নিহতের সন্তানকে সঞ্চয়পত্র কিনে দেওয়ার শর্তে আসামির জামিন
১২ এপ্রিল ২০২৩ ২১:০৭
ঢাকা: বালিশচাপা দিয়ে হত্যার অভিযোগের মামলায় নিহত নারীর নাবালক সন্তানের নামে চার লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনে দেওয়ার শর্তে আসামিকে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট।
গত ৩০ মার্চ বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
আদালতে জামিন আবেদনের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মোতাহার হোসেন সাজু। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মিজানুর রহমান।
রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৯ সি (২) ধারায় বলা হয়েছে, যে একজন দায়রা জজ বা একজন অতিরিক্ত দায়রা জজ বা সহকারী দায়রা জজ যে তারিখে মামলাটি বিচারের জন্য গ্রহণ করবেন তার ৩৬০ দিনের মধ্যে মামলার বিচার শেষ করবেন। পেনাল কোডের ৩৩৯ সি (২) ধারায় আরও বলা হয়েছে যে, যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার শেষ না করা যায়, তাহলে জামিন অযোগ্য অপরাধের অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে। তাই যেকোনো আসামিকে বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাগারে আটক রাখা যাবে না।
রায়ে আদালত উল্লেখ করেন, এক্ষেত্রে বিচারিক আদালত কর্তৃক মামলা প্রাপ্তির তারিখ থেকে ৩৬০ কার্যদিবস অতিবাহিত হয়েছে। অভিযুক্ত আবেদনকারী তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে রয়েছে এবং অনিবার্যভাবে, মামলার বিচার কার্যক্রমের সমাপ্তি বিলম্বিত হতে চলেছে। অভিযুক্ত আসামির দীর্ঘ কারাবাস এবং বিচারের সমাপ্তির অনিশ্চয়তা বিবেচনায় আমরা মনে করি যে, অভিযুক্ত আসামির জামিন ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৯ সি (৪) ধারা [Cr.P.C এর ধারা 339C (4)] অনুযায়ী এই সুবিধা পাওয়া উচিত।
রায়ে আদালত আরও উল্লেখ করেন, এ ছাড়া অভিযুক্ত আসামি রমজান ঢালী ভুক্তভোগীর নাবালক সন্তানের সুস্থতা ও ভরণপোষণের জন্য চার লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। এজন্য তিনি ওই ছেলের জন্য ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, সদরঘাট শাখায় গত ৯ মার্চ একটি পে অর্ডার কেনেন। পাশাপাশি এ বিষয়ে আসামি রমজান ঢালী আইনজীবীর মাধ্যমে অঙ্গীকার করেছেন যে, বিচারের পর তিনি অভিযোগ থেকে খালাস পেলেও এই টাকা দাবি করবেন না।
রায়ে আদালত বলেন, মামলার রেকর্ড অনুযায়ী- বিবাহ বিচ্ছেদের পর থেকে নাবালক শিশুটি তার মায়ের সঙ্গে ছিল। মা খুন হওয়ায় শিশুটির সুস্থতার কথা বিবেচনা করে আমরা অভিযুক্ত আসামির প্রস্তাব গ্রহণ করছি। মামলার বাস্তবতা ও পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা অভিযুক্ত আসামিকে এই মামলার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত জামিন দিতে চাই।
রায়ে আদালত ইসলামী ব্যাংকের সদরঘাট শাখায় ডিপোজিটকৃত চার লাখ টাকা নগদায়ন করে সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখায় ওই নাবালক শিশুর নামে তিন বছরের জন্য একটি সঞ্চয়পত্র কেনার নির্দেশ দেন। সঞ্চয়পত্রটি তিন বছরে পরিপক্ক হওয়ার পর ওই শিশু সুদসহ মোট টাকা গ্রহণ করবে বলে রায়ে আদালত উল্লেখ করেন।
রায়ে হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট কোর্টের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমানকে সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখায় সঞ্চয়পত্রটি পরিচালনার জন্য শিশুটির অভিভাবক হিসেবে মনোনীত করে দিয়েছেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০২০ সালে স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর আমেনা নামে এক নারী রাজধানীর খিলগাঁওয়ে একটি ফ্ল্যাটে একমাত্র সন্তানকে (১৩) নিয়ে বসবাস করতে থাকেন। খিলগাঁওয়ে ফ্ল্যাটে বসবাস করার সময়ে রমজান ঢালী নামে দুই সন্তানের জনকের সঙ্গে আমেনার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর রমজান ঢালী ২০২০ সালের ২১ মার্চ আমেনার ফ্ল্যাটে ঢুকে বালিশচাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করে চলে যায়। হত্যার আড়াই মাস আগে স্বামীর সঙ্গে আমেনার বিচ্ছেদ হয়।
হত্যার দু’দিন পর ২৩ মার্চ আমেনার ভাই মো. আইয়ুব হত্যার অভিযোগে খিলগাঁও থানায় এজাহার দায়ের করেন। এবং একই দিন রমজান ঢালীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এবং ২৪ মার্চ ঢাকা মহানগর অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন রমজান ঢালী। এরপর ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন এবং ২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি আদালত রমজান ঢালীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। এই সময়ে একাধিকবার রমজান ঢালীর জামিন আবেদন নামঞ্জুর হয়।
এরপর হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করেন রমজান ঢালী। আদালত শুনানি শেষে রুল জারি করেন। এরপর গত ৩০ মার্চ রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।
এ বিষয়ে আসামি পক্ষের আইনজীবী মোতাহার হোসেন সাজু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আজ (১২ মার্চ) সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখায় নিহতের নাবালক সন্তানের নামে তিন বছর মেয়াদী চার লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট কোর্টের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমান সঞ্চয়পত্রের ফরমে শিশুর অভিভাবক হয়েছেন। তিন বছর পর ওই শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হবে, তখন সুদসহ সঞ্চয়পত্রের সমুদয় টাকা তার হাতে তুলে দেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিশুর নামে সঞ্চয়পত্র কিনে দেওয়ার কারণে মামলায় কোন ধরনের প্রভাব পড়বে না। মামলায় পরবর্তী সময়ে নিজের পক্ষে রায় পেলেও আসামি এই টাকা দাবি করতে পারবেন না।’ আদালত রায়ে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আসামি রমজান ঢালীকে জামিন দিয়েছেন।
সারাবাংলা/কেআইএফ/পিটিএম