হাওরের বোরো রক্ষায় বাড়তি সতর্কতা
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১০:৪৫
ঢাকা: মার্চের শেষ দিকে ও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে হাওরের বোরো ধান উঠার কথা রয়েছে। একই সময়ে থাকে আগাম বন্যার শঙ্কাও। কোনো কোনো বছর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যায় কৃষকের স্বপ্ন। এতে উৎপাদনের কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণ হয় না বোরোতে। এবার হাওরের বোরো ধান রক্ষায় আরও বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে। এরইমধ্যে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। হাওরের প্রায় ১ হাজারের বেশি বাঁধ সংস্কারে এখন পুরোদমে কাজ চলছে। সতর্ক রয়েছে মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারাও।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সবগুলো বাঁধের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে ড্রোন ভিডিও নিয়ে এসেছি। ১ হাজারের বেশি বাঁধ এবার স্পেশাল মনিটরিং করছি। গত বছরের চেয়ে এবার বাঁধের সংখ্যা বেড়েছে, কারণ গত বছর আগাম বন্যা হয়েছিল। এখন বাঁধগুলো সংস্কারে পুরোদমে কাজ চলছে।’
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি পানিসম্পদ উপমন্ত্রী হাওর ঘুরে এসেছেন। কয়েকদিনের মধ্যে আমিও হাওরে যাবো। আর আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে বেশ কয়েকটি টিম পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণে প্রতিনিয়ত কাজ করছে।’
হাওরের আগাম বোরো সাধারণত মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কাটার উপযোগী হয়ে উঠে। এখন সেখানকার ধানগুলোতে শীষ এসে গেছে। ধানের পরিচর্চায় ব্যস্ত কৃষকরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি বছর সারাদেশে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৪৯ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর। বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত রোপন হয়েছে ৪৪ লাখ ৭ হাজার হেক্টর জমিতে। আবাদে অগ্রগতির হার ৮৮ শতাংশ। এদিকে, হাওরভুক্ত ৭ জেলায় আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৯ লাখ ৪৯ হাজার হেক্টর। আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ৪৭ হাজার হেক্টর জমিতে। হাওরভুক্ত ৭ জেলায় হাওরের বাইরেও হাওরবিহীন এলাকা রয়েছে। সেখানে ৪ লাখ ৯৯ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৯৫ হাজার হেক্টর জমিতে। আর হাওরে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৫৯ হেক্টর হলেও আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে। সব মিলিয়ে আবাদে অগ্রগতির হার ৯৯ শতাংশ। এছাড়া হাওরের ৭৮ শতাংশ ধানের কুঁশি (শীষ) এসে গেছে।
আগাম বন্যার পূর্বভাস সম্পর্কে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের কাছে এক মাসের পূর্বাভাস থাকে। এ বছর মার্চ মাসে এখন পর্যন্ত ভয়ের কিছু নেই। এপ্রিল মাসের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাস এখনও দেওয়া যাচ্ছে না। এপ্রিলের বিষয়টি এক দুই সপ্তাহ পর বোঝা যাবে। কোনো কোনো বছর মার্চের শেষ দিকে আগাম বন্যার শঙ্কা থাকে। এ বছর এখন পর্যন্ত সেই শঙ্কা নেই।’
কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাওরের ফসল যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য আমরা প্রতিবছরই সতর্ক থাকি। সেজন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে স্বল্পকালীন বোরো জাত রোপনের পরামর্শ দিয়ে থাকি। কৃষকরাও স্বল্পকালীন জাত রোপণ করে থাকে। তবে অনেকে নাবি জাত রোপণ করেন। এতে ওইসব ধান হুমকির মুখে পড়ে।’
তিনি বলেন, ‘আগাম বন্যা অনেকটা প্রাকৃতিক। সেটিকে সামনে রেখেই আমাদের চলতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সব সময় সতর্ক থাকে। কৃষি মন্ত্রণালয়ও সতর্ক থাকে। আমরা পাউবোকে পরামর্শ দিয়েছি বাঁধ সংস্কারের। মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সতর্ক অবস্থানে থাকতে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাওরে সঠিকভাবে ধান উৎপাদনের জন্য স্বল্পকালীন ধানের জাত উদ্ভাবনের জন্য চেষ্টা করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। সেখানে যদি উচ্চফলনশীল আগাম জাতের ধান দেওয়া যায়, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই হাওরের বোরো রক্ষা পাবে। বর্তমানেও কৃষক বিভিন্ন স্বল্পকালীন জাত রোপণ করছে, আমরা চাই আরও শর্ট ভেরাইটি, সেই জাতের ধান যাতে আরও বেশি লম্বা হয়। সে লক্ষ্যে ব্রি ও বিনা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘হাওরের আগাম বোরো রক্ষায় এখনই কোন আশার বাণী শোনানো যাবে না। তবে হাওরের ফসল রক্ষায় সবাই সতর্ক রয়েছে। ফসল রক্ষার্থে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই করণীয় বিষয় নির্ধারিত হয়ে থাকে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘যদি আগাম বন্যা চলেই আসে তখন আমরা কম্বাইন্ড হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটার চেষ্টা করি। একসঙ্গে অনেক মেশিন মাঠে লাগিয়ে দিই। অনেক সময় আধা পাকা ও কিছুটা কাঁচা ধানও কেটে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা হাওরের বোরো রক্ষায় সব সময় সতর্ক থাকেন। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়।’
এদিকে, সঠিকভাবে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সুনামগঞ্জের হাওরের ফসল ঘরে তোলার আগ পর্যন্ত সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ছুটি বাতিল করেছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম। ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের নির্মাণ কাজ পরিদর্শন শেষে এ নির্দেশনা দেন তিনি।
এছাড়া ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজ যথাযথভাবে শেষ করার জন্য সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে সুনামগঞ্জের হাওরে কাজ করার নির্দেশনা দেন।
সারাবাংলা/ইএইচটি/এসআই