এক এনআইডিতে ৪ টিকিট: কালোবাজারি নিয়ে তবু শঙ্কায় যাত্রীরা
২ মার্চ ২০২৩ ০৯:০২
চট্টগ্রাম ব্যুরো: জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা জন্মনিবন্ধন কার্ড প্রদর্শন করে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট কিনতে গিয়ে প্রথমদিনে ‘অনভ্যাসের বিড়ম্বনায়’ পড়েছেন চট্টগ্রামের যাত্রীরা। টিকিট কিনতে অধিকাংশ যাত্রীকেই দু’বার লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। সময়ও লাগছে বেশি।
তবে টিকিট কালোবাজারি ঠেকানোর লক্ষ্য নিয়ে যে নিয়ম চালু করেছে রেল কর্তৃপক্ষ, সেটা আদৌ কতটুকু বাস্তবায়ন করা যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে যাত্রীদের মধ্যে। তারা বলেছেন, রেলের ‘দুষ্টচক্রকে’ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে কালোবাজারিদের সঙ্গে যোগসাজশে তারা নতুন প্রক্রিয়া কিছুদিন পরই ভণ্ডুল করে দেবে।
বুধবার (১ মার্চ) সকালে ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে এনআইডির মাধ্যমে টিকিট বিক্রির প্রক্রিয়ার উদ্বোধন করে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন এবার কালোবাজারি বন্ধ হওয়ার আশা প্রকাশ করেন। মন্ত্রী বলেন, ‘আগে একটি টিকিট থাকলেই ট্রেনে ভ্রমণ করা যেতো। এতে অনেকেই একাধিক টিকিট কিনে বেশিদামে সেগুলো বিক্রি করতো। কিন্তু নতুন নিয়মে যার টিকিট তাকেই ট্রেনে ভ্রমণ করতে হবে। একজনের পরিচয়পত্র দিয়ে কেনা টিকিটে অন্য কারও ভ্রমণের সুযোগ নেই। এর ফলে কালোবাজারির সুযোগ আর থাকছে না।’
চালু হওয়া নতুন পদ্ধতিতে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট কাটতে প্রথমে এনআইডি কিংবা জন্মনিবন্ধন দিয়ে নিবন্ধন করতে হচ্ছে। নিবন্ধনের তথ্য চলে আসছে ক্রেতার মোবাইল নম্বরে। এরপর কাউন্টারের কর্মকর্তারা নির্বাচন কমিশনের রক্ষিত ডেটাবেজ থেকে এনআইডি যাচাই করে মোবাইলের বার্তা দেখে সরবরাহ করছেন টিকিট।
বুধবার বিকেলে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, স্টেশনে একটি ‘হেল্প ডেস্ক’ স্থাপন করা হয়েছে। মূলত স্মার্টফোন এবং অনলাইনে অনভ্যস্তদের নিবন্ধন করে দিতে ডেস্কটি স্থাপন করা হয়েছে। তবে প্রথমদিনে অভ্যস্ত-অনভ্যস্ত প্রায় সবাই দাঁড়িয়েছেন ডেস্কের সামনে। সেখানে নিবন্ধনের পর মোবাইলে বার্তা পেয়ে তাদের দাঁড়াতে হয়েছে টিকিট কাউন্টারে। যাচাইবাছাই করে টাকা নিয়ে একজন যাত্রীকে টিকিট দিতে লাগছে কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ মিনিট।
এর মধ্যে আবার অনেকেই জানেন না টিকিট কিনতে নতুন পদ্ধতি চালুর কথা। এনআইডি সঙ্গে না থাকায় তাদের ফিরে যেতে হয়েছে। এসব বিড়ম্বনায় পড়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক যাত্রী। তবে অনেকেই নতুন নিয়মের কারণে টিকিট সহজলভ্য হবে বলে মনে করছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরিফুল হক এনআইডি ছাড়াই টিকিট কিনতে এসে বিড়ম্বনায় পড়েন। পরে আবার বাসায় গিয়ে এনআইডি নিয়ে এসে নিবন্ধন করে কিনেন ঢাকাগামী ট্রেনের টিকিট।
আরিফুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্ধুবান্ধব থেকে অনেক আগে শুনেছিলাম এনআইডি ছাড়া টিকিট কাটতে পারব না। তবে কবে থেকে এ নিয়ম চালু হবে সেটা জানতাম না। আগে কাউন্টারে এসে দাঁড়িয়ে অনায়াসে টিকিট নিয়ে নিতে পারতাম। নতুন নিয়মের কারণে প্রথমদিন একটু ভোগান্তি হয়েছে। প্রক্রিয়াটা একটু কঠিন হলেও উদ্যোগটা ভালো। কালোবাজারিরা টিকিট নিতে পারবে না বলে মনে হয়।’
চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার জাফর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এনআইডি দিয়ে টিকিট কাটার বাধ্যবাধকতা অনেক যাত্রী জানতেন না। এজন্য প্রথমদিন একটু ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে সবাই অভ্যস্ত হয়ে যাবে। পুরো স্টেশনে ৮০টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দিয়ে আমরা টিকিট বিক্রি পর্যবেক্ষণ করছি। কোনো অনিয়ম হতে পারবে না।’
স্টেশন মাস্টার জানান, একজন ব্যক্তি একটি পরিচয়পত্র দিয়ে সর্বোচ্চ চারটি টিকিট কিনতে পারবেন। তবে সেই ব্যক্তিকে অবশ্যই যাত্রী হতে হবে। নিজের এনআইডি ছাড়া বাকি তিন যাত্রী তার জিম্মায় থাকবেন। যিনি টিকিট কিনেছেন তিনি যদি ট্রেনে না থাকেন, তাহলে চারটি টিকিটই বাতিল বলে গণ্য হবে এবং কালোবাজারি হিসেবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আর স্টেশনে না গিয়ে অনলাইনে নিবন্ধন করে চারটি টিকিট কিনলে যাত্রার আগে বাকি তিন যাত্রীকেই এনআইডি দেখিয়ে টিকিটের মুদ্রিত কপি নিতে হবে বলে তিনি জানান।
একই ক্রেতার ভ্রমণ বাধ্যতামূলক করলেও পরিচয়পত্রে চারটি টিকিটের বিধান থেকে যাওয়ায় কালোবাজারি রোধ করা অসম্ভব হবে বলে মনে করছেন অনেক যাত্রী।
নগরীর হালিশহরের বাদল চন্দ্র বড়ুয়া গত ৫ মার্চ সপরিবারে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকায় যাবেন। নতুন নিয়মে চারটি টিকিট কিনে এ প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। বাদল বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি নিয়মিত ট্রেনের যাত্রী। যাত্রার ৪-৫ দিন আগে কাউন্টারে দাঁড়িয়েও টিকিট পাইনি এমন অনেকবার হয়েছে। কাউন্টারে টিকিট নেই, বাইরে হাতে হাতে টিকিট। এবার টিকিট কেনার প্রক্রিয়াটা জটিল করেছে। তবে এটা কতদিন কার্যকর থাকে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে।’
টিকিট কিনতে না পেরে ভোগান্তিতে পড়া এক ব্যক্তি প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। তিনি বলেন, ‘কালোবাজারি দমন করতে না পেরে রেল কর্তৃপক্ষ সাধারণ মানুষেকে ভোগান্তিতে ফেলেছে। যত নিয়ম সব সাধারণ মানুষের জন্য। কালোবাজারি কারা করে, তাদের কাছে টিকিট কিভাবে যায়? রেল কর্মকর্তারা তাদের চেনেন না? যদি রেল সংশ্লিষ্টরা সৎভাবে টিকিট বিক্রির কার্যক্রম পরিচালনা করতেন, তাহলে কখনোই কালোবাজারি হতো না। সুতরাং মর্ষের মধ্য থেকে ভূত না তাড়ালে ভোগান্তি থেকেই যাবে।’
আরেক ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘একটি এনআইডি দিয়ে চারটি টিকিট কেনা যাবে। রেলের অসাধু কর্মকর্তারা যে কালোবাজারিদের এই সুযোগটা দেবে না তার গ্যারান্টি কী? ট্রেনে টিকিটের সঙ্গে এনআইডি যাচাইবাছাইয়ের প্রক্রিয়া কী সেটা জানি না। তবে যাচাইবাছাই যারা করবে তাদের মনিটরিংয়ের আওতায় না আনলে পুরো উদ্যোগ ভেস্তে যাবে। অনিয়ম-দুর্নীতি আগে ঘর থেকে বন্ধ করতে হবে।’
বুধবার সকালে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন চত্বরে নতুন নিয়মে টিকিটি বিক্রি কার্যক্রম উদ্বোধন করেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি টিকিট বিক্রির নতুন নিয়মকে কালোবাজারি বন্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সরকারি উদ্যোগের অংশ বলে মন্তব্য করেন।
জাহাঙ্গীর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘টিকিটের ওপর এনআইডি নম্বর লেখা থাকছে। ট্রেনে ওঠার আগে কর্মকর্তারা পয়েন্ট অব সেল (পিওএস) মেশিনের মাধ্যমে টিকিট যাচাই করবেন। সন্দেহ হলে ট্রেনেও টিকিট যাচাই করবেন। কালোবাজারির সুযোগ থাকছে না।’
তবে বিদ্যমান ‘টিকিট পরীক্ষক’ সংকটের কারণে যাচাইবাছাইয়ের এ সিদ্ধান্ত আদৌ কতটুকু বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে খোদ রেল কর্মকর্তাদের অনেকের মধ্যেও।
সারাবাংলা/আইসি/আরডি/এমও