Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খরচ কোটি টাকার বেশি তবু সমাবর্তনে ‘বঙ্গবন্ধু’ বানানও ভুল

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৬ মার্চ ২০২৩ ০৯:৪৭

ঢাকা: প্রতিষ্ঠানের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। দেশের চিকিৎসাশাস্ত্রের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠের সামনেই নামফলকে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে লেখা নামটি হলো- ‘Bangabandhu Sheikh Mujib Medical University’। শুধু প্রতিষ্ঠানের গেটে কেন, চতুর্থ সমাবর্তন আয়োজনের সব তোরন, ব্যানার, আমন্ত্রণপত্রেও লেখা হয়েছে তা। কিন্তু সমাবর্তনে আসা শিক্ষার্থীদের উপহার হিসেবে যে ব্যাগ দেওয়া হয় তাতে বঙ্গবন্ধু বানানটি লেখা হয়েছে ভুল। ‘Bangabandhu’ শব্দের পরিবর্তে সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে ‘Bongobondhu’।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কোটি টাকারও বেশি খরচ করা হয়েছে বিএসএমএমইউ আয়োজিত চতুর্থ সমাবর্তনে। কিন্তু সেখানে বঙ্গবন্ধু বানানটা শুদ্ধ করে দেওয়ার দায়িত্বটাও কেউ নিতে পারলেন না? শিক্ষার্থীদের নানারকম অপমান করেছে কিন্তু তাই বলে বঙ্গবন্ধুকেও? নাকি সবাই নিজেদের পকেট ভারী করতে গিয়ে এই বানানগুলো সঠিক করারও সময় পাননি?

বিএসএমএমইউ’র উপাচার্য ও আয়োজকরা বলছেন, এটি বিশাল বড় ভুল। কারও খামখেয়ালির কারণে এমন ভুল মানা যায় না। আমরা খুবই দুঃখিত বিষয়টি নিয়ে। তবে যে বা যারাই এই ভুলগুলোর সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত ১৩ মার্চ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চতুর্থ সমাবর্তনের নানা অনিয়ম নিয়ে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। উপহার হিসেবে কোনো কিছু না দিলেও একটি টুপি দেওয়া হয় ব্যাগে। সেখানে দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর নাম দেওয়া হয়েছে ভুল। তবে কিছু শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওপরে থাকা ভুল বানানে সূক্ষ্মভাবে সাদা কাগজ ও আঠা দিয়ে লেখা হয়েছে Bangabandhu। এছাড়া আরও বেশ কিছু ভুল বানান ব্যবহার করা হয় নানাস্থানে লাগানো ফেস্টুনে।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সমাবর্তনের আয়োজনে শুধু এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা এসেছে রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ। এর বাইরেও আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডের টাকা। অথচ অনুষ্ঠানে যাওয়ার পরে অনেককেই খেতে দেওয়া হয়নি কিছু। একটা প্রকাশনা বের করা হয়েছে, যার মাঝে প্রচুর ভুল। আর সেটা তাই কাউকে দেওয়া হয়নি। স্টিকার লাগানো অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনে গাউন দেওয়া হলেও তা ছিল দুর্গন্ধময়। পরে সেটা ফিরিয়ে নেওয়ার নামে আরেক প্রহসন। এমনই নানা বিশৃঙ্খলা আর চূড়ান্ত অব্যবস্থাপনা নিয়েই অনুষ্ঠানটি শেষ হয়।

বিজ্ঞাপন

তাদের অভিযোগ, কোনো উপহার না দিলেও একটা ক্যাপ বা টুপি রাখার জন্য ব্যাগ দেওয়া হয়। আর সেখানে দেখি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় নামের Bangabandhu বানানই ভুল। অথচ আমরা এটাই কিন্তু ব্যবহার করে আসছি পুরো শিক্ষাবর্ষে। আর এর ওপরে আঠা দিয়ে সাদা কাগজ লাগানোর বিষয়টি ছিল আরও দুর্ভাগ্যজনক। এর মানে অনুষ্ঠানের আয়োজকরা জানতো এই ভুল বিষয়ে। কিন্তু তাও সবার হাতে এই ভুলটাই ধরিয়ে দেওয়া হয়, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো।

