বইমেলায় বর্ণমালার স্রোত
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৭:৪৭
চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীরের অকাল প্রয়াণের ঘটনাকে স্মরণে রাখার উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে স্থানে ‘স্মারক দুর্ঘটনা’ নামক স্মৃতি স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে, ঠিক সেই জায়গায় আট/দশজন তরুণীর দেখা মিলল। তাদের প্রত্যেকর পরনে সাদা-কালো রঙের শাড়ি। শাড়ির আঁচলে ‘অ’, ‘আ’, ‘ই’, ‘ঈ’, ‘ক’. ‘খ’, ‘গ’, ‘ঘ’ বর্ণমালার মিছিল।
শামসুন্নাহার হল থেকে বেরিয়ে আসা তরুণীগুলোর গতিপথ দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল, তাদের গন্তব্য বইমেলা। তরুণীগুলোর সামনে, পেছনে, ডানে, বামে হাজার হাজার লোক। তাদের অধিকাংশের গন্তব্য অমর একুশে বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশ। কারও কারও গন্তব্য উল্টা দিকে। হয়তো বা, প্রভাত ফেরির মিছিল শেষে বইমেলায় ঢুঁ মেরে নিজ নিজ ঠিকানায় ফিরছেন তারা।
দুপুর সোয়া ২টায় টিএসসির উত্তর-পূর্ব গেট দিয়ে বেরিয়ে মেট্টোরেল স্টেশনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত মানুষ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। কেউ দোয়েল চত্বরের দিকে যাচ্ছে, কেউ বা দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসির দিকে আসছে। অধিকাংশের পরনে সাদা-কালো শাড়ি, পায়জামা-পাঞ্জাবি।
এদের কারও কারও শাড়ি-পাঞ্জাবিতে বাংলা বর্ণমালা শোভা পাচ্ছে। কেউ কেউ কালো ও সাদা কাপড়ের ওপর বর্ণমালা ব্লক করা মাপলার, চাদর ও উত্তরীয় পরেছে।
বাদ যায়নি শিশুরাও। টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশ পথ দিয়ে বড়দের সঙ্গে মেলায় প্রবেশ করা শিশুদের অনেকেই পরেছে মহান শহিদ দিবসের থিমের সঙ্গে মিল রেখে সাদা-কালো পোশাক। সেগুলোতেও ‘অ’, ‘আ’, ‘ই’, ‘ঈ’, ‘ক’. ‘খ’, ‘গ’, ‘ঘ’ বর্ণমালা। কারও কারও গালে বর্ণমালার উল্কি আঁকা।
যে বর্ণমালার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষেরা জীবন দিতে দ্বিধা করেনি, সেই বর্ণমালার অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন ‘২১শে ফেব্রুয়ারি’ দুপুর বেলা অমর একুশে বইমেলায় যেন বর্ণমালার স্রোত বয়ে যাচ্ছে। শহিদ দিবসের ভাবগাম্ভির্য বজায় রেখে পরা পোশাক-আশাকে বর্ণমালার উপস্থিতি বইমেলায় আলাদা দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে।
কথা হয় বকশিবাজার থেকে বইমেলায় আসা লাবণ্য প্রীতির সঙ্গে। সাদা-কালো শাড়ি পরা লাবণ্য প্রীতি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিশেষ বিশেষ দিবসে বিশেষ বিশেষ পোশাক পরা সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে পোশাক শেষ কথা নয়। এটি বাহ্যিক ব্যাপার মাত্র। মূল বিষয়টা অন্য জায়গায়।’
‘যেমন ধরুন, আজ আমরা বর্ণমালাখচিত পোশাক পরেছি। কিন্তু আমাদের ভেতর যদি ২১’র চেতনা জাগ্রত না থাকে, তাহলে এটা কেবল পোশাকি উৎসব হবে। ২১’কে ধারণ করতে না পারলে এই পোশাকি উৎসবে কোনো ফল বয়ে আনবে না’— বলেন লাবণ্য প্রীতি।
বইমেলার পাললিক সৌরভের স্টলে কথা হয় তরুণ উপন্যাসিক আরিফ শামসুলের সঙ্গে। সাদা পায়জামা, কালো পাঞ্জাবি পরা আরিফ শামসুল সারাবংলাকে বলেন, ‘আজকের দিনটার অন্যরকম একটা আবেদন আছে। আপনি পুরো মেলায় চোখ বুলালে দেখতে পাবেন, প্রায় সবাই পোশাকে একুশের চেতনাকে ধারণ করেছে। এটি তখনই সার্থক হবে, যখন একুশের এই চেতনা পোশাক থেকে মগজে প্রোথিত হবে।’
পরিবাগ থেকে ছোট্ট তাহমিনাকে নিয়ে বইমেলায় এসেছেন মা’ বিলকিস জাহান। মেলায় প্রবেশের সময় উল্কি শিকারীরা তাহমিনার দুই গালে ‘অ’, ‘ক’ বর্ণ এঁকে দিয়েছে। লাল ও সবুজ রঙে আঁকা বর্ণ দু’টি বেশ লাগছে! নিজের চোখে না দেখলেও গালে যে কিছু একটা আঁকা হয়েছে, সেটা ভালোই বুঝতে পেরেছে সাড়ে তিন বছরের তাহমিনা।
গালে কী এঁকেছ?- ‘এক চাচ্চু ‘অ’ লিখে দিয়েছে।’ বই কিনেছ?- মা বলেছে- ওই দিকে (শিশু চত্বর) বাবুদের বই। ওখানে যাচ্ছি। মা অনেকগুলো বই কিনে দেবে।’
কথা হয় তাহমিনার মা বিলকিস জাহানের সঙ্গে। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘একুশ একদিকে যেমন শোকের। অন্যদিকে তেমনি প্রাপ্তির। সে দিকটা বিবেচনা করলে আমরা এ দিনটাকে স্মরণ এবং উদযাপন- দুই ভাবেই দেখতে পারি। দিনটার সঙ্গে নানা আঙ্গিকে নতুন প্রজন্মের যুক্ত হওয়ার বিষয়টি আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখি।’
সারাবাংলা/এজেড/একে