Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

২৫ মার্চ ১৯৭১: বর্বর গণহত্যায় স্তম্ভিত জাতি

আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৫ মার্চ ২০২৩ ০৮:৫৭

ঢাকা: ২৫ মার্চ ১৯৭১। রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র, নিরপরাধ ও ঘুমন্ত সাধারণ বাঙালির ওপর ইতিহাসের ন্যাক্কারজনক হত্যায়যজ্ঞ চালায়। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক ওই হত্যাযজ্ঞ পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ ও বর্বর গণহত্যা।

মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা পণ্ড হয়ে গেছে— এ খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ার পর বীর বাঙালি সকাল থেকেই ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয়। সকাল থেকেই ঢাকার পরিস্থিতি ছিল থমথমে।

বিজ্ঞাপন

সংবিধানের খসড়ার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করা এবং অনুমোদনের জন্য সময় নির্ধারণের কথা ছিল এদিন। ইয়াহিয়ার সহযোগী জেনারেল এসজিএমএম পীরজাদা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ফোন করে জানাবেন। সারাদিন ধরেই আওয়ামী লীগের নেতারা টেলিফোনের অপেক্ষায় ছিলেন, কিন্তু সেই ফোন আর আসেনি।

সকালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনে একান্ত বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ভুট্টো সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পরিস্থিতি সঙ্কটজনক।’

পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সামরিক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ আবদুল হামিদ খান, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ উচ্চপদস্থ সেনা কর্তাদের সঙ্গে ইয়াহিয়া গোপনে বৈঠক করেন।

সকাল ১১টার দিকে একটি হেলিকপ্টারে করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ ও মেজর জেনারেল ওমরসহ আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা রংপুর, রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম সেনানিবাস সফর করেন। বিকেল থেকেই পাকিস্তানি সেনারা হেলিকপ্টারে টহল দিতে থাকে। সামরিক সংস্থার সদস্যদের বার্তা দিতে থাকে অবশ্যম্ভাবী এক সামরিক অপারেশনের জন্য প্রস্তুত থাকতে।

বিজ্ঞাপন

প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কোনোরকম ঘোষণা ছাড়াই গোপনে সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরাসরি বিমানবন্দরে চলে যান। তিনি নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে নামতেই পূর্ব পাকিস্তানে তৎপর হয়ে ওঠে তার বাহিনী।

ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে যায় বঙ্গবন্ধুর কাছে। রাত ৯টার দিকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে উপস্থিত দলীয় নেতা, কর্মী, সমর্থক, ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বেশি আগ্রহী। এ অবস্থায় আমাদের পথ আমাদেরই দেখতে হবে। সবাইকে সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”

ঘরে ঘরে খবর পৌঁছে যায় যে ইয়াহিয়া ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তান পালিয়ে গেছে। বাঙালি বুঝে ফেলে, কিছু একটা ঘটবে। রাতেই পথে নেমে আসে ছাত্র-জনতা এবং গড়ে তোলে অসংখ্য ব্যারিকেড। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে চলে যান।

রাত ১০টার দিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর একটি বড় কনভয় যুদ্ধসাজে শহরের দিকে রওনা হয়। শহরমুখী সেনাবাহিনীর মেকানিক্যাল কলামটি প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ফার্মগেইটে। সেখানে বড় বড় গাছের গুঁড়ি, অকেজো স্টিম রোলার এবং ভাঙা গাড়ির স্তূপ জমিয়ে রাখা হয়েছিল পথ আটকানোর জন্য। মুক্তিকামী বেপরোয়া প্রতিরোধোন্মুখ জনতার মাঝ থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উঠছিল। গুলি করে এ প্রতিরোধ ভেঙে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্যাংকগুলো সামনে এগিয়ে যায়।

রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ রেসকোর্স ময়দানের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সেনাবাহিনীর অন্তত ৮০টি সাঁজোয়া যানকে পূর্ণ যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

রাত ১১টা ২০ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের চারিদিকে অবস্থান নিতে শুরু করে। এ আক্রমণের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে সারাদেশের জেলা ও সাব ডিভিশনে বেতার বার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়।

রাত সাড়ে ১১টার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল তাজের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাদের কনভয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ শুরু করে। ব্যারাকে অবস্থানরত বাঙালি পুলিশ সদস্যরা সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি করে।

একই সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২তম বালুচ রেজিমেন্টের সেনারা পিলখানায় ইপিআর-এর ওপর হামলা করে। ব্যারাকে থাকা বাঙালি সেনারা চরম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন।

পিলখানা ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনস আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারি বাজারসহ সমগ্র ঢাকাতে শুরু হয় প্রচণ্ড আক্রমণ; বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় রাতের অন্ধকারে গুলি, বোমা আর ট্যাংকের আওয়াজে প্রকম্পতি হয় পুরো শহর।

সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা, এবং বস্তিবাসীর ওপর নজিরবিহীন নৃশংসতা চালায়।

রাত ১টার পর পাকিস্তানের সেনারা ট্যাংক আর সাঁজোয়া যান নিয়ে ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাঁকে আত্মগোপনে যেতে বললেও তিনি যাননি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাকে না পেলে ওরা ঢাকা জ্বালিয়ে দেবে।’

বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার সম্পর্কে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কর্নেল জেড এ খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটা দল ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে গিয়েছিল। সেখানে পৌঁছেই সেনা সদস্যরা গুলি চালাতে শুরু করে। শেখ মুজিবের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাঙালি পুলিশ সদস্য গুলিতে মারা যান। বঙ্গবন্ধু দোতলা থেকে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন ‘ফায়ারিং বন্ধ কর।’

‘গুলি বন্ধ হওয়ার পরে কর্নেল খান বাসায় ঢোকেন। দোতলায় যান। মুজিব একটা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শেখ মুজিবকে কর্নেল নির্দেশ দেন তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য। তিনি জানতে চেয়েছিলেন পরিবারকে বিদায় জানিয়ে আসতে পারেন কিনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি।’

কর্নেলকে শেখ মুজিব জিজ্ঞাসা করেন, ‘আসার আগে আমাকে জানানো হল না কেন? কর্নেল উত্তর দিয়েছিলেন, ‘সেনাবাহিনী আপনাকে দেখাতে চেয়েছিল যে আপনাকে গ্রেফতারও করা যেতে পারে।’

জেড এ খান ‘দা ওয়ে ইট ওয়াজ’ বইতে লিখেছেন, ‘শেখ সাহেবকে গ্রেফতার করার পরে ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফর ওয়ারলেস মেসেজ পাঠিয়েছিলেন ‘বিগ বার্ড ইন কেইজ, স্মল বার্ডস হ্যাভ ফ্লোন।’

গ্রেফতারের তিন দিন পরে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয় উল্লেখ করে মেজর সালিক লিখেছেন, ‘পরে আমার বন্ধু মেজর বিলালের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, গ্রেফতার করার সময়ই মুজিবকে খতম করে দিলে না কেন? বিলাল বলেছিল, ‘জেনারেল টিক্কা খান ব্যক্তিগতভাবে ওকে বলেছিলেন, যেকোনো উপায়ে শেখ মুজিবকে জীবিত গ্রেফতার করতে হবে।’

পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান।

সারাবাংলা/এজেড/এমও

২৫ মার্চ ১৯৭১ গণহত্যা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর