Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গুলিবর্ষণকারীদের হয়নি বিচার, ৭১ বছর পরও করা যাবে মামলা

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১১:৩১

ঢাকা: ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মহান ভাষা আন্দোলনে নারকীয় হামলার ঘটনায় শহিদ হন সালাম, বরকত, শফিক, জব্বার, সফিউলসহ নাম না জানা অনেকে। একই হামলায় গুরুতর আহত হন ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়া অগণিত বীর সৈনিক। যারা শহিদ হয়েছিলেন তাদের পক্ষে কেউ মামলা করেননি। বরং শহিদ ও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করা হয়। ওইসব মামলায় ভাষা সৈনিকদের একের পর এক গ্রেফতার করা হয়। ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পরও কোন মামলারই সুরাহা হয়নি। শহীদ এবং ভাষা সৈনিক সবার নামেই মামলা চলমান।

বিজ্ঞাপন

রাজধানীর রমনা থানা পুলিশের একজন সদস্য সারাবাংলাকে জানান, ‘নিহতের ঘটনায় ২৩ ফেব্রুয়ারি রমনা থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন শহিদ সফিউরের বাবা শফিকুর রহমান। কিন্তু তার মামলা নেয়নি থানা পুলিশ।’ “সম্ভবত“ শব্দযোগে বলা কথার কোন সত্যতা বা এর সপক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

অবিলম্বে ভাষা সৈনিক ও ভাষা শহিদদের নামে করা মামলা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাদের ভাষ্য, তৎকালীন প্রশাসন ও জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা উচিৎ। তাতে যদি মরোণত্তোর সাজা দিতে হয় তাও যেন হয়।

৫২’র ভাষা আন্দোলনের মামলার বিষয়ে জানতে গত ২৫ জানুয়ারি বর্তমান রমনা থানায় যান সারাবাংলার এই প্রতিবেদক। থানার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানালেন, “আমাদের জানামতে ভাষা আন্দোলনের মামলার কোনো কাগজপত্র থানায় নেই। ডিএমপি গঠিত হয়েছে ১৯৭৬ সালে।  এরপর থেকে মোটামুটি সব মামলার কাগজপত্র রয়েছে। তার আগের কোনো মামলার কাগজপত্র থানায় সংরক্ষিত নেই। আগের মামলার কাগজপত্র পেতে হলে সময় নিয়ে খুঁজতে হবে।”

এরপর ১০ ফেব্রুয়ারি পুনরায় মামলার কাগজপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে থানা কর্তৃপক্ষ কোনো কাগজপত্র দিতে পারেননি। এমনকি মামলার কোনো তথ্য-উপাত্তও দিতে পারেননি।

তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে উঠে এসেছে, “১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভোর থেকেই ১৪৪ ধারা চলছে। তবুও ধর্মঘট পালনকারী ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে অ্যাসেম্বলি হাউসের কাছে জড়ো হয়। ছাত্রদের চিৎকার যেন অধিবেশনে উপস্থিত এমএলএ-রা শুনতে পান। প্রথমে শুরু হলো গ্রেফতার করা। এরপর কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হলো। তারপর গুলি চালানো শুরু হলো মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে। গুলিতে চারজন ঘটনাস্থলেই নিহত হলো। আহত হলো ৩০ জন। জানা যায়, ৬২ জনকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। আরো শোনা যায় পুলিশ কয়েকটি মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে। বেসরকারি সূত্রের দাবি, মৃতের সংখ্যা ১০ থেকে ১১ জন। ”

বিজ্ঞাপন

২২ ফেব্রুয়ারির বর্ণনায় তাজউদ্দীন আহমদ লিখেছেন, “সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর জনসন রোডে মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এটি পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়ে গেছে। আজ স্বতঃস্ফুর্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকল। হাইকোর্ট, মানসী সিনেমা হল ও ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের আশেপাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৫ জন নিহত হবার খবর পাওয়া গেল। বেসরকারি সূত্র অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ১২। আহত বহু।”

তাজউদ্দীনের ডায়েরির বর্ণনা অনুযায়ী, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিল করার অপরাধে পুলিশ মিছিলকারীদের নামে মামলা করে। এরমধ্যে সফিউর, সালাম, অলি আহাদ ও তাজউদ্দীনসহ অনেকের নাম ছিল। ২৩ ফেব্রুয়ারি নাজিরাবাজার লেভেল ক্রসিংয়ে ঢাকার জনতার ওপর লাঠিচার্জ করে এবং অবৈধভাবে জনতাবদ্ধ হওয়ার কারণে মামলা করে পুলিশ। ২৪ ফেব্রুয়ারি এ আর খান, কে আহমদ, আবুল হাশিম, এম জি হাফিজ, জহিরউদ্দীন, মোশতাক, শামসুল হক, কে জি গোলাম মাহবুব, খয়রাত হোসেন, অলি আহমদ খান, আনোয়ারা খাতুন, কুষ্টিয়ার শামসুদ্দিন, অলি আহাদ, তোয়াহা, গোলাম মওলাসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। তাদের অপরাধ তারা ধর্মঘট ডেকেছিল এবং সব ধরণের গাড়ি বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে সামরিক বাহিনী রাত থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছিল। ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার কারণে আবুল হাশিম, খয়রাত হোসেন, আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ, মনোরঞ্জন ধর ও গোবিন্দ লাল ব্যানার্জিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২৬ ফেব্রুয়ারি সলিমুল্লাহ হলে ঘেরাও দিয়ে অভিযান চালায় সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। হাউস টিউটর ড. মফিজউদ্দীন ও ২৩ ছাত্রকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশি অ্যাকশনের পুরো সময় উপাচার্য ও প্রভোস্টকে হলের কাছে আটক রাখা হয়। এরপর মেডিকেল হোস্টেলে অভিযান চালানো হয় সন্ধ্যায়। পুলিশের গুলিতে নিহত রফিকুর রহমানের (রফিকউদ্দীন ওরফে ভাষা শহীদ রফিক) স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত স্তম্ভ সকাল সাড়ে ৯টায় এ কে শামসুদ্দিনের উপস্থিতিতে উদ্বোধন করেন তার পিতা শফিকুর রহমান। পুলিশ স্তম্ভটি ভেঙ্গে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয় এবং একটি একটি করে ইট খুলে ফেলে এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে।

২১ ও ২২শে ফেব্রুয়ারি যারা শহিদ হয়েছিলেন তাদের নিহতের ঘটনায় কি কোনো মামলাই হয়নি? মামলা নিয়ে পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী, গবেষক, ভাষা সৈনিক কেউই পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে পারেননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান এবং ভাষা শহিদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালার পরিচালক অধ্যাপক ড. আবু দেলোয়ার হোসেনের সাথে কথা হয় সারাবাংলার। তিনি বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে যখন কারফিউ জারি করা হয়, কারফিউ ভেঙ্গে ছাত্ররা মিছিল করে, ওই সময়ে অনেকগুলো মামলা করেছিল পুলিশ। তবে গুলিবর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। আর আমি মামলা নিয়ে কোনো কাজ করিনি। গুলিবর্ষণের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। তদন্ত কমিটি একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল। সেই প্রতিবেদন ধরে আমরা কাজ করেছিলাম।

কি ছিল সেই প্রতিবেদনে জানতে চাইলে অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল এমন তথ্য উঠে আসে। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে আইনবিরোধী বিক্ষোভ করেছিল তাও উঠে এসেছিল। পুলিশ মামলা দিয়ে অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করেছিল। তবে কোনো ছাত্রকে পুলিশ নির্যাতন করেনি বলে উঠে আসে তদন্ত প্রতিবেদনে।’

৭১ বছর পর ভাষা শহিদ ও ভাষা সৈনিকদের পক্ষে কেউ মামলা করতে পারবেন কিনা এমন প্রশ্ন ছিল সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের কাছে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশি যে কোনো নাগরিক সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। ওই সময়কার পত্রপত্রিকা, কিছু দালিলিক প্রমাণাদি ঘেঁটে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। মামলা ৭১ বছর নয় ৫০০ বছর পরেও করা যাবে। তবে যথেষ্ট তথ্য লাগবে।’

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় পুলিশ অনেকগুলো মামলা দায়ের করেছিল। ওইসব মামলায় অনেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন। আবার কেউ শহিদ হয়েছেন। ওই মামলাগুলো সমাধান হয়নি। সেক্ষেত্রে কি ভাষা শহিদদের নামে মামলাগুলো কি এখনো চলমান? জানতে চাইলে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘ওই মামলার এখন আর কোনো কার্যকারিতা নেই। কারণ ১৯৭১ সালের পর দেশ পরিবর্তন হয়ে বাংলাদেশ হয়েছে। সরকারও পরিবর্তন হয়েছে। কাজেই ওইসব মামলার সমাধান হলো কি হলো না তা নিয়ে কোনো কাজ নেই।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ২১শে ফেব্রুয়ারির মামলা নিয়ে কোনোদিন আলোচনা হয়নি। সেই মামলার নথিপত্র কোথায় আছে তাও জানি না। হয়তো আছে অথবা নেই। খোঁজ নিতে হবে। তবে দীর্ঘ সময়ের দরকার পড়বে। এখন নতুন করে কেউ মামলা করতে আসলে দেখা হবে মামলা নেওয়ার মতো কোনো যৌক্তিকতা রয়েছে কিনা? এই বিষয়টি তো এখন রাষ্ট্রীয় বিষয়। তাই রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিলে মামলা যে কেউই করতে পারবে।

আমতলা থেকে ইউনেস্কোর আরও খবর:
‘ভাষা আন্দোলন থেকেই বাংলাদেশ, বাংলার স্বাধীনতা’
ভাষার মাস শুরু
‘২০০ টাকার লোভে জামায়াতে যোগ দেয় গোলাম আযম’
ভাষা আন্দোলনে বামপন্থীরা ছিল মুখ্য ভূমিকায়
অতঃপর কবি এসে মেলার উদ্যান অংশে দাঁড়ালেন
একুশের প্রথম কবিতার রচয়িতার নামে চসিকের লাইব্রেরি
কিভাবে তৈরি হয়েছিল একুশের সেই অমর গান?
বছরজুড়ে ১৫০০ কোটি টাকার ফুল বাণিজ্য
‘বাপ-মা নেই’ দেশের কোনো শহীদ মিনারেরই
অযত্ন-অবহেলায় শহীদ বরকত স্মৃতি জাদুঘর
যে বিদ্যালয়ে ‘প্রথম দাঁড়িয়েছিল’ শহিদ মিনার
অর্থের অভাবে থেমে আছে দেশের ‘প্রথম’ শহীদ মিনারের নবনির্মাণ
চট্টগ্রামে অর্ধেকের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই শহিদ মিনার

সারাবাংলা/ইউজে/রমু

আমতলা থেকে ইউনেস্কো গুলিবর্ষণকারী ভাষা আন্দোলন মহান ভাষা আন্দোলন মামলা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর