গুলশানের ভবনে আগুন ও ২ জনের মৃত্যু কী বার্তা দিলো?
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:৪৭
ঢাকা: রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরের ১০৪ নম্বর সড়কের ২ নম্বর হোল্ডিংয়ের ১৪ তলা ভবনের ১১ তলায় আগুন লাগে রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায়। এক পর্যায়ে আগুন ভবনের ১২ তলায় ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের প্রায় চার ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। অগ্নিকাণ্ডের সময় ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যান দুইজন।
একইভাবে আহত হয়েছেন কয়েকজন।
অগ্নিকাণ্ডের পরদিন আগুন লাগার কারণ জানতে ভবনটি পরিদর্শন করে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ একাধিক রাষ্ট্রীয় সংস্থা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ভবনটি নির্মাণের সময় ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি অনাপত্তিপত্র (এনওসি) নেওয়া হলেও ছিল না কোনো অগ্নি নিরাপত্তা সনদ। তবে ভবনটিতে জরুরি নির্গমন পথসহ অগ্নি নিরাপত্তায় প্রচলিত সব ব্যবস্থাই ছিল। ভবনটি নির্মাণে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় খুঁজে পায় নি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। বিল্ডিং কোড মেনে ভবনটি তৈরি করা হলেও সেখানে দেখা যায় গ্যাসের পয়েন্টের পাশেই ছিল বিদ্যুতের পয়েন্টও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নিনির্বাপণের জন্য সব কিছু থাকলেও ভবনটিতে যারা বাস করতেন তারা কেউই জানতেন না তার ব্যবহার। ভবনে আগুন লাগার পরে প্রাথমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা তাই সেখানে করা যায় নি। ভবন থেকে বের হওয়ার জন্য জরুরি নির্গমন পথ ব্যবহার না করে লিফটের ব্যবহার ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। আর যে দুইজনের প্রাণহানি হয়েছে ভবন থেকে লাফ দেওয়ার কারণে। রাজধানীর গুলশানের মতো এলাকায় ভবনে আগুন লাগার পরে শুরুর দিকে স্বেচ্ছাসেবকদের ঢুকতে না দিয়ে মূল গেইট বন্ধ করে দেওয়া ছিল আরেকটি আত্মঘাতী বিষয়। এর ফলে ফায়ার সার্ভিস আসার আগেই আগুন ছড়ানোর সুযোগ পেয়েছে বেশি।
অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতি এড়ানোর জন্য পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই সময় এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস বিভাগসহ নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া খুবই জরুরি। একইসঙ্গে নাগরিকদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিতে হবে। বহুতল ভবনের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে খুব দ্রুত এর নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়াটাও জরুরি।
অগ্নিকাণ্ড নিয়ে ভবন সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর গুলশান ২ নম্বর এলাকার ১০৪ নম্বর সড়কের ১৪ তলা ওই ভবনে আগুন লাগে। বহুতল এই ভবনে আগুন লাগার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেজে উঠে সতর্কসংকেত (অ্যালার্ম)।
ভবনের নিরাপত্তাকর্মী রায়হান উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘অ্যালার্ম বাজলেও অনেকে শোনেনি। যারা শুনেছে তাদের কেউ কেউ তেমন গুরুত্ব দেয়নি। অনেকে অ্যালার্ম শোনার সঙ্গে ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে বের হয়ে লিফটে করে নিচে নেমে আসেন।
বহুতল এই ভবনের নির্মাণ প্রকৌশলী মাহফুজুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, যেদিন আগুন লাগে সেদিনের সবকিছুই আমরা শুনেছি। এখানে সবধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তাও দুইজনের প্রাণহানির বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক।
তিনি বলেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যালার্ম বেজেছে। সেটা শুনে যারা নিচের তলার দিকে ছিলেন, তারা নেমেছেন। তবে তাদের অনেকেই লিফটে নিচে এসেছেন বলে জানিয়েছেন আমাকে। কিন্তু আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে জরুরি নির্গমন সিড়ি ব্যবহার করার দরকার। আর সেটি কেউ করে নি।
তিনি আরও বলেন, কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা জানান, তারা ভেবেছিলেন ‘ফলস অ্যালার্ম’ বাজানো হয়েছে। আর তাই তারা বিষয়টি গুরুত্ব দেননি। আগুনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পরে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তার আগেই আসলে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে।
জরুরি পরিস্থিতির জন্য ফায়ার ড্রিল করার মতো গার্ড ও বাসিন্দারা প্রশিক্ষিত ছিলেন কি না এমন প্রশ্নের উত্তর তিনি কোনো কিছু জানাতে পারেন নি।
রাজউক কী বলছে?