শিক্ষার্থীরা আরও অভিযোগ করেন, বিষয়টি পরিকল্পিত। শিক্ষার্থীদের অবহেলা করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শব্দের ভুল করার অর্থ হলো, পুরো সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজনটিতে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। অথচ সনদের জন্য তিন হাজার ও রেজিস্ট্রেশন বাবদ পাঁচ হাজার মিলিয়ে সবাই আট হাজার টাকা করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষকে।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের পেছনেই খরচ হয়েছে ৮০ লাখ টাকা। অথচ প্রকাশনীর পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর নামটা চেক করার জন্য কোনো প্রুফ রিডার ছিলো না? ফেস্টুনগুলো দেখে মনে হয়েছে দায়সারা সব আয়োজন হয়েছে। অথচ এই ফেস্টুনগুলো প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে শোভা পাচ্ছে।

সরেজমিনে, বিএসএমএমইউসংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সেখানে নানাভাবে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন রকমের ফেস্টুন। সেগুলোতে বিভিন্ন রকমের ভুল বানান।

একটি ফেস্টুনে দেখা যায় লেখা আছে, ‘সব হারিয়ে আমর শুধু দেবার পালা।’ এখানে ‘আমর’ বানানটি হওয়ার কথা ছিল ‘আমার’। আরেকটি ফেস্টুনে লেখা হয়েছে, ‘সফলতার গল্প পড়োরা কারণ তা’। এটি আসলে কী লিখেছে তার উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আরেকটি ফেস্টুনে ‘ভালোবাসা’ বানান লেখা হয়েছে ‘ভালেবাসা’।

তবে এসব ভুলের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চিকিৎসকদের মাঝে সমালোচনা চলছে বঙ্গবন্ধুর বানান ভুল করা নিয়ে।

ডা. আশরাফুর তুহিন নামে সমাবর্তনে অংশ নেওয়া একজন চিকিৎসক সারাবাংলাকে বলেন, ‘উপাচার্যসহ অন্যরা সারাদিন ১০১টা বক্তব্য দিয়ে থাকেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। সারাজীবন বাংলাদেশের জন্য যে লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস জাতির জনকের তার জন্যেই মুক্তিযুদ্ধের আগে বঙ্গবন্ধু খেতাব দেওয়া হয়। আর সেই বঙ্গবন্ধু বানানই ভুল লিখেছে প্রতিষ্ঠান। শুধু তাই নয়, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো আবার আঠা দিয়ে সাদা কাগজ লাগিয়ে সেই ভুলকে শোধরানোর দুঃসাহস করা হয়েছে। এমনিতেই তো কিছু দেওয়া হয়নি আলাদা। আর তাই সেই ভুল বানানে লেখা ব্যাগটাই দেওয়ার কী দরকার ছিল?’

এটা পরিষ্কারভাবে করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে অপমান করার জন্য উল্লেখ করে বলেন, ‘আয়োজকরা ভুল টের পাওয়ার পরেও এটা রেখেছে। মানে এই বানান ভুলে তাদের কিছু যায় না। তারা ভেবেছে এটা হয়তো বা মোহাম্মদ পেডিয়াট্রিকস (প্রকাশনীতে লেখা হয়েছিল Md. paediatrics) লেখার মতো কোনো ভুল। সেই ভুলগুলোর কারণে কিন্তু বইটা আমাদের দেওয়া হয়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বানানটা ইংরেজিতে Bongobondhu লিখে ঠিকই দিয়ে দিলো। কিভাবে?’

তিনি বলেন, ‘তাড়াহুড়োর কারণে সম্ভবত সবার ব্যাগে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে পারেনি। অর্থাৎ সেই আঠা দিয়ে সাদা কাগজটা লাগাতে ভুলে গেছে। এতটা দায়সারা আয়োজন কেনো করলো দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ? ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্ট বা অন্য কারও দোষ দেওয়ার তো উপায়ই নাই। কারণ আয়োজন প্রতিষ্ঠানের আর দেখভালের দায়িত্ব তাদের।’

অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, ‘আসলে আর্থিক অনিয়ম করে নিজের পকেট ভারী করার জন্যই হয়তো সবাই ব্যস্ত ছিল। কারণ এত বড় অনুষ্ঠানের বাজেটও বড়। আর সেটা নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল সবাই যে বঙ্গবন্ধুর বানানকে ভুলভাবে প্রকাশ করে অন্যের হাতে তুলে দেওয়াটা কোনো অন্যায় মনে করেনি। প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ বিভাগের পাশাপাশি অনুষ্ঠানের এত এত আয়োজক কমিটি তাহলে কী কাজ করেছে?’

তবে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধু বানানের ভুলকে ধৃষ্টতা দাবি করে বলেছেন, ‘অবশ্যই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বিএসএমএমইউ’র কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আতিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সমাবর্তনের অনুষ্ঠান ছিল অনেক বড় একটি আয়োজন। এখানে কোনো ভুল ত্রুটি হয়ে থাকলে তা নিয়ে আমরা লজ্জিত। এখানে শিক্ষার্থীরা যেহেতু অভিযোগ করেছেন, তাই অবশ্যই এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ তাদের নিয়েই আয়োজন। তবে আর্থিক অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ করলে সেটা দুর্ভাগ্যজনক। কোষাধ্যক্ষ হিসেবে আমি এটা বলতে পারি আমাদের দিক থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। যতগুলো কমিটি করা হয়েছে, সবাই তাদের বাজেট যেভাবে দিয়েছেন, যাচাইবাছাই করে সেভাবেই টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন। যদি কোনো বিভাগে দুর্বলতার অভিযোগ করা হয়ে থাকে তবে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কমিটিকে সে বিষয়ে জবাব দিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘বিএসএমএমইউ একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে বঙ্গবন্ধুর নাম জড়িয়ে আছে। আর তাই বঙ্গবন্ধুর ইংরেজি শব্দের বানান ভুল কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারে না। এটি নিয়ে বৃহস্পতিবার (১৬ মার্চ) উপাচার্য সবাইকে ডেকেছেন। আশা করি দোষিদের শনাক্ত করে শাস্তি দেওয়া হবে।’

অব্যবস্থাপনা ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ নাকচ করে দিলেও বিএসএমএমইউ’র উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বানান ভুল করা ধৃষ্টতা। এটা যে বা যারাই করেছে তাদের বিপক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামের এই স্বাধীন দেশ পেয়েছি আমরা। বর্তমানে ওনার সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নের সবাই কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের যে স্বপ্ন দেখতেন তা পূরণের জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দেশের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় আমরা যখন বিএসএমএমইউকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, তখন অনেকেই সেটার বিপক্ষে ষড়যন্ত্র করছেন। বিষয়টি তাদের কেউ করেছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা হবে অবশ্যই।’

উল্লেখ্য, ১৩ মার্চ অনুষ্ঠিত বিএসএমএমইউ’র চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর চিকিৎসকের পাশাপাশি সেবিকারাও অংশ নেন। এর মধ্যে মেডিসিন অনুষদে প্রায় ৮০০ জন, সার্জারি অনুষদে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন, শিশু অনুষদে প্রায় ৩০০ জন, বেসিক সায়েন্স ও প্যারাক্লিনিক্যাল অনুষদে পাঁচ শতাধিক, প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন অনুষদে প্রায় ৩০০ জন, ডেন্টাল অনুষদে শতাধিক স্নাতকোত্তর চিকিৎসক এবং নার্সিং অনুষদে শতাধিক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সেবিকা।

আরও পড়ুন: বিএসএমএমইউ’র সমাবর্তন নিয়ে ক্ষোভ, আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ!

সারাবাংলা/এসবি/এমও

বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর