষেপ- ‘টাকা-পয়সার সমস্যায় নাকি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার যন্ত্রপাতিই সারাতে পারে না। তাহলে আমরা এখন কোথায় যাব?’

একই অবস্থা রংপুর থেকে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা ক্যানসার আক্রান্ত আলেজা বেগমেরও। ছয় মাস অপেক্ষার পরে রেডিওথেরাপির সিরিয়াল পেলেও তাতে স্বস্তি নেই। অস্ত্রোপচারের পর রেডিওথেরাপি নিতে গিয়ে জানতে পারেন সেবা বন্ধ আছে। কারণ সব মেশিন অকেজো।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি থেকেই দুর্ভোগের শুরু। ভর্তি হওয়া গেলেও দেখা যায় বিভিন্ন বিভাগের নাকি মেশিন নষ্ট। ছয় মাস পরে সিরিয়াল পেলেও এখন শুনছি সব রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট।’

তিনি বলেন, ‘ছয় মাস অপেক্ষা করে হাসপাতালে প্রথমে ভর্তির জন্য সিট পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন ভর্তি হলেও রেডিওথেরাপি নিতে পারছি না। কবে যে চিকিৎসা শুরু হবে তার অপেক্ষায় আছি।’

মঙ্গলবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়— এক্সরে বিভাগের সামনেই ঝুলছে তালা। সেখানে থাকা রোগীদের স্বজনেরা জানালেন মেশিন নষ্ট থাকায় তারা সেবা নিতে পারছেন না। তার পাশেই থাকা এমআরআই মেশিন নষ্ট থাকার কারণে সেখানেও সেবা বন্ধ আছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একজন চিকিৎসক জানান, হাসপাতালে থাকা ছয়টি রেডিওথেরাপির মেশিনের মধ্যে ৫টিই নষ্ট ছিল। বাকি একটাও নষ্ট হয় ১১ ফেব্রুয়ারি। আর তাই রেডিওথেরাপি সেবা বন্ধ। এছাড়াও রেডিওথেরাপির চারটি লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিনের মাঝে দুটির আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। একটি ব্র্যাকিথেরাপি দেওয়ার জন্য যন্ত্র চালু থাকলেও দুটি কোবাল্ট-৬০ বাতিল করা হয়েছে।

তিনি জানান, এটি নতুন কোনো বিষয় না। এখানে গত বছরখানেক ধরেই নষ্ট যন্ত্রপাতির একটি লম্বা তালিকা হয়ে গেছে। কিন্তু সারানো হয় না। একটি রেডিওথেরাপি মেশিন চালু থাকায় তা দিয়ে ১০০ থেকে ১১০ জন রোগীকে থেরাপি দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল। কিন্তু সেটিও তিন-চারদিন আগে নষ্ট হয়ে গেছে।

তিনি আরও জানান, হাসপাতালে যারা রেডিওথেরাপি নিতে আসেন তাদের একটা দীর্ঘ সিরিয়াল বা অপেক্ষা করে আসতে হয়। কারণ এখানে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকায় রেডিওথেরাপির কোর্স সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে এই কোর্স সম্পন্ন করতে খরচ হয় প্রায় দুই লাখ টাকার কাছাকাছি বা এরও বেশি।

রেডিওথেরাপি বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, যারা জরায়ুর ক্যানসারে আক্রান্ত তাদের ২৫টি রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়ে থাকে। এছাড়া স্তন ক্যানসারে ১৫টি এবং মস্তিষ্কের ক্যান্সারের জন্য ২৫টি রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হয়ে থাকে। কিন্তু গত কয়েকদিন সম্পূর্ণভাবে রেডিওথেরাপি বন্ধ থাকায় রোগীদের অপেক্ষার প্রহর বাড়ছেই আর সেই সঙ্গে যাদের সিরিয়াল পেছনে তাদের জন্যেও দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে।

এই কর্মকর্তা আরও জানান, প্রতিদিন হাসপাতালের বহির্বিভাগে ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী চিকিৎসা নেওয়ার জন্য আসে। তাদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট দেখার জন্য হাসপাতালের একটি বোর্ড আছে। সেই মেডিকেল বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয় কোন ধরনের চিকিৎসা করা হবে। এক্ষেত্রে সার্জারি হবে নাকি রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি দেওয়া হবে নাকি রোগীর সবগুলোই প্রয়োজন সেগুলোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে। এরপরে সার্জারি বা কেমোথেরাপি হলে একটি দিন নির্ধারণ করে দেয় বোর্ড।

তিনি জানান, বিপত্তি শুরু হয় রোগীর রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হলে। এক্ষেত্রে বোর্ড জানিয়ে দেয় মেশিন স্বল্পতার কারণে এখানে চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে ছয় থেকে সাত মাস বা তার চাইতেও বেশি পরের তারিখ দেওয়া হয়ে থাকে। এমনিতেই দেখা যায় আমাদের দেশে ক্যানসার আক্রান্ত অনেক রোগীই চিকিৎসা নিতে আসেন দেরিতে। তার উপর ছয় থেকে সাত মাস অপেক্ষা তাদের জন্য বিপদ বয়ে আনে।

তিনি আরও জানান, কোন জায়গায় দেওয়া হবে রেডিয়েশন?- সেটা খুঁজে বের করার জন্য যে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় সেগুলোও এখন অকেজো হয়ে পড়ে আছে। তাই অ্যানাটমিক্যাল পজিশন থেকে এক্সরে বা সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট দেখে রেডিয়েশন দেওয়া হয় এখানে। কিন্তু সেই এক্সরে মেশিনও অকেজো বর্তমানে।

কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানা যায়, হাসপাতালের যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রকৌশলীর পরিবর্তে একজন চিকিৎসককে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ডা. ইফতেখারউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘ত্রুটির বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আজকে ইঞ্জিনিয়ার এসেছিলেন। দুই-একদিনের মাঝেই আশা করি চিকিৎসা শুরু করা যাবে।’

কবে নাগাদ রোগীদের রেডিওথেরাপি দেওয়া শুরু হতে পারে?— এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে রাজি হন নি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নিজামুল হক।

তবে ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যানসার দিবসের আগে তিনি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন।

ডা. নিজামুল হক বলেন, ‘আমি মাসখানেক আগেই এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে এসেছি। এখন সব সমস্যা সমাধানে কাজ করছি। এখানে রেডিওথেরাপি দিতে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়। আমাদের একটি রেডিওথেরাপি মেশিন সচল আছে। একটি মেশিন মেরামত যোগ্য এবং খুব দ্রুতই সেটি মেরামত করা হবে। কোম্পানি পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার কারণে তবে মেরামতে দেরি হচ্ছে। বাকি চারটি মেশিন সরকার এরইমধ্যে বাতিল ঘোষণা করেছে, মানে এগুলো অকার্যকর।’

সারাবাংলা/এসবি/একে

ক্যানসার চিকিৎসা ক্যানসার হাসপাতাল সরকারি হাসপাতাল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর