Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চট্টগ্রামে অর্ধেকের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই শহিদ মিনার

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১০:৫৮

চট্টগ্রাম ব্যুরো: শৈশবে পাঠশালায় পা দিয়েই শহিদ মিনার দেখে ইতিহাসের পাঠ নেবে কোমলমতি শিশুরা, এমন চাওয়া শিক্ষাবিদ-সংস্কৃতিজনদের। অথচ চট্টগ্রামের অর্ধেকেরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই শহিদ মিনার। কোথাও জায়গা সংকট, কোথাও আবার নেই সরকারি বরাদ্দ, কোথাও উদ্যোগের অভাব।

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া শহিদদের স্মরণে শ্রদ্ধা জানানো হলেও নিজ দেশের এসব বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। কোনো কোনো বিদ্যায়তনে ককশিট, বাঁশ-কাঠ, কলা গাছ, কাগজ-কাপড়ে নিজেরাই শহিদ মিনার বানিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। আবার কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যেতে হয় পাশের কিংবা দূরের প্রতিষ্ঠানে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কিংবা বাঙালির সংস্কৃতির চর্চা তো আরও দূরে!

বিজ্ঞাপন

প্রাচুর্য বিশ্বাস নগরীর নন্দনকাননে সরকারি ন্যাশনাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। প্রাচুর্যরা গত দুই বছর ধরে জাতীয় দিবসে ককশিট দিয়েই শহিদ মিনার বানিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসছে। প্রাচুর্য সারাবাংলাকে বলে, ‘আমাদের স্কুলে শহিদ মিনার নেই, ফুলকিতে আছে, সেন্টমেরিসে আছে, কষ্ট লাগে।’

সরকারি ন্যাশনাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বদরুন্নেছা খানম সারাবাংলাকে বলেন, ‘অর্থ বরাদ্দ নেই। আমরা কী করতে পারি! দুই বছর ধরে শিক্ষার্থীরা ককশিট দিয়ে শহিদ মিনার বানিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। তবে এবার মনে হয় কিছু অর্থ পাবো। সামনের বছর নিজেদের শহিদ মিনারে ফুল দিতে পারবো আশা করি।’

সরকারিভাবে প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলো পালনের নির্দেশনা আছে। শিক্ষকরা বলছেন, সেই নির্দেশনার অর্থ যদি হয় শিক্ষার্থীদের দিবসের তাৎপর্য, ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া, তাহলে এর প্রথমধাপ শহিদ মিনারই তো নেই!

বিজ্ঞাপন

মো. ফারহান পড়েন আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণিতে। এই বিদ্যালয়েও শহিদ মিনার নেই। ভর্তির পর থেকে কখনোই শহিদ মিনারে ফুল দিতে পারেনি ফারহান। জাতীয় দিবসগুলোতে বিদ্যালয়ে এসে শিক্ষকদের বক্তব্য শুনেই প্রতিবার ফিরতে হয় তাকে বাসায়।

আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাজী সুলতানা শাহিন বলেন, ‘আমাদের শহিদ মিনার করার জায়গা নেই। স্কুলের সীমানার বাইরে তো কিছু করা সম্ভব নয়। পাশে উচ্চ বিদ্যালয়ের শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে আমরা ভাষা শহিদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।’

নগরীর সল্টগোলায় বেগমজান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এ কে এম মাহমুদুল হক বলেন, ‘অর্থের বরাদ্দ না থাকায় স্কুলে শহিদ মিনার করা হয়নি। তবে শহিদ দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলোতে স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমরা বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও আলোচনা সভার আয়োজন করি। এছাড়া শহিদদের আত্মার শান্তি কামনায় দোয়া মাহফিলের আয়োজন করি। প্রত্যেক স্কুলে স্কুলে শহিদ মিনার থাকুক, সেটা আমিও চাই।’

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ২ হাজার ২৬৯টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৬৪টিতে নেই শহিদ মিনার।

চট্টগ্রাম নগরীতেই ২১৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৮২টিতে শহিদ মিনার নেই। আর উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ২ হাজার ৫৪টি। শহিদ মিনার আছে ৫৭২টি বিদ্যালয়ে। বাকি ১ হাজার ৪৫৮টিতে শহিদ মিনার নেই।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. শহিদুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘শহিদ মিনার করতে সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে জায়গা। সরকারিভাবে অর্থ বরাদ্দও সেভাবে হয় না। অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে অনেকসময় শহিদ মিনারও যুক্ত করা হয়। নিজস্ব উদ্যোগে অনেক বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার হচ্ছে। আবার সরকারিভাবেও কিছু স্কুলে শহিদ মিনার নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন।’

প্রত্যেক বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার বাধ্যতামূলক করা উচিৎ বলে মনে করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘শহিদ মিনার তো শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক। জাতির গৌরবের-ত্যাগের ইতিহাস যদি শিশুরা ছোটকাল থেকে জানতে না পারে, তাহলে আমরা তো দেশপ্রেমিক প্রজন্ম পাবো না। আমি মনে করি, ছোট করে হলেও সব স্কুলে শহিদ মিনার থাকা উচিত, সেখানে বসে শিক্ষার্থীরা যাতে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে পারে।’

চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সাবেক সচিব অধ্যাপক আবদুল আলীম সারাবাংলাকে বলেন, ‘একুশ আমাদের সাহস। একুশ থেকেই বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের বীজবপন হয়েছে। যার ফল আমরা পেয়েছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। একুশের সেই চেতনার সঙ্গে যদি এ প্রজন্ম পরিচিত হতে না পারে, তাহলে জাতি পথ হারাবে। আমরা এরশাদ আমলে ছাত্র আন্দোলন করার সময় স্কুলে স্কুলে শহিদ মিনার করার দাবি জানিয়েছিলাম। প্রতিটি স্কুলে শহিদ মিনার অপরিহার্য।’

তবে বিদ্যালয়ের চেয়েও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে শহিদ মিনার নির্মাণ করে সব শিক্ষার্থীদের সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন বাধ্যতামূলক করা অনেক গুরুত্ববহ বলে মনে করছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্কুলে স্কুলে শহিদ মিনার হোক, এটা আমার কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। সব স্কুল-কলেজে যদি শহিদ মিনার থাকে, সেখানে সঠিক পরিচর্যার অভাবে সম্মানের চেয়ে অসম্মানই বেশি হবে। প্রত্যেক জেলা-উপজেলায় একটি করে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালে সবাই সেটাতেই জানাবে এবং সরকারি কর্তৃপক্ষ সেটা রক্ষণাবেক্ষণ করবে।’

আমতলা থেকে ইউনেস্কোর আরও খবর:
‘ভাষা আন্দোলন থেকেই বাংলাদেশ, বাংলার স্বাধীনতা’
ভাষার মাস শুরু
‘২০০ টাকার লোভে জামায়াতে যোগ দেয় গোলাম আযম’
ভাষা আন্দোলনে বামপন্থীরা ছিল মুখ্য ভূমিকায়
অতঃপর কবি এসে মেলার উদ্যান অংশে দাঁড়ালেন
একুশের প্রথম কবিতার রচয়িতার নামে চসিকের লাইব্রেরি
কিভাবে তৈরি হয়েছিল একুশের সেই অমর গান?
বছরজুড়ে ১৫০০ কোটি টাকার ফুল বাণিজ্য
‘বাপ-মা নেই’ দেশের কোনো শহীদ মিনারেরই
অযত্ন-অবহেলায় শহীদ বরকত স্মৃতি জাদুঘর
যে বিদ্যালয়ে ‘প্রথম দাঁড়িয়েছিল’ শহিদ মিনার
অর্থের অভাবে থেমে আছে দেশের ‘প্রথম’ শহীদ মিনারের নবনির্মাণ

সারাবাংলা/আইসি/আরডি/এমও

আমতলা থেকে ইউনেস্কো প্রাথমিক বিদ্যালয় শহিদ মিনার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর