ঘৃণা-লাঞ্ছনা আর ঝুঁকির মধ্যে কাটছে যৌনকর্মীর জীবন
১০ মার্চ ২০২৪ ০৮:২৮ | আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৪ ১০:২৩
কক্সবাজার: বেদনাবিধুর জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন যৌনকর্মী চম্পা আক্তার (ছদ্মনাম)। অথচ স্বপ্ন ছিল একটি সুখের ঘর বাঁধার। আর তাইতো রফিকের সঙ্গে ঘর ছাড়েন চম্পা। কিন্তু ভালোবাসার সেই মানুষটাই যে তাকে লজ্জায় ভরা অভিশপ্ত জীবন উপহার দেবে। তা তিনি ভাবতেও পারেননি।
চম্পা বলেন, ভুল মানুষকে ভালবেসেই আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। ২০১৯ এর দিকে মোবাইলের মাধ্যমে প্রেম হয় রফিকের সঙ্গে। ভালবাসার টানে পরিবারকে ত্যাগ করে তার কাছে ছুটে এসেছিলাম। এটাই ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ জানতাম না আমার ভালবাসার মানুষ হলেন একজন মাদকাসক্ত, ছিনতাইকারী ও পতিতার দালাল। পরে সব জানার পরেও আর কোনো উপায় না থাকায় তার সঙ্গে সংসার করতে চেয়েছি। আমাদের কিছুদিন ভাল গেলেও একরাতে সে আমাকে আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেই থেকে তার ওপর থেকে মন উঠে যায়। এই অবস্থায় না ফিরতে পারছি বাড়িতে, না পারছি রফিকের সঙ্গে থাকতে।
তিনি আরও বলেন, রফিককে নিয়ে কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলীর যে ভাড়া বাসায় থাকতাম ওই বাসার টাকাও আমাকে দিতে হত। সে প্রতিনিয়ত আমাকে মারধর করত পতিতাবৃত্তি করে টাকা ইনকাম করার জন্য। আমার এই কষ্টের টাকায় সে মাদক সেবন করত। পরে তাকে ছেড়ে অন্যজনের কাছে যাই। কিন্তু সেই একই অবস্থা। কোথাও আর যাওয়ার জায়গা নেই। এরমধ্যে পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়ে গেল এই পেশায়। সমাজে কিছু মানুষরূপী পশু আছে। যারা প্রয়োজন পর্যন্ত বুকে রাখে তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
শুধু চম্পা আক্তার নয় কক্সবাজার শহরের প্রতিটি যৌনকর্মীর রয়েছে আঁধারের গল্প। প্রত্যেকের গল্পটা আলাদা হলেও কেউই নিজের ইচ্ছায় এই অন্ধকারের পথ বেছে নেননি।
কক্সবাজার শহরের লালদিঘীর পাড়ের অন্তত ১০ যৌনকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চরম, ঘৃণা, লাঞ্ছনা আর ঝুঁকির মধ্যে জীবন কাটছে তাদের। চিকিৎসাসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকেই বঞ্চিত। তাদের কেউ ঘর ভাড়া দিতে চায় না, সন্তানদের স্কুলে পড়ার সুযোগ হয় না। শুধু তাই নয় তাদের কোমলমতি শিশুদের লোকজন মন্দ কথা শোনায়।
তার ওপর রয়েছে দালাল, সন্ত্রাসী ও মাদকাসক্তদের উৎপাত। রাত যত গভীর হয় তত’ই ভয়ংকর হয়ে ওঠে যৌনকর্মীদের জীবন। ছিনতাইকারী, দালাল আর মাদকাসক্তরা এসে জোরপূর্বক যৌন নির্যাতনের পাশাপাশি টাকা ছিনিয়ে নেয়। বাধা দিলে ছুরিকাঘাত করে। নিয়মিত এসব ঘটনায় কেউ আহত হয়, আবার কেউ কেউ প্রাণও হারায়।
যৌনকর্মীরা জানান, গত দুই বছরে জোহুরা খাতুন, ময়না বেগম ও মিম খুন হয়েছেন। যাদের লাশ বিভিন্ন হোটেল ও কটেজে পাওয়া গেছে।
তারা আরও জানান, সম্প্রতি কিছু দালাল ও প্রশাসনের সোর্স নামধারী লোক তাদের কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। যাদের মধ্যে রাসেল নামে এক ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। যিনি নিজেকে ডিবি অফিসের সহকারী পরিচয় দেন। তিনি চাঁদার জন্য যৌনকর্মীদের মারধর করেন।
যৌনকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই মুহূর্তে তাদের সব বড় চ্যালেঞ্জ অর্থাভাব। যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ভালো খাবারতো জোটেই না কখনও অসুস্থ হয়ে পড়লে টাকার অভাবে চিকিৎসা নিতে পারেন না। আর যাদের সংসার রয়েছে তাদের অবস্থাতো আরও বেগতিক। সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালানো, অসুস্থ হলে হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে পারেন না। আশপাশের ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে কোনোরকম চালিয়ে নিতে হয়।
তারা আরও জানান, অনেক সংস্থা এসে নানা ধরনের আশার কথা বলে যায়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করে না। তারা মাঝে-মধ্যে এসে কিছু কনডম আর ব্যথার ওষুধ দিয়ে চলে যায়। এর বাইরে আর কোনো কিছুই করে না।
শহরের লালদিঘীর পাড় এবং হোটেল-মোটেল জোন কেন্দ্রিক অর্ধশতাধিক যৌনকর্মী রয়েছে। তারা শহরের সমিতি পাড়া, কুতুবদিয়া পাড়া, টেকপাড়া, বৈধ্যঘোনা ও পাহাড়তলী সহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করেন। তারা নিরাপদ ও সুস্থ জীবনের দাবি জানিয়েছেন।
যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করা ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট মো. নাজমুল হক বলেন, যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া খুবই চ্যালেঞ্জের। তবুও আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছি। আগামীতে আরও উন্নত সেবা দেওয়ার চেষ্টা করব।
সমাজকল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস)-এর চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা সারাবাংলাকে বলেন, একটি আদি পেশা হলেও রয়েছে চরম বৈষম্য। অভিজাত পাড়ায় ওদের ‘কল গার্ল’ বলা হচ্ছে আর হোটেল-মোটেলে ‘পতিতা’।
তিনি বলেন, যৌনকর্মী হলেও ওরা মানুষ। ওদেরও মৌলিক চাহিদা রয়েছে। এ পেশায় যারা থাকেন তাদেরতো বাজে কথা শুনতে হয় ওদের কোমলমতি শিশুদেরও মানুষ বাজে কথা বলে। আসলে যতদিন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন না হবে ততদিন ওরা অবহেলিত থাকবে। এ সমস্যা সমাধানে সম্মিলিত প্রচেষ্টার দরকার।
কক্সবাজার টুরিস্ট পুলিশের সিনিয়র ইন্সপেক্টর ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, যৌনকর্মীরা অসহায় এ কথা যেমন সত্য; তেমনি তাদের অনেকে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও জড়িত। যা পর্যটন নগরীর জন্য খুবই ক্ষতিকর।
তিনি বলেন, তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা আসা জরুরি। তারা কাউকে হয়রানি করলে বা তাদেরকে কেউ হেনস্তা করলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।
সারাবাংলা/এনইউ