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অঞ্চল-৪–এর পরিচালক এ কে এম মকসুদুল আরেফীন বলেন, বিধি মোতাবেক ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। অনুমোদন অনুযায়ী ভবনটির দুটি বেজমেন্টসহ ১৪ তলার নির্মাণ অনুমোদন দিয়েছে রাজউক। আর ওই বছরের শেষের দিকে ভবনমালিকের পক্ষ থেকে বসবাস সনদ বা অকুপেন্সি সার্টিফিকেটও নেওয়া হয়।
তিনি বলেন, সাধারণত ভবনের সবকিছু ঠিক থাকলে অর্থাৎ প্রচলিত বিধিবিধান মেনে ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করলেই বসবাস সনদ সরবরাহ করে রাজউক। ভবনটিতে জরুরি নির্গমন পথসহ অগ্নিনিরাপত্তায় প্রচলিত সব ব্যবস্থাই ছিল। আর তাই এখানে কোনো অনিয়ম খুঁজে পায়নি রাজউক।
ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা সনদ ছিল না: ফায়ার সার্ভিস
গুলশানের ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি করে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। এই তদন্ত কমিটির প্রধান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘ভবনটি নির্মাণের সময় একটি অনাপত্তিপত্র বা এনওসি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপরে আর কোনো আপডেট করা হয়নি। ভবনটির অগ্নিনিরাপত্তা সনদ ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার পরে তা খুব দ্রুত ছড়িয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এখানে প্রতিটা ফ্লোরে থাকা ফ্ল্যাটগুলোর সাজসজ্জায় প্রচুর পরিমাণে দাহ্য বস্তু ব্যবহার করা হয়। এমনকি যেসব প্লাইউড বা বোর্ড ব্যবহার করা হয় ইন্টেরিয়রের কাজে সেগুলোও কিন্তু দাহ্য পদার্থ। তবে এটা আগুন ছড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে, লাগার কারণ নাও হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগুন বিভিন্ন কারণে লাগতে পারে। কারণ এখানে প্রায় প্রতিটি জিনিসই পাশাপাশি অবস্থানে রয়েছে। গ্যাসের পয়েন্ট আছে যেখানে, তার পাশেই বিদ্যুতের পয়েন্টও রয়েছে। কোনটা থেকে আগুনটা শুরু হয়েছে, এটি বোঝা যাচ্ছে না।’
ঘটনাস্থলে একাধিকবার গেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘সব নিয়ম মেনেই ভবনটি করা হয়েছে। কিন্তু তাও আগুন লেগেছে। জরুরি পরিস্থিতির জন্য ফায়ার ড্রিল করার মতো গার্ড ও বাসিন্দারা প্রশিক্ষিত ছিলেন কি না তা এখন পর্যন্ত কেউ জানাতে পারেনি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় এসব বিষয়ে আদৌ প্রশিক্ষণ থাকে না।’
দুইজনের মৃত্যু আগুন লাগার কারণে নয়
গুলশানের বহুতলবিশিষ্ট ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় দুইজনের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে দুইজনের কেউই অগ্নিকাণ্ডে মারা যাননি। তারা বিল্ডিং থেকে লাফ দেওয়ার কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা গেছে। একইভাবে এই ঘটনায় আহত হয়ে বর্তমানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে আছেন শামা রহমান। ভবন থেকে লাফ দেওয়ার কারণে তার একাধিক স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে চিকিৎসকরা। বর্তমানে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে মেডিক্যাল বোর্ড গঠনের মাধ্যমে।
উৎসুক জনতার ভিড়ে আগুন নেভাতে বিপত্তি
আগুন লাগার সংবাদ পাওয়ার ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের একাধিক ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও উৎসুক জনতার ভিড়ের কারণে কাজে ব্যাঘাত ঘটে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ‘উৎসুক জনতার কারণে আমাদের কাজ করতে খুব কষ্ট হয়েছে। উৎসুক জনতা আমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছে। মানুষের কারণে রাস্তায় অনেক ভিড় ছিল।’
ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আরও আগে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারতাম। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে আমরা চেষ্টা করছি, আর সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। বিপদের সময় আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, উদ্ধার কাজে রাস্তাটা ছেড়ে দিতে হবে, আবেগ দিয়ে সব কিছু হয় না। ফায়ার ব্রিগেড তাদের প্রটোকল অনুযায়ী স্টেপ বাই স্টেপ কাজগুলো করছে। আগুনটা যদি আমরা আরও আগে নেভাতে পারতাম, আমাদের আহত আরও কম হতো।’
গুলশানের আগুন দিলো ভবিষ্যতের সতর্কবার্তা
গুলশানের বহুতল ভবনে আগুন লাগার পরে সেখানে থাকা জরুরি নির্গমন সিঁড়ি ব্যবহার না করে লিফটে নামার চেষ্টা আত্মঘাতী ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি সব ধরনের নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ এবং অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকার পরও অগ্নিকাণ্ডে দুইজনের প্রাণহানি ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার পরামর্শ তাদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত যদি কোনো বস্তিতে আগুন লাগে তখন দেখা যায় আশেপাশের সবাই সেটা নেভাতে ছুটে আসছে। কিন্তু গুলশানের ভবনের পাশের ভবনের অসহযোগিতার বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। একইসঙ্গে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে না তোলার বিষয়টি আরেকটি বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে। আর তা হলো শুধু নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ ও আধুনিক অগ্নি নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকলেই হবে না, সেগুলো যথাযথভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অগ্নিনিরাপত্তা বিধিগুলোর সঙ্গে নাগরিকদের সচেতন করে তোলা ও অগ্নিকাণ্ড হলে কীভাবে নিরাপদে ভবন থেকে বের হয়ে আসা যাবে, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়াও জরুরি।
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘জরুরি পরিস্থিতিতে সিঁড়ি ব্যবহার করা অবশ্যম্ভাবী বা অবশ্যই করণীয়। এক্ষেত্রে কোনোভাবেই লিফট ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। সে কারণে জরুরি পরিস্থিতির জন্য জরুরি সিঁড়ির সংস্থান এমনভাবে করা থাকে যাতে করে তা লিফট এড়িয়ে যাওয়া যায়।’
তিনি বলেন, ‘এই বিষয়গুলো বাড়বার প্রশিক্ষণ বা মহড়ার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন এবং কার্যকর করে প্রস্তুত করার একটি ব্যবস্থাপনা রয়েছে। সে কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নিয়মিত এবং আকস্মিক মহড়ার মধ্য দিয়ে মানুষের মনোগত এবং অভ্যাসগত চর্চায় নিয়ে আসা হয়। মনে রাখতে হবে যে কেউ যদি জানে কোথায় সিঁড়ি রয়েছে বা সেখানে কিভাবে যেতে হবে জরুরি পরিস্থিতিতে ঠাণ্ডা মাথায় সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কঠিন। কেউ যদি অন্ততপক্ষে বার দশেক সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে থাকে তার ক্ষেত্রে যাওয়াটা সহজ হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সব বয়স, অতিরিক্ত বয়স্ক অথবা শিশু অথবা অল্প শিক্ষিত মানুষেরা যেনো জরুরি পরিস্থিতিতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিজেদের উদ্ধার করতে পারে সেজন্য প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। এই কারণেই বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স এবং সিটি করপোরেশনের এই সমস্ত ব্যবস্থাপনা প্রতি বছর নিয়মিত মহড়ার মাধ্যমে করা হচ্ছে কিনা সেই ব্যাপারে সতর্ক পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হয়।’
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত এক দশকে প্রচুর উঁচু-ভবন তৈরি হয়েছে যা আসলে ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণত ছয় তলা ভবনে আগুন লাগলে তাতে তেমন বেশি মৃত্যুর ঘটনা শোনা যায় না। কিন্তু যখনই উঁচু ভবন হবে তখন যত প্রকার নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট উপকরণই থাকুক না কেনো সেটা আসলে সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। এইসব বিল্ডিংগুলো যখন ডেভেলপার বা ভবন মালিকেরা বানিয়ে থাকেন তখন সেখানে ফায়ার কমপ্লায়েন্স কতটুকু আছে তা একটা বিবেচনায় নেওয়ার মতো বিষয় থাকে।’
তিনি বলেন, ‘নাগরিকদের যদি অগ্নিকাণ্ড থেকে বাঁচার জন্য নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ করা থাকে তবে দেখা যাবে যে একটা লেভেল পর্যন্ত কিছুটা সুরক্ষা থাকতে পারে। কিন্তু আলটিমেটলি যে আসলে সেই প্রশিক্ষণ নেওয়ার ফলে তিনি একদম সুরক্ষিত বিষয়টি তেমনও না। কারণ আগুন লাগার পরে যখন তার মাত্রা হঠাৎ করে বাড়ে তখন আসলে সব অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কাজ নাও করতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বহুতল ভবনে সেই সাপ্রেশন ব্যবস্থা বা ফায়ার ড্রিল সিস্টেম থাকে না। সব মিলিয়ে আমাদের এই বহুতল ভবনগুলো আসলেই খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এর সঙ্গে যোগ করতে চাই, নগরীতে আমরা এমনেই বিচ্ছিন্নই থাকি। এক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক যে প্রস্তুতি বা দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য যে মানসিক শক্তি সেটা এই রাজধানীর খোপের মধ্যে বসবাস করা নাগরিকদের নেই। এটিই ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়িয়ে তোলে।’
তিনি বলেন, ‘আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই না। গুলশানের ভবনের আগুনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেখানে মালিকপক্ষ থেকে গেইট আটকে রাখা হয়। পাশের ভবনের মালিকের পক্ষ থেকে অসহযোগিতা ছিল। এমন অনেক কিছুই কিন্তু সামনে এসেছে। এটা হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে আমাদের এই নগরেই নাগরিকরা একে অপরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন। আর এই উঁচুতলা ভবনের সংস্কৃতি এই বিচ্ছিন্ন হওয়াটা আরও বাড়িয়ে দেয়। নগরীতে যারা পরিকল্পনা করে বা আমরা যারা হাউজিং নিয়ে পড়াই বা গবেষণা করি তাদের একজন হিসেবে আমি মনে করি যে রেসিডেন্সিয়াল ডেভেলপমেন্ট মডেল আসলে প্রশ্নবিদ্ধ কিছু কারণে। এটি আসলে সাস্টেইনেবল কোনোভাবেই না।’
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, ‘প্রতি বছর সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে নবায়নযোগ্য কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা করা যেখানে ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সসহ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্যান্য সংস্থাগুলো যুক্ত থাকবে যাতে করে যে সমস্ত জায়গা থেকে আগুন লাগতে পারে সেটা সুইচ বোর্ড হোক বা শর্ট সার্কিটের বিভিন্ন জায়গা হোক বা এইচডিবি বোর্ড বা ডিবি বোর্ড হোক, ডিস্ট্রিবিউওশন বোর্ড হোক অথবা গ্যাসের সংযোগ বা লিফট – এগুলোর প্রতি বছর সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘কেউ একবার বিদ্যুতের সংযোগ লাগিয়েছে বা গ্যাস সংযোগ লাগিয়েছে অথবা লিফট লাগিয়েছে বলে বছরের পর বছর তার অবস্থা কী আছে বা কি হয়েছে সেটা যথেষ্ট পুরনো বা সেগুলো বিপজ্জনক বা অভিঘাত সম্পন্ন হলো কিনা তা পরীক্ষা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে আমলে নিয়ে কাজগুলো করা হচ্ছে না যা বিপজ্জনক পরিস্থিতির কারণ হতে পারে। আর তাই এগুলো আমলে নিয়ে পরিকল্পিত ভাবে কাজ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রয়োজন খুবই।’
‘আমরা এফআর টাওয়ার অগ্নিকাণ্ড থেকে শুরু করে বারবার একথাগুলো বলে যাচ্ছি। কিন্তু সেই কাজগুলো হচ্ছে না। যদি এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সিটি করপোরেশনগুলোর নেতৃত্বে ফায়ার ব্রিগেড সিভিল ডিফেন্স ও অন্যান্য সেবা সংস্থার মাধ্যমে সরকার জরুরি ভিত্তিতে ফি বছর মেয়াদী নবায়নযোগ্য কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা করে এবং প্রতিটি ভবনে এটা বাধ্যতামূলক করে যে বছরের অন্তত ছয়বার ফায়ার ব্রিগেড সিভিল ডিফেন্সের তত্ত্বাবধানে মহড়ার ব্যবস্থা করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। তা না হলে মৃত্যুর মিছিল বাড়বেই। আমরা আধুনিক ভবন, আধুনিক সভ্য দেশ, স্মার্ট লিভিং যাই বলি না কেনো তা আমাদের মৃত্যুর হাত থেকে বাচানোর কোনো সুযোগই রাখবে না’— বলেন ইকবাল হাবিব।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘উঁচু ভবনগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমানে যে কনটেক্সট সেক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় সেখানে অগ্নিনির্বাপক কিছু নেই। এক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় ফায়ার সার্ভিস কয় মিনিটে আসবে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে তার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভবনে ভেতরে আগুন লাগার পরে তা নেভানোর জন্য সেখানে প্রাথমিক প্রতিরোধ হিসেবে ফায়ার সাপ্রেশনের ব্যবস্থা থাকা।’
তিনি বলেন, ‘যদি ফায়ার সাপ্রেশনের ব্যবস্থা না থাকে তবে ফায়ার সার্ভিস ৮ মিনিট হোক বা ১০ মিনিট মানে যখনই আসুক না কেনো আগুন ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সেটি হলে কিন্তু ঝুঁকির আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে অনেক প্রাণহানির ঘটনাও হতে পারে। আমাদের ভবনগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ফায়ার সাপ্রেশন সিস্টেম থাকে না। কিছু স্থানে থাকলেও দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাই। ফায়ার সাপ্রেশনে থাকলে দেখা যায় সেক্ষেত্রে সেখানের মানুষের প্রশিক্ষণ থাকার কথা যাতে করে ভবনের মানুষদের নিয়ে প্রাথমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। যে ভবনগুলোতে ফায়ার সাপ্রেশন আছে সেখানে প্রশিক্ষিত কেউ থাকে না।’
আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘বর্তমানে কোনো বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলা করার সামর্থ্য নিয়ে যদি প্রশ্ন তোলা হয় তবে সেক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই দুর্বল। রাষ্ট্রের সেই দুর্বলতার বিষয়টি স্বীকার করা প্রয়োজন। কারণ সেই দুর্বলতা রাতারাতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব না। এজন্য আমাদের নাগরিকদের কিছু করণীয় থাকে। ভবনমালিকদের পাশাপাশি আমাদেরও কিছুটা সচেতনতার জায়গা থাকে এখানে। আগুনের সূত্রপাত হতে পারে এমন কিছু ভবনে আছে কিনা তা চেক করা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের স্থানে ফায়ার সার্ভিস আসতে পারলো কি পারলো না সেটি ভাবতে গিয়ে যদি কোনো প্রাণহানি ঘটে তবে তা কিন্তু বিশাল ক্ষতি। আর তাই ফায়ার সার্ভিস আসার আগেই প্রাথমিক প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করতে হবে অগ্নিনির্বাপক বিষয়গুলো নিয়ে। বিল্ডিংয়ে কোনো রাসায়নিক দ্রব্য আছে কিনা, তারগুলো কেমন অবস্থায় আছে, কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যালস আছে কিনা, ইলেক্ট্রিক্যাল তারসহ অন্যান্য তারগুলো মনিটরিং করা প্রয়োজন। কারণ বাস্তবতা হচ্ছে রাতারাতি ফায়ার সার্ভিসে সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনেক। বাড়ির মালিক বা দায়িত্বে যারা থাকছে তাদের নিরাপদে থাকার জন্য কী কী করণীয় সেটা রাষ্ট্র ঠিক করে দিতে পারে। ভবনের ভেতরে আগুন থেকে বাঁচার জন্য ফায়ার সেফটি প্ল্যানের পরিকল্পনা যে শুধু বহুতল ভবনই করতে পারে বিষয়টা কিন্তু তেমনও না। যেমন দেখা গেলো স্কুল, কলেজ, হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব ভবনে সেগুলো বহুতল না কিন্তু তাও সেখানে ফায়ার সেফটি এক্সিট থাকা জরুরি। যার যার করণীয় ঠিক করে দেওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রকে তার ফায়ার ফাইটিং সার্ভিসের সামর্থ্য বাড়ানো নিয়েও কাজ করতে হবে।’
‘একইসঙ্গে স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়েও কাজ করাতে হবে। সারা বাংলাদেশে গত বেশ কয়েক বছরে আরবান ডিজাস্টার ভলান্টিয়ার তৈরি করেছে সরকার। কিন্তু গুলশানে এরিয়া বেইসড বা কমিউনিটি বেইসড স্বেচ্ছাসেবকদের কিন্তু আগুন লাগা ভবনে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। অপরিচিত হওয়ার কারণে ভবন কর্তৃপক্ষ বা নিরাপত্তারক্ষীরা এমনটি হয়তবা করেছে। তার মানে স্বেচ্ছাসেবক থাকার পরেও এর সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। এক্ষেত্রে মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় এই স্বেচ্ছাসেবকদের পাশাপাশি সামাজিক সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে’— বলেন আদিল মুহাম্মদ খান।
সর্বোপরি, নগরীর পরিকল্পনা এখন আর প্ল্যানারদের হাতে না থাকার কারণে যে সমস্যা হচ্ছে রাষ্ট্রের উচিত সেদিকে নজর দেওয়া। পৃথিবী জুড়ে দেখা যায় প্যানিং থেকে একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বাকিরা সেটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে থাকে। প্ল্যানার বাদ দিয়ে ব্যবসায়ীদের দিয়ে করলে সে কাজ হবে না। কারণ ব্যবসায়ী তো তার ব্যবসার লাভ হিসেব করবেই। আর এমন পরিস্থিতিতে দেখা যায় প্ল্যানারদের কাছে ক্ষমতা নেই, রাজনীতিবিদরাও এখন আর আগের মতো নেই। উপায় একটাই আর তা হলো যার যা করণীয় তাকে সেটি করতে দেওয়ার স্পেসটা দিতে হবে। হয়তবা সেভাবে একদিনে সব কিছু পরিবর্তন হবে না। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটি আলোর মুখ দেখবে— পরামর্শ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খানের।
সারাবাংলা/এসবি/একে