বিবর্তনের ধারায় পুষিয়ে নেওয়ার ঈদ
২৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:২৬
১.
ইসলামপূর্বযুগে আরবের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ও ব্যবস্থা কোনোক্রমেই সেই সময়কার সামাজিক অবস্থার চেয়ে উন্নত ছিল না। প্রকৃতপক্ষে তিজারত বা ব্যবসা-বাণিজ্যই ছিল আরব অধিবাসীদের জীবন ও জীবিকার প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। কিন্তু দেশ থেকে দেশান্তরে যাতায়াত, মালপত্র পরিবহন, বাণিজ্য উদ্দেশ্যে ভ্রমণ-পর্যটনের জন্য নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা— ইত্যাদি বিষয়গুলো এতই সমস্যাসংকুল ছিল যে, নির্বিঘ্নে ব্যবসা বাণিজ্য করা ছিল রীতিমতো কঠিন ব্যাপার। সে সময় মরুপথে গমানগমন এবং মালপত্র পরিবহনের একমাত্র বাহন ছিল উট। উটের পিঠে চড়ে যাতায়াত ও মালপত্র পরিবহনের ব্যাপারটি ছিল অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। তাছাড়া পথও ছিল বিপদসংকুল।
সব দিক দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত বড় বড় কাফেলা ছাড়া পথ চলার কথা চিন্তাই করা যেত না। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে কোনো সময় দস্যুদল কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে এবং যথাসর্বস্ব লুণ্ঠিত হওয়ার ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকতে হত কাফেলার সবাইকে। তবে যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধের মাসগুলোতে তারা কিছুটা নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারতেন। অবশ্য তা ছিল অল্প সময়ের পরিসরে সীমাবদ্ধ। কাজেই বাণিজ্যনির্ভর হলেও নানাবিধি কারণে ব্যবসা বাণিজ্য তারা তেমন সুবিধা করতে পারত না। কেবল নিষিদ্ধ মাসগুলোতে ‘ওকায’, ‘যিলমাজাযৎ, ‘মাজিন্না’ এবং আরও কয়েকটি প্রসিদ্ধ উৎসব বা মেলায় কেনাবেচা করে তারা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করত।
প্রায় ১৫’শ বছর আগে বালুকাময়, উষর, ধূসর, লতা-গুল্মহীন, প্রাণ-প্রকৃতিবিহীন আরবের বাসিন্দারা ব্যবসা-বাণিজ্য পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকত নিষিদ্ধ (যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধের মাস) মাসগুলোর জন্য। আর বর্তমানের বাংলাদেশ অপেক্ষায় থাকে দুই ঈদের জন্য। আরবদের মতো দস্যুদের আক্রমণ, পরিবহন, যাতায়াত ও নিরাপত্তা, নিয়ে সারা বছর খুব একটা ভাবতে না হলেও রমজান মাস এবং দুই ঈদকে এ দেশের ব্যাবসায়ীরা নিয়েছে ‘পুষিয়ে নেওয়ার উৎসব’ হিসেবে।
২.
আরবি ঈদ শব্দের আভিধানিক অর্থই উৎসব। অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দশকের দ্বিতীয় পাদে অর্থাৎ ৭১২ খ্রিস্টাব্দে খলিফা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভাইপো ও জামাতা ১৭ বছর বয়সী তরুণ মুহম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে সিন্ধু বিজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে ইসলাম আসে। কিন্তু ভারতবর্ষের স্বল্পপরিশ্রমে পর্যাপ্ত জীবনোপকরণের পরম্পরাগত ধারা আরবদের অলস, কুঁড়ে ও অপদার্থ জাতিসত্ত্বায় পরিণত করল। ভোগবিলাসের স্পৃহা ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগত শিথিলতা তাদের আরব ভূমিজাত বীরত্ব ও দিগ্বিজয়গত স্পৃহাকে ধূলিমলিন করে দিল। ফলে ইসলামের রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক মিশন সিন্ধু উপত্যকা অতিক্রম করে বৃহত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়তে পারল না। এর জন্য আরও তিন শ’ বছর অপেক্ষা করতে হল। অবশেষে ১০০০ খ্রিস্টাব্দে আফগান বীর গজনীর সুলতান মাহমুদ ভারতে রাজনৈতিক মিশন পরিচালনা করেন। ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পর তার দুর্বল উত্তরাধিকারীরা ইসলামের রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক মিশনের ধারা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন।
আলোকিত ও প্রবল প্রতাপান্বিত গজনী বংশ দুর্বল হয়ে পড়লে শক্তিশালী ঘুরি বংশ সে স্থান দখল করে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষায় অগ্রণী হয়। গজনী বংশে যেমন সুলতান মাহমুদ, ঘুরি বংশে তেমনি মুহম্মদ বিন সাম। ‘মুঈনউদ্দীন’ ও ‘শিহাবুদ্দীন’ তার উপাধি। ইনিই ভারত বর্ষের ইতিহাসে শিহাব উদ্দীন মুহম্মদ ঘুরি নামে পরিচিত। তার বিশ্বস্ত অনুসর কুতুবউদ্দীন আইবেক এবং কুতুবউদ্দীন আইকেবের বিশ্বস্ত অনুচর ইখতিয়ারউদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি; যিনি বিহার ও বঙ্গবিজয়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গে ইসালামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
অতএব এটা সন্দেহাতীভাবেই বলা যায় ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয় থেকে ১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয় পর্যন্ত এই ৪৮৯ বছর সময়কালে এদেশের উৎসবের তালিকায় দুই ঈদ যোগ হয়। কেননা ইসলামের নবী হয়রত মোহম্মদ (সা.) এবং চার খলিফার আমলে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা পালনের বিস্তারিত বর্ণনা ধর্ম এবং ইতিহাস গ্রন্থে সমানভাবে উল্লেখ আছে। সে সময়কার ঈদ কেন্দ্রিক সামাজিকতা, ভ্রাতৃত্ব, সমতা এবং আধ্যাত্মিকতার অসংখ্য কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে মুসলমান সমাজে। দিগ্বিজয়ী মুসলমান শাসকেরা যখন ভারতবর্ষ তথা বাংলায় আসেন, তখন ইসলামী সংস্কৃতি এবং উৎসব হিসেবে দুই ঈদ সঙ্গে নিয়েই এসেছিলেন।
ষোড়শ শতাব্দী জুড়ে পাঁচ মুঘল সম্রাট বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের আমলে ভারতবর্ষে যে সাড়ম্বরে ঈদ উদযাপন হয়েছে, সেটি বোঝা যায় ঐতিহাসিক একটা ঘটনার মধ্য দিয়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত না করার প্রয়াসে হুমায়ুন, আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলে ঈদুল আজহায় গরু জবাইয়ের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তবে অন্যান্য পশু জবাইয়ে নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
মুঘল আমলের শেষ দিকে ভারতবর্ষে খুব জাঁকজমকপূর্ণ ঈদ উৎসবের খবর পাওয়া যায় ‘মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে। জানা যায়, ঊনত্রিশ রমজান সম্রাটের প্রতিনিধিরা দেশের নানা প্রান্তে ছুটতেন শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার জন্য। সাম্রাজ্যের কোনো প্রান্তে চাঁদ দেখা গেলে সম্রাটের বার্তাবাহক সেই খবর নিয়ে দ্রুত রাজদরবারে ফিরতেন। বাজনাঘর বা নাকারখানায় পঁচিশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে ঈদের আগমনীবার্তা ঘোষণা করা হতো। শুরু হতো বাঁধভাঙা আনন্দ। এ আনন্দ চলত গভীররাত অব্দি। সকালে সম্রাটগণ শোভাযাত্রাসহ দিল্লি জামে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে যেতেন। শেষ দুই মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর ও বাহাদুর শাহ জাফরের আমলে এ ধরনের ঈদ উদযাপনের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে ইতিহাস গ্রন্থে।
৩.
প্রাচীন বঙ্গদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী মানব সম্প্রদায়ের একতাবদ্ধ জাতি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ধারণাকে অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা বা বৃহত্তর বাংলাদেশ বলা হয়ে থাকে, যাদের ইতিহাস অন্তত চারহাজার বছরের পুরোনো। রাঢ়, গাঙ্গেয়, সমতট অঞ্চল নিয়ে গঠিত এ অখণ্ড বাংলায় বহু শতাব্দী ধরেই ঈদ প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে।
সপ্তদশ শতকে মুঘল আমলে বাংলা, বিহার ও আসামের বিভিন্ন শহরে রমজান ও ঈদ পালনের বিবরণ পাওয়া যায় মির্জা নাথানের লেখা বিখ্যাত বই ‘বাহারিস্তান ই গায়েবি’তে। এর আগেও আফগান/পাঠান শাসনের সময় জাঁকজমকপূর্ণভাবে বাংলার মুসলিমরা ঈদ উৎসব পালন করতেন বলে ধারণা করা হয়। তবে মুঘল শাসনামলে ঈদ উৎসবের আনন্দ অনেকটা বেড়ে যায়। সব বয়সের মানুষ রমজানের সময় সেনা ব্যারাকে সমবেত হয়ে সেহরি ও ইফতার করতেন।
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রান্তবর্তী জনপদ ঢাকার পুরনো আফগান কেল্লাকে (পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায়) ঘিরেই মূলত ঈদের উৎসব পালন করা হতো। ঈদের আগের দিন চাঁদ দেখার জন্য সবাই মিলে জড়ো হওয়া ছিল ওই সময়ের অন্যতম ঈদ আকর্ষণ। চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা বিউগল বাজিয়ে ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে সে খবর জানান দিত। পদাতিক সেনারা কামান দাগাত ও আতশবাজির বিস্ফোরণ ঘটাত। এটি চলত মধ্যরাত পর্যন্ত। ঈদের দিন সেনা ব্যারাক, প্রাসাদ ও কিল্লায় ভোজসভার আয়োজন করা হতো। সেখানে ধনী-গরীব একসঙ্গে খানাপিনা করতেন। আয়োজন করা হতো নাচ ও গানের। অভিজাত শ্রেণিরা দরিদ্র লোকদের সাধ্যমত দান করতেন।
ঈদ উপলক্ষ্যে মেলার আয়োজন থাকত। সেখানে ঘোড়দৌড়, লাঠি খেলা, নাগরদোলা, পুতুল নাচ, বায়োস্কোপের পাশাপাশি চিত্ত বিনোদনের নানা অনুষঙ্গের সমাবেশ ঘটত। গ্রাম এবং শহর— উভয় প্রান্তেই বর্নিল আয়োজনে নির্মল আনন্দ উপভোগের সুযোগ এনে দিত ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা।
কালের বিবর্তনে এ দেশে ঈদ উৎসবের প্যাটার্ন বা ধরণ বারবার পরিবর্তন হয়েছে। এর পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে এ অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি), জীবনমান, শিক্ষার হার, শ্রমিক ও জনশ্রেণির বৈষয়িক উন্নতি। অর্থাৎ দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সামাজিক জীবনে যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, সেটার প্রতিফলন দেখা গেছে ঈদ উৎসবে।
গত শতাব্দীর শেষভাগেও ঈদ ছিল সামাজাকি ও পারিবারিক বন্ধনের প্রতীক। সকালে নামাজ শেষ করে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধুদের বাড়িতে যাওয়া, ফিরনি-সেমাই খাওয়া, কোলাকুলি করা এবং পরস্পরের খোঁজ-খবর নেওয়ার মধ্য দিয়ে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করার উপলক্ষ্য ছিল ঈদ। বিত্তবানরা বিচিত্র সব সুস্বাদু খাবার তৈরি করে অতিথি আপ্যায়নের পাশাপাশি প্রতিবেশীকেও খাওয়াত। গ্রামের সাধারণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাড়িতে রান্না করা খাবার এক উঠানে জমা করে সবাই মিলে একখানে বসে খেত। ঈদ উপলক্ষ্যে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা এবং প্রিয়তমা বধূর জন্য সাধ্যমতো নতুন জামা-কাপড়, জুতা ও অলঙ্কার কেনা ছিল গৃহকর্তার জন্য অবশ্য কর্তব্য। এগুলোর সঙ্গে অপার্থিব ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা, আনন্দানুভূতি, প্রীতি-মমতা জড়িত ছিল।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের ঈদ উৎসবে যোগ হয়েছে বিচিত্র মাত্রা। যা অতীতে ছিল নির্মল আনন্দের সরল বহিঃপ্রকাশ, তা বর্তমানে বিরাট এক বাণিজ্যিক উপলক্ষ্য। ঈদ উৎসবের এই রূপ পরিবর্তনের মূলে কাজ করছে নাগরিকদের একটা অংশ, যারা বিত্তে ও সম্পদে টইটম্বুর। এদের হাতে গচ্ছিত অর্থ ও সম্পদ বাজার অর্থনীতিতে বাড়িয়েছে কাঁচা টাকার সরবরাহ। কয়েকলাখ লোকের হাতে টাকার যে পাহাড় জমেছে, তার পরিমাণ কয়েক শ’ হাজার কোটি! সেখান থেকে ঈদ উপলক্ষ্যে কয়েক শ’ কোটি টাকা খরচ করলে, তাদের কিচ্ছু যায় আসে না। ফলে খারাপ অর্থনীতির গলা ফাটা চিৎকারের মধ্যেও ঈদের সময় ঢাকার অভিজাত বিপণীবিতানে পা ফেলার জায়গা পাওয়া যায় না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা অংশ পাশের শহর কোলকাতায় চলে যায় ঈদ শপিংয়ের জন্য। উচ্চবিত্তদের পছন্দ সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া।
বাংলাদেশে ঈদ এখন এক দিনের ব্যাপার নয়, বরং এই উৎসব মাসব্যাপী বা তার চেয়েও বেশি দিন ধরে চলে। যারা সচ্ছল ও সম্পদশালী, তাদের কেনাকাটার পর্ব শুরু হয় প্রথম রমজান থেকেই। মধ্যবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের লোকেরা বেতন-বোনাসের দিকে তাকিয়ে থাকেন। পয়সা হাতে এলে কেনাকাটার ন্যুনতম সুযোগ হাতছাড়া করেন না তারা। ফলে সচ্ছল, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত— সব শ্রেণির এই ভোগবাদী ঈদোৎসব কাজে লাগিয়ে সংযম ও ত্যাগের মাস ‘রমজান’কে ‘পুষিয়ে’ নেওয়ার মাস হিসেবে বেছে নেয় ব্যবসায়ী শ্রেণি।
শুধু জামা-কাপড়, জুতা ও অলঙ্কার নয়, ‘ঈদ’ সাধারণ মানুষের পীড়ন বাড়ায় নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি। ঝড়ের আগামবার্তা যেমন মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক তৈরি করে; মানুষ তার জানমালের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় দুমড়ে মুচড়ে যায়, ঠিক তেমনি গত কয়েকদশক ধরে রমজান এবং ঈদের আগমনের বার্তায় নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতের আশঙ্কায় দুমড়ে মুচড়ে যায়। দিন দিন এই শঙ্কা বাড়ছে। আগামীতে হয়তো রমজান এবং ঈদ উৎসব হিসেবে নয়, আতঙ্কানুষঙ্গ হিসেবে হাজির হবে।
অতীতে ঈদ তার আগমনের বার্তা শহর-বন্দর-গ্রামে, কৃষকের কুঁড়ে ঘরে, মহানগরের জনাকীর্ণ ব্যস্ত সরণিতে, যুগপ্রাচীন গ্রামীণ বাজারে, পরাক্রমশালী ও বিত্তবান ব্যক্তিদের প্রাসাদে এমনকি দরিদ্র ও বঞ্চিতদের মাঝে আনন্দের ফল্গুধারা ছড়াত; এখনও ছড়ায়। তবে আগে যেটা ছিল দেশজ কৃষি পণ্য সামগ্রী এবং কুটির শিল্পজাত গ্রামীণ অর্থনীতি নির্ভর উৎসব, এখন সেটা বহুজাতিক কোম্পানির লেবেল আঁটা বিলাস পণ্য ও ‘সেবা’ নামক ফাঁদে বন্দি। ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির সঙ্গে যারা মানিয়ে নিতে পেরেছে, যাদের আয় কোনো সীমা-পরিসীমায় আবদ্ধ নয়, তাদের ঈদ একরকম। নিম্ন এবং নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ঈদ আরেক রকম। দুই শ্রেণির মধ্যকার দূরত্বটা যে ‘মাশরিক’ থেকে ‘মাগরিব’ পর্যন্ত, সেটা বোঝা যায় ঈদ এলে।
তবে প্রাণের প্রাচুর্যের কাছে সম্পদের ঐশ্বর্য যে কিছু না, সে সত্য এখনও অটুট রয়েছে এ বাংলায়। চাইনিজ, চাওমিন, ফালুদা, কাস্টার্ড, কাচ্চি-বিরিয়ানি, জর্দা-তেহারি, কোরমা-কালিয়া, বাকরখানি-পরোটার শাহী ঘ্রাণের চেয়ে গ্রামে মায়ের হাতে তৈরি কম চিনি, কম দুধের সুজি-হালুয়া-ফিরনি মানুষকে বেশি টানে। তাই প্রতি ঈদে মানুষ শহর ছেড়ে ঝাক বেঁধে গ্রামমুখী হয়। যেখানে প্রবাহমান নদ-নদী এবং এঁকেবেঁকে চলা খালের ওপারে ছায়া সুনিবিড় শ্যামল গ্রামে চলে ঈদের আয়োজন। ছায়াময় গাছের নিচে ছোট মসজিদটির প্রাঙ্গণ জুড়ে পরিচ্ছন্ন জামাকাপড়ে ভূষিত গ্রামীণ জনসাধারণের ভিড় জমে। রঙ-বেরঙের জামাকাপড়ে সজ্জিত হাসিখুশি শিশুর সমাবেশ এবং তুলনামূলক কমমূল্যের অথচ সুস্বাদু খাদ্যসামগ্রীতে মেলে অপার্থিব আনন্দ।
বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার প্রযুক্তি আসার আগে ডায়েরি, পিন-আপ, পোস্টার, ভিউকার্ড ইত্যাদির মাধ্যমে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় ব্যাপক প্রচলন ছিল। তরুণ প্রজন্ম ঈদকার্ডবিহীন ঈদ ভাবতেই পারত না। বছর কুড়ি আগেও রমজানের শেষ সপ্তাহে স্থায়ী দোকানপাটের পাশাপাশি হাট-বাজার, ব্যস্ত সড়ক এমনকি গ্রামের মেঠ পথে রঙ-বেরঙের ঈদকার্ড এবং নানা ডিজাইনের ভিউকার্ডের অস্থায়ী দোকান বসত। অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং কিশোররা ঈদের সামনে বাবা মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঈদ কার্ডের দোকান দিয়ে বসত। টং ঘর আকৃতির ওই দোকান যতটা না অর্থ উপার্জনের, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল নির্মল আনন্দের। টং ঘরের লাল সালু কাপড়ের দেয়ালে সুতা টাঙিয়ে হরেক রকম কার্ড ঝুলিয়ে রাখা হতো বিক্রির জন্য। প্রিয়জনকে ঈদ শুভেচ্ছা জানাতে নানা বয়সী মানুষ সানন্দে সেগুলো কিনে নিত।
আধুনিক প্রযুক্তির উত্থানের ফলে আজকাল স্মার্টফোন, ইন্টারনেট প্রযুক্তির মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যেই প্রিয়জনকে মেসেজ পাঠানো যাচ্ছে। ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি মাধ্যমকে ব্যবহার করে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ঈদ শুভেচ্ছা।
সাম্প্রতিককালে ঈদ উৎসবে যোগ হয়েছে এক উৎকট বাণিজ্য কৌশল। ঈদ উপলক্ষে নানা পণ্যের চটকদার বিজ্ঞাপন মানুষকে দিশাহারা করছে। বিলাসপণ্য- গাড়ি, বাড়ি, টিভি, রেফ্রিজারেটর, ফার্নিচার, এসি (শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র) থেকে শুরু করে এমন কোনো জিনিস নেই, যার ‘মূল্য ছাড়ের’ গল্পে বুঁদ হচ্ছে না মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সারাবছরের বাণিজ্য ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার এ-ও এক নবতর কৌশল। যে কৌশলের ফাঁদে পড়ে অনেক পরিবারের ঈদ নিদারুণ দুঃখে ঢেকে যায়। ‘পাখি ড্রেস’ কিনে না দেওয়ায় কোমলহৃদয় কিশোরীদের আত্মহত্যা ঈদ উৎসবে এঁকে দেয় নিদারুণ ক্ষতের চিহ্ন। অন্যদিকে কিছুসংখ্যক বিত্তবান মানুষের বিবেচনাহীন জাঁকজমকপূর্ণ ঈদ আয়োজন বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের দেশে সমতাহীন সমাজ ব্যবস্থাকে সামনে নিয়ে আসে।
তথ্যসূত্র:
১. আর-রাহীকুল মাখতুম—আল্লামা সফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহ.)
২. তবকাত-ই-নাসিরী—মীনহাজ-ই সিরাজ
৩. নবাবী বাংলার অভিজাত শ্রেণি (রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি)—মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান
৪. বাবরনামা— জহির উদ্-দিন মুহম্মদ জালাল উদ-দিন বাবর
সারাবাংলা/এসবিডিই
আসাদ জামান ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ প্রবন্ধ বিবর্তনের ধারায় পুষিয়ে নেওয়ার ঈদ