‘অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ ও সিগারেটের আগুন’
৮ এপ্রিল ২০২৩ ১৭:৩৪
ঢাকা: দেশে ২০২২ সালে সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে ৬৬টির বেশি। বছরটিতে সবচেয়ে বেশি আগুন লেগেছে বাসাবাড়ি বা আবাসিক ভবনের বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে। এছাড়াও অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম কারণগুলো হলো—বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো এবং চুলা (ইলেকট্রিক, গ্যাস ও মাটির) থেকে অগ্নিকাণ্ড।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি এড়াতে এখনই প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া। বড় কোনো দুর্ঘটনার পরে কিছুদিন আলোচনায় না রেখে সারাবছর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি সমন্বিত টাস্কফোর্সের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, নাগরিকদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিতে হবে। একইসঙ্গে আগুনের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ কমিয়ে এনে প্রাথমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য নাগরিকদের মাঝেও সচেতনতা বাড়াতে হবে।
অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম কারণ
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী— ২০২২ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। এ কারণে মোট ৯ হাজার ২৭৫টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। শতকরা হার ৩৮ দশমিক ৪৮। এতে মোট ক্ষতি হয় ১৩৩ কোটি ৬৭ লাখ ৪৮ হাজার ৪৯৭ টাকা।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে। মোট অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ৩ হাজার ৮৭৮। শতকরা হার ১৬ দশমিক শূন্য ৮। এ কারণে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড থেকে এক বছরে মোট আর্থিক ক্ষতি হয় ৩৪ কোটি ৬৪ লাখ ৮৭ হাজার ১৬৪ টাকা।
অগ্নিকাণ্ডের তৃতীয় প্রধান কারণ হলো চুলা (ইলেকট্রিক, গ্যাস ও মাটির চুলা ইত্যাদি)। এ কারণে মোট ৩ হাজার ৩৬৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। শতকরা হার ১৩ দশমিক ৯৮। এ কারণে মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৮৩ কোটি ৫১ লাখ ২০ হাজার ৮২৯ টাকা।
চতুর্থ সর্বোচ্চ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে গ্যাস সরবরাহ লাইনের আগুনের কারণে। এ কারণে মোট ৭৯৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। শতকরা ৩ দশমিক ৩০। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ৯০৩ টাকা।
অগ্নিকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য আরেকটি কারণ ছিল ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা। এ কারণে এক বছরে মোট ৬০২টি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। শতকরা হার ২ দশমিক ৫০। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি ৫৬ লাখ ৪৩ হাজার ১২৫ টাকা।
এছাড়া অন্যান্য কারণের মধ্যে আছে খোলা বাতি ব্যবহার (৩২৭টি), উত্তপ্ত ছাই বা জ্বালানি (৪৮৮টি), যন্ত্রাংশের ঘর্ষণজনিত (১৬৭টি), শত্রুতামূলক ও উচ্ছৃঙ্খল জনতা কর্তৃক অগ্নিসংযোগ (১৫৭টি), বজ্রপাত ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ (৪৮টি), বাজি পোড়ানো (৯৪টি), মাত্রাতিরিক্ত তাপ (১৬৫টি), মেশিনের মিসফায়ার (১৬০টি), স্বতঃস্ফূর্ত প্রজ্বালন (২৯টি) ইত্যাদি।
অগ্নিঝুঁকিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের অধিকাংশ ভবন
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সামগ্রিকভাবে সারাদেশের ৩৮.৮৭ শতাংশ ভবন রয়েছে অগ্নিঝুঁকিতে। ঝুঁকিতে থাকা এই সব ভবনে রয়েছে বিভিন্ন আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
দেশে সবচেয়ে বেশি ঢাকায় ৫৪.৬৭ শতাংশ ভবন রয়েছে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি এক হাজার ১৬২টি ভবন পরিদর্শন করে। এর মাঝে ৬৩৫টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ফায়ার সার্ভিস। যার মধ্যে ১৩৬টি ভবন অতিঝুঁকিপূর্ণ এবং ৪৯৯টি ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিবেদনে রাজধানীর ৫২৭টি ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা সন্তোষজনক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
চট্টগ্রামে অগ্নিঝুঁকি রয়েছে ৫৪.২৯ শতাংশ ভবনে। এই বিভাগের সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এক হাজার ৬৭৬টি ভবন পরিদর্শন করে ৯১০টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ফায়ার সার্ভিস। এ এলাকায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ৪৬৩টি ভবন অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৪৪৭টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
খুলনায় ৪১.৪৬ শতাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে। এই বিভাগের খুলনায় ৪১০টি ভবন পরিদর্শন করে ১৭০টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।
বরিশালে ৬৯২টি ভবন পরিদর্শন করে ২০৫টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই বিভাগে ২৯.৬২ শতাংশ ভবন অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে।
রংপুরে ২৪ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে আছে। এই বিভাগের ৫১২টি ভবন পরিদর্শন করে ১২৩টি ভবনকে অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।
সিলেটে ১৯.৭৬ শতাংশ ভবন অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে। এই বিভাগের ১৭২টি ভবন পরিদর্শন করে ৩৪টি ভবনকে অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।
রাজশাহীতে ১৪.৯৭ শতাংশ ভবন অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে। এই বিভাগের ৯৩৫টি ভবন পরিদর্শন করে ১৪০টি ভবনকে অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।
সবচেয়ে কম ময়মনসিংহে ১.৯৩ শতাংশ ভবন অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে। এই বিভাগের ৩০৬টি ভবন পরিদর্শন করে ৬টি ভবন অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় ফায়ার সার্ভিসের এক প্রতিবেদনে।
এর আগে, ঢাকায় বড় কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের পর ২০১৭ সালে ভবনগুলোর ওপর বিশেষ জরিপ চালায় ফায়ার সার্ভিস। হাসপাতাল, মার্কেট, আবাসিক হোটেল ও উঁচু ভবনগুলোর অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে।
সেখানে দেখা যায়, ঢাকার অধিকাংশ ভবনই অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে। ওই রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী ঢাকার ৯৬ শতাংশ বিপণি বিতান, ৯৮ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৯৮ শতাংশ হাসপাতাল-ক্লিনিক অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দৈব চয়নের ভিত্তিতে বা সাধারণত কিছু বিষয়কে প্রাথমিক মানদণ্ড মেনে এই ঝুঁকিপূর্ণ ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা হয়। এর মাঝে রয়েছে ভবনের মাটির নিচের জলাধারের ধারণক্ষমতা, অবস্থানকারীর সংখ্যা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্ততা, ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকরণ যন্ত্রের উপস্থিতি, মেঝের আয়তন, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, লিফট ইত্যাদি খতিয়ে দেখা। এসব তথ্য পর্যালোচনা করা ভবনগুলোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ ও ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বলছে, ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে সতর্ক করা হলেও সরকারি কিংবা বেসরকারি কর্তৃপক্ষ কেউই আমলে নেয় না। আইনি ক্ষমতা না থাকায় কোনো ধরনের ব্যবস্থাও নিতে পারে না ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে মালিকদের চিঠি দেই। আমাদের কাজ সমস্যা চিহ্নিত করা, মানুষকে সচেতন করা। আমাদের কাজ বল প্রয়োগ করা নয়। যারা মানছে না আমরা তাদেরও চিহ্নিত করি। আইন প্রয়োগ করার জন্য অন্য সংস্থা রয়েছে।’
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
বিশ্লেষকরা বলছেন, নগরায়ণের ফলে মানুষের জীবন মান বাড়ছে, একই সঙ্গে বাড়ছে বিভিন্ন কেমিক্যালের ব্যবহার। কিন্তু সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফায়ার সেফটি বাড়ছে না। ফলে ক্রমেই অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বাড়ছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের সাবেক পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘আমাদের সীমিত জ্ঞান, সচেতনতা ও গুড প্র্যাকটিসের অভাবে অগ্নিকাণ্ড বাড়ছে। অনেকে হাজার কোটি টাকার ভবন নির্মাণ করছে, কিন্তু সেফটির জন্য পাঁচ পয়সাও খরচ করতে চায় না। কিন্তু কোনো ভবনের নির্মাণ ব্যয়ের এক থেকে তিন ভাগ ফায়ার সেফটির জন্য খরচ করতে হবে। তা না হলে ফায়ার সার্ভিস বাংলাদেশের ঘরে ঘরে রাখলেও পাঁচ পয়সার কোনো কাজ হবে না।’
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স এবং প্রয়োজনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সমস্ত ব্যবস্থাপনা প্রতিবছর নিয়মিত মহড়ার মাধ্যমে করা হচ্ছে কিনা সেই ব্যাপারে সতর্ক পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রতি বছর সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে নবায়নযোগ্য কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা করা দরকার যেখানে ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সসহ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো যুক্ত থাকবে। এর ফলে যে সমস্ত জায়গা থেকে আগুন লাগতে পারে সেটা সুইচ বোর্ড হোক বা শর্ট সার্কিটের বিভিন্ন জায়গা হোক বা এইচডিবি বোর্ড বা ডিবি বোর্ড হোক, ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ড হোক অথবা গ্যাসের সংযোগ বা লিফট – এগুলোর প্রতি বছর সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ভবনে বাধ্যতামূলকভাবে বছরে অন্তত ছয় বার ফায়ার ব্রিগেড সিভিল ডিফেন্সের তত্ত্বাবধানে মহড়ার ব্যবস্থা করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। তা না হলে মৃত্যুর মিছিল বাড়বেই। আমরা আধুনিক ভবন, আধুনিক সভ্য দেশ, স্মার্ট লিভিং যাই বলি না কেনো তা আমাদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর কোনো সুযোগই রাখবে না।’
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘ঢাকায় রাজউকের কাছে পরিকল্পনার কাগজ জমা হয়ে থাকে। মূলত তারাই হচ্ছে কাস্টডিয়ান এক্ষেত্রে। একটা ভবনের ফায়ার সেফটি সব ঠিক আছে কিনা সে বিষয়ে তাদেরও ভূমিকা থাকে। ভবনের পরিকল্পনা জমা দেওয়ার পরে সেখানে ফায়ার সেফটি ইস্যুতে কমপ্লায়েন্স আছে কিনা তাও তাদের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আর ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ তো এগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই করার কথা। ভবন মালিকদের পাশাপাশি আমাদেরও কিছুটা সচেতনতার জায়গা থাকে এখানে। আগুনের সূত্রপাত হতে পারে এমন কিছু ভবনে আছে কিনা তা চেক করা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘অগ্নি নিরাপত্তার সঙ্গে অনেকগুলো সংস্থা জড়িত। এসব সেবাসংস্থার মধ্যে আন্তঃযোগাযোগের ঘাটতি আছে। যথাযথ সমন্বয় ও আইনের প্রয়োগ না থাকায় অনেকেই অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে উদাসীন। তবে মানুষের জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকারের কঠোর হতে হবে।’
সারাবাংলা/এসবি/একে