কাগজে-কলমে কমেছে খেলাপি ঋণ, প্রকৃত চিত্র ‘ভয়াবহ’
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১০:০৬
ঢাকা: ঋণ গ্রহীতাদের নানামুখী ছাড় দেওয়ার কারণে দেশে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কমেছে। তবে প্রকৃত চিত্র ‘ভয়াবহ’ বলে মন্তব্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদায়ী বছরের শেষ প্রান্তিকে (সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর-২০২২) খেলাপি ঋণের হার নিম্নগামী। কিন্তু এই ঋণের হার নিম্নগামী হওয়ার কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন সুবিধা। এখন ঋণ কিস্তির ৫০ শতাংশ অর্থ জমা দিলে খেলাপি হচ্ছেন না কেউ। আগে খেলাপির তালিকা থেকে বাদ পড়তে কিস্তির ৭৫ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হতো।
এই সুবিধার কারণে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে যেখানে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা; তা একই বছরের ডিসেম্বর শেষে কমে দাঁড়ায় এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকায়। এই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের চেয়ে ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমেছে ১৩ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল রোববার (১৯ ডিসেম্বর) প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বিদায়ী ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। মোট ঋণের ৮.১৬ শতাংশই খেলাপি।
একবছর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিলো ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। সে সময়ে এটি ছিলো মোট ঋণের ৭.৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক থেকে ডিসেম্বর প্রান্তিক পর্যন্ত তিন মাসে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৪১ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। একই সময়ে অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমেছে ১৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। একইসময়ে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) ঘাটতি কমেছে দুই হাজার ৫২০ কোটি টাকা। আলোচিত সময়ে খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দ ঋণের পরিমাণ ৮৮.৬৭ শতাংশ বা এক লাখ ৬ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, দেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে ৪৬.৭৯ শতাংশই সরকারি ব্যাংকগুলোর। এসব ব্যাংকগুলোর খেলাপির পরিমাণ ৫৬ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২০.২৮ শতাংশ। এটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে খেলাপির পরিমাণ তিন শতাংশ স্ট্যান্ডার্ড। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের ঋণের সব অর্থ পেতে সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে এবং বেসরকারি ব্যাংকে ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার শর্ত দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে ব্যাংক খাতের প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের কথা ছিল ৮৪ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে সক্ষম হয়েছে ৭৩ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। ঘাটতি রয়েছে ১১ হাজার ৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৮ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা বা মোট প্রভিশন ঘাটতির ৮০ শতাংশ। এছাড়া দুই হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের পরিবর্তে ঋণ যাতে দিতে না হয় সেজন্য একের পর এক সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে সুদ কমিয়ে পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার ঋণের কিস্তির পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
এছাড়াও আইএমএফ‘র শর্তের কারণে খেলাপি ঋণ যাতে না বাড়ে সেজন্য নানান ধরনের শর্ত শিথিল করা হয়েছে। এসব কারণে দেশে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে। বাস্তবে খেলাপি ঋণ কমার কোনো কারণ নেই, বলেও জানান তিনি।
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘করোনার কারণে গত এক, দুই বছর ঋণ গ্রহীতারা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও কিছু বলেনি। ক্ষেত্রবিশেষে সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। সঠিক হিসাব করা হলে দেশের খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ হতে পারে।’
সারাবাংলা/জিএস/এমও