৪ মার্চ ১৯৭১: বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারাদেশে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল
৪ মার্চ ২০২৩ ১৩:২৮
ঢাকা: ৪ মার্চ ১৯৭১। অগ্নিঝরা মার্চের এই দিনটির ঘটনা প্রবাহের দিকে তাকালে বোঝা যায়, বাঙালি জাতি কী ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। যে প্রস্তুতির সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আমাদের ‘হ্যামিলনের বংশীবাদক’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কার্যত ৪ মার্চ পূর্ব বাংলায় ইয়াহিয়া-ভুট্টো নয়, চলছিল শেখ মুজিবের শাসন।
এদিন এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “হরতালের জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যে সব কর্মচারী বেতন পাননি তাদের সুবিধার্থে প্রতিদিন দু’ ঘণ্টার জন্য ব্যাংক খোলা থাকবে। বাংলাদেশের জন্য অনধিক পনের শ’ টাকা পরিমাণ বেতনের চেকই কেবল ক্যাশ করা যাবে। স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে বাংলাদেশের বাইরে কোনো টাকা পাঠানো যাবে না।”
শোষণ ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আহূত প্রতিবাদে বাংলাদেশের প্রতিটি নারী, পুরুষ, শিশু তেজদীপ্ত সাড়া দেওয়ায় জনতাকে অভিনন্দন জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বেসামরিক, নিরস্ত্র শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রজনতা বুলেটের সামনে যে সাহস ও প্রত্যয়ের সঙ্গে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন, তা বিশ্ববাসীর কাছে লক্ষণীয়। তাই বাংলার সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের প্রতি অভিনন্দন জানাচ্ছি।’
পৃথক এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মাওলানা ভাসানী বলেন, ‘ওরা সাম্রাজ্যবাদের দালাল। ওদের শোষণ-নির্যাতনে ৮৫ ভাগ বাঙালি আজ প্রায় মৃত্যুর সম্মুখীন। সুতরাং যে ব্যক্তি, যে রাজনৈতিক দল অথবা যে রাজনৈতিক নেতা পশ্চিমাদের সঙ্গে কিংবা সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে কোনো রকমের আঁতাত করবে বা করতে যাবে, সে যে শুধু তার নিজস্ব ক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত হবে, তা নয়, বরং তার জানমালও বিপন্ন হবে।’
দেশের সব সম্প্রদায় যেমন মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বাঙালি বা অবাঙালি সবার মধ্যে সহযোগিতা ও পূর্ণ শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানান মওলানা ভাসানী।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জনসভা আয়োজন করে। সেখানে সংগঠনের সভাপতি নুরুল ইসলাম ও মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দেশে নিরঙ্কুশ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং জাতিগত অধিকার তথা বাংলার স্বাধিকারের সংগ্রামকে বানচাল করার অপচেষ্টা রুখে দাঁড়াতে হবে।
ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। বাংলার স্বাধিকারের সংগ্রামকে ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। আর এই জন্যই পাড়ায়-পাড়ায়, গ্রামে-গঞ্জে সংগ্রাম কমিটি ও মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র জনতাকে উদ্যোগ নিতে হবে।
বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি জানায় পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন। ইউনিয়নের সভাপতি আলী আশরাফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, ‘মার্চের গণআন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের হত্যার বিচারের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে এবং হতাহতদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’
সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ওপর যে সব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয় ৪ মার্চের সভায়। সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, ‘স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার না দিলে সাংবাদিকরা বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন না।’
এরকম পরিস্থিতিতে ভুট্টো বলেন, ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার ফলে আওয়ামী লীগ যে চরম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা আশা করা যায় না। আওয়ামী লীগের সাথে ৬ দফা প্রশ্নে আলাপ-আলোচনার জন্য শুধু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্বল্প সময়ের জন্য স্থগিত ঘোষণার দাবি করেছিলাম মাত্র।’
কিন্তু ভুট্টোর এই মন ভোলানো কথায় মন গলেনি বীর বাঙালির। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সারাদেশে পালিত হয় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রতিবাদে প্রতিদিন ভোর ৬ টা থেকে দুপুর ২টা হরতাল পালনের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে বাঙালি জাতি।
আরও পড়ুন: স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ: ৩ মার্চ, ১৯৭১-এর নায়কেরা কে কোথায়?
সারাবাংলা/এজেড/এমও