Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘কল-রেডী’র ঐতিহাসিক যন্ত্রপাতি বিদেশে

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৭ মার্চ ২০২৩ ০৯:৩৫

ঢাকা: জনপ্রিয় মাইক সার্ভিস ‘কল-রেডী‘র প্রতিষ্ঠাতা দুই ভাই হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য স্বীকৃতি চেয়ে আসছে পরিবার। তবে স্বীকৃতি মেলেনি। উল্টো কালের সাক্ষী ‘কল-রেডী‘র ঐতিহাসিক যন্ত্রপাতি বেহাত হয়ে যাওয়ার ভয়ে বিদেশে সংরক্ষণ করে রাখতে হয়েছে।

হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষদের পরিবারের অভিযোগ, কল-রেডীর প্রয়াত দুই কর্ণধারকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তাদের অবদান যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। এমনকি বঙ্গবন্ধু যেসব যন্ত্রপাতি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ব্যবহার করে স্বাধীনতার সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন, সেই ভাষণ আজ বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি পেলেও কল-রেডীর যন্ত্রপাতি দেশে সংরক্ষণ করা হয়নি। এসব যন্ত্রপাতি বেহাত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। তাই বঙ্গবন্ধু যেসব যন্ত্রপাতি ৭ মার্চের ভাষণে ব্যবহার করেছিলেন সেগুলো বিদেশে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (৬ মার্চ) রাজধানীর পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের কল-রেডীর অফিসে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান কর্ণধারদের একজন ত্রিনাথ ঘোষ সাগরের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

ত্রিনাথ ঘোষ সাংবাদিক দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। পরে তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর ৭ মার্চের আগে সাংবাদিকরা আসেন এবং একই প্রশ্ন করেন। এসব প্রশ্নের উত্তর প্রতিবছর দিতে দিতে আমরা বিরক্ত। সরকার কেন এটা করেনি, কেন ওটা করেনি, আবেদন করেছিলেন কিনা ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। সরকার কেন কল-রেডীর যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ করছে না সেটা আমাদের জিজ্ঞেস করে তো লাভ নেই। সেটা সরকারকেই জিজ্ঞেস করতে হবে।’

হরিপদ ঘোষের চার ছেলে বর্তমানে কল-রেডী মাইক সার্ভিস প্রতিষ্ঠানটি দেখভাল করছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন ত্রিনাথ ঘোষ সাগর। বর্তমানে ব্যবসা মোটামুটি ভালো যাচ্ছে। পুরান ঢাকার প্রায় সব অনুষ্ঠানেই কল-রেডীর সাউন্ড সিস্টেম ভাড়ায় যায়। নতুন নতুন যন্ত্রপাতির সঙ্গে নতুন নতুন সাউন্ড সিস্টেম যুক্ত হওয়ায় ব্যবসায় ভালো করছেন তারা। তাছাড়া আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রোগ্রামগুলোতে কল-রেডীর মাইক সার্ভিস ভাড়ায় যায়।

বিজ্ঞাপন

ক্ষোভ প্রকাশ করে ত্রিনাথ সাগর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তো কখনো সরকারের কাছে কিছু চাইনি। আমরা শুধু চেয়েছিলাম, বাবা ও কাকা যেন মরণোত্তর হলেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটা পান। এছাড়া বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছিলেন সেই যন্ত্রপাতিগুলো যেন সংরক্ষণ করা হয়। আমরা নিজেদের জন্য সরকারের কারও কাছে কিছুই চাইনি।’

‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো, তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’

১৯৭১-এর অগ্নিঝরা সেই মার্চের ৭ তারিখে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকন্ঠে কাঁপিয়ে দেওয়া সেই ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর মহাকাব্যিক সেই ভাষণকে জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতির জনকের সেই ভাষণ যে শব্দযন্ত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র, সেই ‘কল-রেডী’ আজও স্বীকৃতির অপেক্ষায়। অবশ্য যতই বছর পেরিয়ে যাচ্ছে ততই স্বীকৃতির আশা ছেড়ে দিচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা।

১৯৪৮ সালে দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দানা বাধতে শুরু করে। ওই বছর বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানার মঠবাড়িয়া গ্রামের দুই ভাই হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ‘আরজু লাইট হাউজ’ নামে একটি আলোকসজ্জার দোকান চালু করেন। আলোকসজ্জার পাশাপাশি গ্রামোফোনও ভাড়া দেওয়া হতো। অল্প দিনেই দোকানটি পরিচিত হয়ে ওঠে। আন্দোলনের নেতাকর্মীরা মাইক ভাড়া নিতে শুরু করেন আরজু লাইট হাউজ থেকে। দিনে দিনে চাহিদা বাড়তে থাকে। তাই তাইওয়ান, জাপান, চীন থেকে আনা হয় মাইক। মূলত মাইকের মূল অংশ অর্থাৎ ইউনিট আনা হতো বাইরে থেকে। এরপর নিজের দোকানের কারিগর দিয়ে হরিপদ ঘোষ তৈরি করতেন বাকি অংশ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর থেকে সভা-সমাবেশ বাড়তে থাকে এবং সামাজিক- ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রয়োজনেও মাইকের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। তাই মাইক সার্ভিসের সঙ্গে মিল রেখে ‘কল-রেডী’ নামটিই ঠিক করা হয়। প্রয়োজনে কল করলেই যেন মাইক রেডি থাকে। অর্থাৎ, কল করলেই রেডি—কল-রেডী।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশেও কল-রেডীর মাইকে বক্তব্য দিয়েছেন নেতারা। কল-রেডী মাইকে বঙ্গবন্ধু ছাড়াও বক্তব্য দিয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ অনেকে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিদেশের নেতাদের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি কল-রেডী মাইক্রোফোনে ভাষণ দিয়েছেন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সাত কোটি মানুষের প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ ও বিশ্ববাসী তাকিয়ে, কী বলতে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন, তার এ বক্তব্য ছড়িয়ে দিতে হবে আনাচে-কানাচে। কল-রেডীর মালিক হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষকে ধানমণ্ডির বাসায় ডেকে পাঠালেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে মাইকের ব্যবস্থা করতে।

জনসভা যাতে সফল না হয় সেজন্য প্রতিবন্ধকতা, হুমকি-ধমকি ছিল। ছিল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষু। জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় রেসকোর্স ময়দানে মাইক পাঠাতে অনেকেই তাদের নিষেধ করলেন। কিন্তু হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষের রক্তেও তখন শোষকদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার আন্দোলনের আগুন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মাইক সরবরাহের কাজে নেমে পড়ে কল-রেডী। তখন রেসকোর্সে মাইক লাগানো সহজ ছিল না। কারণ শাসকগোষ্ঠীর সতর্ক চোখ ছিল রেসকোর্স ময়দানে।

সেদিনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে হরিপদ ঘোষের চার ছেলের একজন ত্রিনাথ ঘোষ সাগর বলেন, রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে মাইক লাগাতে গিয়েছিলেন আব্বা ও কাকা। মাইক লাগিয়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন তারা। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কিছু বাড়তি মাইক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মজুদ রাখা হয়, যেন সমাবেশের দিন তাৎক্ষণিকভাবে লাগানো যায়। তিন দিন ধরে ৩০ জন কর্মী নিয়ে বাঁশ, খুঁটি গাথার কাজ করেন তারা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণকালে যেন কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি না হয়, সে জন্য নিজে উপস্থিত থাকার পাশাপাশি একজন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দিয়েছিলেন হরিপদ ঘোষ। অতিরিক্ত তিনটি মাইক্রোফোন সঙ্গে রেখেছিলেন দয়াল ঘোষ। পরের দিন পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলো। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ কল-রেডীর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

কল-রেডী কার্যালয়ের পাশে এক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, এই ছেলেরা ঐতিহাসিক মাইক সার্ভিসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য অনেক চেষ্টাই করেছেন। বিশেষ করে ৭ মার্চে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয়েছিল সেগুলো যাতে স্বীকৃতি দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু যাদুঘরে রাখা হয়। অনেক চেষ্টাই করেছেন তারা। আওয়ামী লীগ যদি কল-রেডীকে স্বীকৃতি না দেয় তাহলে এদেশে দেবে কে বলেন?

আরও পড়ুন

সারাবাংলা/ইউজে/আইই

৭ মার্চ ভাষণ কল-রেডী হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

কানপুরে প্রথম দিনে বৃষ্টির দাপট
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৩৫

সম্পর্কিত খবর