যেভাবে বিবর্তিত বাংলা সন ও মঙ্গল শোভাযাত্রা
১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:০২
ঢাকা: বাঙালির অন্যতম প্রধান উৎসব পহেলা বৈশাখ। সর্বজনীন এ উৎসব ‘বৃহৎ বাংলা’— তথা বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সীমানা পেরিয়ে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে। এ ভূ-মণ্ডলে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান উৎসব হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে বৈশাখের প্রথম দিনটির বর্ণিল আয়োজন।
ঢাকার রমনার বটমূল থেকে পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ,পূর্ব-পশ্চিম— যতদূর পর্যন্ত বাঙালির বসবাস, ততদূর পর্যন্ত এ উৎসবের ব্যপ্তি। প্রায় চার দশক আগে এ উৎসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা, যা এখন বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত।
পহেলা বৈশাখ নিয়ে বাঙালির এই মাতামাতি, আবেগমথিত আয়োজন কবে থেকে শুরু, কীভাবে শুরু?— তারও একটা গল্প আছে, গল্প আছে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু নিয়েও।
বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল মুঘল সম্রাট আকবরের হাতে— এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। দুই বাংলার গবেষক এবং ইতিহাসবিদরা এ ব্যাপারে একমত। তাদের সম্মিলিত গবেষণায় এ সত্য প্রতিষ্ঠিত যে, বাঙালির কৃষি কাজের সূচনা থেকেই বাংলা সনের উদ্ভব।
বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহা থেকে শুরু করে ড. অমর্ত্য সেন পর্যন্ত ভারতের প্রায় সকল বাঙালি বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ ও নৃতত্ত্ববিদ সম্রাট আকবরকেই বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে মেনে নিয়েছেন। তাদের মতে, ইতিহাস বিবেচনায় মুঘল সম্রাট আকবরই বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের উদ্ভাবক।
ভারতের পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির প্রধান ড. মেঘনাদ সাহা ১৯৫৪ সালে অংক কষে ঘোষণা করেন যে, সম্রাট আকবরই বাংলা সনের প্রবর্তক। পরে উড়িষ্যার ইতিহাসবিদ কাশীপ্রসাদ জয়সোবাল এ মতকে সমর্থন করেন। তাদের অভিন্ন মত হল- সম্রাট আকবরই ফসলি সন হিসেবে বাংলা সন চালু করেছিলেন। হিজরি সনকে সৌর বছরে পরিণত করে বাংলা সন চালু করেন তিনি। বাংলা সন প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে সম্রাট আকবর চেয়েছিলেন রাজস্ব প্রশাসনের সংকট দূর করতে। আর এভাবে বাংলা সনের উদ্ভব।
কৃষিনির্ভর ‘বৃহৎ বাংলায়’ সম্রাট আকবরের এই উদ্ভাবন এখনও বহুল স্বীকৃতি ও চর্তিত প্রথা। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ও কৃষি অর্থনীতে ব্যবহার হয়ে আসছে বাংলা সন। ফসল থেকে আরম্ভ করে ব্যবসা- সব কাজেই এর গুরুত্ব অপরিসীম। এখনও গ্রামীণ সমাজে দোকান ভাড়া, জমি বন্ধক, বর্গাচাষ, হিসাব-নিকাশের ভিত্তি দিন হিসেবে ধরা হয় ৩০ চৈত্র কিংবা পহেলা বৈশাখকে।
তবে অন্যন্যা বিষয়ের মতো বাংলা সন সংক্রান্ত এ মীমাংসিত বিষয়টি নিয়েও কিছু বিতর্ক রয়েছে। সাম্প্রতিককালে ভারতের একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন দাবি তুলেছে- সম্রাট আকবর নন, গৌড়ের প্রাচীন হিন্দু রাজা শশাঙ্ক বাংলা সনের প্রবর্তন করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) তাত্ত্বিক নেতা জিষ্ণু বসুর মতে, সম্রাট আকবর তার জীবদ্দশায় বাংলার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কখনোই পাননি। ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধ জিতে মুঘলরা প্রথম বাংলা দখল করলেও বহু বছর ধরে যুদ্ধ চলেছিল। আর বেছে বেছে সেই অস্থির বাংলাতেই আকবর একটা নতুন সাল চালু করবেন, সেটা খুব অস্বাভাবিক।
বাংলা সন কে চালু করেছিলেন, তা নিয়ে ইতিহাসে মোট চারটি মত আছে। প্রথম মতটি হচ্ছে- তিব্বতের রাজা স্রং সন বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। ৬০০ খ্রিস্টাব্দের কিছু আগে স্রং সন যখন রাজা হন এবং মধ্যভারত ও পূর্ব ভারত জয় করেন তখন বাংলার উত্তরাঞ্চলের অনেকটাই তিব্বতি সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত ছিল। আর বাঙ্গালা শব্দটিও তিব্বতি শব্দ বন্ স থেকে এসেছে। এই বন্ স শব্দের অর্থ ভেজা মাটি, যা বাংলাদেশকেই ইঙ্গিত করে।
দ্বিতীয় মত হল- গৌড়ের প্রাচীন হিন্দু রাজ শশাঙ্ক বাংলা সনের প্রবর্তন করেছেন। তৃতীয় মতটি হল- সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলা সনের প্রবর্তক। সর্বশেষ এবং সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য মত হল- সম্রাট আকবর ছিলেন বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ, গণিতবিদ ও নৃতত্ত্ববিদ সর্বশেষ মতটাকেই সমর্থন করেন। তাদের গবেষেণা ও পর্যালোচনামতে সম্রাট আকবরই বাংলা সনের প্রবর্তক।
বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক ড. মোরশেদ শফিউল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলা সনের প্রবর্তক কে?— এটা আসলে একটা একাডেমিক আলোচনার বিষয়। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে এই আলোচনার অবতারণা হয়। এবারও হচ্ছে। কিন্তু এই আলোচনা আমাদের তেমন একটা কাজে আসে বলে মনে হয় না।’
‘পহেলা বৈশাখকে বলা হয় বাঙালির একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় উৎসব। এছাড়াও আমাদের বাংলাদেশের বাঙালিদের জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলই ডিসেম্বরের মতো আরও কিছু কিছু দিবস আছে যেগুলোর আবেদন ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য সমান। তবে সেসব কোনো কোনো দিনের সঙ্গে আমাদের শোক ও বেদনার স্মৃতিও জড়িত। অর্থাৎ অবিমিশ্র আনন্দের দিন তা নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের বাইরে অন্য বাঙালিদের কাছেও সেগুলো বিশেষ আবেদন নিয়ে উপস্থিত হয় না। এ সব দিক থেকে বিবেচনা করলে পহেলা বৈশাখই যে সারা পৃথিবীর বাঙালির একমাত্র যদি নাও হয়, প্রধান ধর্মনিরপেক্ষ বা সর্বজনীন পার্বণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই’— বলেন মোরশেদ শফিউল হাসান।
তিনি বলেন, ‘অথচ এই পার্বণটিও এখন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে আগে-পরে দুটি ভিন্ন দিনে পালিত হচ্ছে। আর এরই ধারাবাহিকতায় পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ বা এগারোই জৈষ্ঠ্যের মতো দিনগুলোও দুই বাংলায় দুটি আলাদা দিনে পালিত হয়। সাধারণ দৃষ্টিতেও এটি একটি বিসদৃশ ব্যাপার নয় কি? অধিকন্ত সম্প্রতি ভারতের একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন সম্রাট আকবর নন, গৌড়ের প্রাচীন হিন্দু রাজ শশাঙ্ক বাংলা সনের প্রবর্তন করেছেন বলে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। আমার মতে এসব বিতর্কের তাৎপর্য যতটা না ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। আর সে উদ্দেশ্য থেকেই তা আমদানি করা হচ্ছে।’
মঙ্গল শোভাযাত্রা
বৈশাখ উদযাপনের ইতিহাস কয়েকশ’ বছরের পুরনো হলেও মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম শুরু হয় ১৯৮৫ সালের পহেলা বৈশাখ যশোরে। দেশের লোকজ সংস্কৃতি উপস্থাপনের মাধ্যমে সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা ছিল এর উদ্দেশ্য। সেই শোভাযাত্রায় অশুভের বিনাশ কামনা করে শুভশক্তির আগমনের প্রার্থনা করা হয়। এর উদ্যোগ নিয়েছিলেন চারুশিল্পী মাহবুব জামাল শামিম। শেষ পর্যন্ত যশোরে সীমাবদ্ধ থাকেনি মঙ্গল শোভাযাত্রা।
ঢাকার চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। শুরুতে এর নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্র’। পরবর্তী সময় এটি ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হিসেবে পরিচিত হয়। ওই সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। সে সময় সবাইকে এক প্ল্যাটফর্মে আনার চেষ্টা করেছিল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।
অবশ্য শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার বেশ কয়েকটি বড় উদ্যোগ স্বৈরশাসক এরশাদের আমলেই গৃহীত হয়। অগণতান্ত্রিক শক্তির বিনাশ শোভাযাত্রার মূলভাব হিসেবে গ্রহণের মধ্যেই সরকারিভাবে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী পালনের উদ্যোগ এরশাদের আমলেই গ্রহণ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে ড. মোরশেদ শফিউল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক দশক ক্ষমতায় ছিলেন এরশাদ। তার শাসনামলে কি ভালো কাজ কিছু হয়নি? সরকারি উদ্যোগে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী পালন তো তার আমলেই শুরু হয়েছে। তখনও আমাদের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মী এর বিরোধিতা করেছিলেন। আমি শুনেছি বেগম সুফিয়া কামালকে দিয়ে শিলাইদহে প্রথমবারের রবীন্দ্র জয়ন্তীটি উদ্বোধন করাতে চেয়েছিলেন এরশাদ।’
সময়ের ব্যবধানে পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা সবধরনের মানুষের অংশগ্রহণে একটি প্রধান অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আবহমান বাংলার বিভিন্ন লোকজ উপাদান এই শোভাযাত্রায় ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রা উপলক্ষে হাতে তৈরি করা হয় বিভিন্ন মুখোশ, মূর্তি, ট্যাপা পুতুল, নকশি পাখি, বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। এ শোভাযাত্রাকে শোভিত করার জন্য যে উপাদানগুলো লাগে, সেগুলো শুরু থেকেই নেওয়া হয় দেশের লোকশিল্পের নানা ধরনের খেলনা থেকে। এর বাইরে ঘোড়া, নকশি পাখা, ফুল, প্রজাপতি, মানুষ, প্রকৃতি এগুলো শোভাযাত্রায় স্থান পেতে থাকে।
ঢাকায় আনন্দ শোভাযাত্রা শুরুর এক বছর পর ১৯৯০ সালের আনন্দ শোভাযাত্রায় নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তার নতুন মাত্রা লাভ করে। চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিল্পীদের উদ্যোগে আয়োজিত সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পীসহ সাধারণ নাগরিকরা অংশ নেন। শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালাকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশ খচিত প্ল্যাকার্ডসহ শোভাযাত্রাটি নাচে-গানে উৎফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। দিনদিন এই শোভাযাত্রা আরও বর্ণিল হয়েছে।
মঙ্গল শোভাযাত্রার বিশ্ব স্বীকৃতি
সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনের ভিত্তিতে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ জাতিসংঘের সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে। ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে তাদের ‘রিপ্রেজেনটেটিভ লিস্ট অব ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। স্বীকৃতি দেওয়ার কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে, এটা শুধু একটা সম্প্রদায় বিশেষের নয়, গোটা দেশের মানুষের, সারা পৃথিবীর মানুষের।
এ স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় যোগ হয়েছে এক নতুন মাত্রা। বাঙালি সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। এটি এখন বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ।
নববর্ষ ১৪৩০-এর শোভাযাত্রা
বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির কারণে ১৪২৭ বঙ্গাব্দে (২০২০ খ্রিস্টাব্দে) মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়নি। ১৪২৮ বঙ্গাব্দে (২০২১ খ্রিস্টাব্দ) হয়েছে সীমিত পরিসরে। ১৪২৯ বঙ্গাব্দে (২০২২ খ্রিস্টাব্দ) পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা চেনা রূপে ফেরে। গতবার টিএসসি থেকে স্মৃতি চিরন্তন এলাকা ঘুরে আবার টিএসসিতে গিয়ে শেষ হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। করোনা থেকে ইতিবাচক পরিস্থিতির দিকে যাওয়ায় গতবারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’।
যুদ্ধ, হিংসা, হানাহানির অবসান প্রত্যাশায়, পৃথিবীজুড়ে শান্তির বৃষ্টি প্রার্থনায় এবারের (১৪৩০ বঙ্গাব্দ) প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের বাণী ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’। শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ৯টা ১০ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণ থেকে মঙ্গলশোভাযাত্রা শুরু হয়ে শাহবাগ ঘুরে শেষ হয় ৯টা ৫০ মিনিটে।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম