Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নিষিদ্ধ পল্লী থেকে স্বাভাবিক জীবন, পাশে বিদ্যানন্দ

রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৭ মার্চ ২০২৩ ১৭:৪৭

ঢাকা: ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে মিনু আক্তারের (ছদ্মনাম) জায়গা বড় ভাইয়ের কাছে। বিয়ের পর বড় ভাই আলাদা সংসারে চলে গেলে রীতিমতো অকূল পাথারে পড়েন মিনু। প্রতিবেশী চাচাতো ভাইয়েরা নানাভাবে শারীরিক নির্যাতন করতেন। সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে পাড়ার এক বোনের কাছে চাকরি চান। সেই বোন চাকরির প্রতিশ্রুতি দেখিয়ে বিক্রি করে দেন যৌনপল্লীতে। সেখান থেকে পালিয়ে বাড়িতে এলেও বড়ভাই বের করে দেন। বাধ্য হয়ে আবার অন্ধকার জগতে পা বাড়ান মিনু।

নিষিদ্ধ পল্লীতে পরিচিত হয় এক খদ্দেরের সঙ্গে। তার সঙ্গে সংসার পাতেন মিনু। কিন্তু স্বামী নেশাগ্রস্ত হওয়ায় ঠিকমতো সংসার তো চলেই না উল্টো চলে নির্যাতন। এমনকি টাকার জন্য স্ত্রীকে দিয়েও দেহব্যবসা করাতেন নেশাগ্রস্ত স্বামী। এ যেন এক নরক থেকে আরেক নরকে জায়গা হয় মিনুর।

ছোটবেলায় দালালের মাধ্যমে বিক্রি হয়ে গিয়েছিলেন সালেহা আক্তার। জায়গা হয় যৌনপল্লীতে। কিন্তু মা-বাবাকে খুঁজে পাননি বলে কখনও পালিয়ে যাওয়ায় সাহস করেননি। একসময় সাহস সঞ্চয় করে সেই পথে ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন সালেহা। বিয়ে করে শুরু করেন সংসারও।

মায়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে ফাঁদে পড়েন কুলসুম (ছদ্মনাম)। জায়গা হয় নিষিদ্ধ পল্লীতে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য হন দেহব্যবসা করতে। কিন্তু সবসময়ই চাইতেন এ জীবন ছেড়ে একটি স্বাভাবিক জীবন বেছে নিতে। কিন্তু কাউকে বিশ্বাস করে সেখান থেকে বাইরে আসার সাহস করে উঠতে পারছিলেন না তিনি।

মিনু, সালেহা আর কুলসুমের মতো এমন অনেক মেয়েরই নানাভাবে প্রতারণার শিকার হয়ে জায়গা হয় যৌনপল্লীতে। পরবর্তীতে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইলেও সমাজ তাদের গ্রহণ করে না। ফলে ধুঁকে ধুঁকে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন তারা। এমনকি সামাজিক স্বীকৃতি পায় না তাদের সন্তানরাও। এমনই নারীদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। বাণিজ্যমেলা, বইমেলায় বিক্রয়কর্মী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে কয়েকজন সাবেক যৌনকর্মীকে। আর চাকরি করে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছেন ভাগ্যবঞ্চিত এসব নারীরা।

মিনু আক্তার বলেন, ‘বিদ্যানন্দ আমাকে চাকরি দিয়েছে। এই কাজের মাধ্যমে আমি আমার ছেলেটিকে মানুষ করতে চাই।’

বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করা সালেহা বলেন, ‘এরইমধ্যে আমি সে কাজ ছেড়ে দিয়েছি। কয়েক বছর ধরে সংসার করছি। আমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমি বিদ্যানন্দের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।’

তবে এদের সবার পথটি মসৃণ ছিল না। যেমন কুলসুমকে যখন বিদ্যানন্দের একজন স্বেচ্ছাসেবী চাকরির প্রস্তাব দেন, সেটিকেও ফাঁদ ভেবে ভয় পেয়ে যান কুলসুম। তিনি বলেন, ‘বিদ্যানন্দের এক ভাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে সেলসম্যান হিসেবে কাজের প্রস্তাব দেয়। আমি প্রথমে নতুন ফাঁদ ভেবে ভয়ে এড়িয়ে যাই। পড়ে তাদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিই। প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তি লাগলেও বিদ্যানন্দ যেভাবে সাহায্য করেছে, তাতে আমার খুব ভালো লাগছে। কাজ আর সম্মান পেলে কেউ তো অন্ধকার পথে থাকবে না।’

বিদ্যানন্দের পক্ষ থেকে বলা হয়, যৌন পেশা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান অনেকেই। কিন্তু অনেকেই সেই সুযোগ পান না। তাদের ঘিরে মানুষ বিদ্রূপের হাসি হাসে। মানুষ শুদ্ধ পথের কথা বলে কিন্তু ফেরার পথ দেখায় না। তাদের ভুলকেই বড় করে দেখা হয়। সমাজের এমন ট্যাবু ভাঙার উদ্যোগের অংশ হিসেবে নিষিদ্ধপল্লীর মেয়েদের বিক্রয়কর্মী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে একুশে পদকপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ।

তারই অংশ হিসেবে এবারের চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্টলে বিক্রেতাকর্মী হিসেবে ছিলেন দুজন সাবেক যৌনকর্মী।

বিদ্যানন্দের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান সালমান খান ইয়াছিন জানান, ‘ওই সব নারীদের আমরা স্টলে নিয়োগ দিয়েছি। কেউ হয়ত সাধুবাদ জানাবে কেউ হয়ত বিদ্রূপ করবে। আবার অনভিজ্ঞ-এ কারণে স্টলে বেচাবিক্রিও কম হতে পারে। তবুও আমরা বিশ্বাস করি, বিকল্প আয়ের পথ পেলে তারা অন্ধকার জগৎ থেকে ফিরে আসবে আলোর পথে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শুধু মুখে বলা নয়, কাজের মাধ্যমে সেটি প্রমাণ করে দেখাতে চেয়েছি। বাণিজ্যমেলায় লাভের আশায় আসিনি। অন্তত কিছু ট্যাবু ভেঙে যেতে চাই এই সমাজের। স্বাভাবিক জীবনের প্রতিশ্রুতি দেখাতে চাই সবাইকে। সব প্রতিষ্ঠান যদি অসহায় হিসেবে বিবেচনা করে তাদের কাজের সুযোগ করে দেয় তাহলে অনেক মেয়ে আলোর মুখ দেখবে।’

সারাবাংলা/আরএফ/একে

টপ নিউজ বিদ্যানন্দ বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন যৌনকর্মী


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর