কেমন ছিল একযুগ আগের সাজেক
২৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:০৪
ভ্রমণ গন্তব্য হিসাবে সাজেকের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকে রীতমতো গিজগিজ করে জায়গাটি। আমার নিজেরও খুব প্রিয় এই পাহাড়ি জনপদ। তবে কখনও কখনও সেখানে গিয়ে এতো মানুষের ভীড় দেখে কেমন হাঁসফাস লাগে।
মনে হয় পুরনো সেই সাজেকই ভালো ছিল। কে বলবে কেবল কয়েকবছর হলো সাজেককে চিনেছেন সাধারণ পর্যটকেরা। কেমন ছিল আগের সাজেক? সে গল্পই বলব আজ। ছবিও তখনকার তোলা।
চলুন তাহলে পাঠক, টাইম মেশিনে চেপে বসা যাক। তবে খুব বেশি আগে নিয়ে যাবো না আপনাদের। সময়টা, ২০১১ এর গ্রীষ্ম। বহুদিন পর কলেজ জীবনের দুই জিগির দোস্ত মিশুক-মেহেদির সঙ্গে আবার দেখা। ঠিক করলাম সাজেক ভ্রমণের মাধ্যমে উদযাপন করব।
শুনেছিলাম ভারতের সেভেন সিস্টারের অন্তর্গত দুই রাজ্য মিজোরাম এবং ত্রিপুরার সীমান্তের এই পাহাড়ি জনপদে না চাইলেই মেঘেরা এসে ধরা দেয়, তবে বর্ষা আর শরতে মেঘের দাপট বেশি। পল্লব ভাই ঘুরে গিয়েছিলেন, বললেন সুযোগ পেলে সাজেকের কংলাকের কারবারির বাড়িতে ঢুঁ মারতে। কারবারির মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল তার।
ঢাকা থেকে এক রাতে চেপে বসলাম খাগড়াছড়ির বাসে। এর আগে খাগড়াছড়ি গিয়েছি, তবে রাঙামাটি থেকে। ঢাকা থেকে তাই এটাই প্রথম পাহাড়ি জেলাটিতে যাত্রা। খাগড়াছড়ি যাওয়ার পথে হঠাৎ যখন বা দিকে পাহাড়শ্রেণীর ভেতর প্রবেশ করল বাস, ভাবলাম বুঝি বা পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকে পড়েছি! সামনে আঁকাবাকা পথে দুলতে-দুলতে একটা ট্রাক যাওয়ার দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠে উপলব্ধি করলাম, আমাদের বাসটাও এভাবেই যাচ্ছে।
দূরে নিচের রাস্তায় চলতে থাকা পিক আপটা যেন ম্যাচবাক্স। এসময়ই টলতে টলতে এগিয়ে আসা টিকেট চেকার চমকে দিল আমাদের, বলল এই উঁচু পাহাড়গুলো পড়েছে সীতাকুন্ড-মিরসরাই রেঞ্জে।
আমি তখন চাকরি করতাম কালের কণ্ঠে। খাগড়াছড়ি পৌঁছার পর কালের কণ্ঠের খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি দাউদ ভাই সব ব্যবস্থা করলেন। চান্দের গাড়িতো ঠিক করলেনই, কলেজ পড়ুয়া স্থানীয় এক ছেলেকেও জুটিয়ে দিলেন সফরসঙ্গী হিসাবে। এখন অবশ্য নামটা ভুলে গিয়েছি হাসি-খুশি ওই তরুণের।
সাজেক তখন সাধারণ পর্যটকদের কাছে নেহায়েত অপরিচিত এক রাজ্য। কালেভদ্রে আর্মির অনুমতি সাপেক্ষে অতি উৎসাহী কেউ কেউ যায়। পথে ঝামেলা হয়নি। সেনা চেকপোস্টগুলোয় শুধু নাম-পরিচয় লিখতে হয়েছে।
চান্দের গাড়িতে অনায়াসে ১২-১৪ জনের জায়গা হয়ে যায়, সেখানে আমরা ড্রাইভার-হেলপার সমেত ছয়জন। গাড়িতে ফাঁকা জায়গা বিস্তর, তাই সেনাদের অনুরোধে এক চেক পোস্ট থেকে আরেক চেক পোস্টে খাবারের বস্তাও পৌঁছে দিলাম।
এমন রাস্তায় ওটাই প্রথম যাত্রা। দূরের আকাশমুখী ফিতার মত জিনিসটা যে রাস্তা, আর একটু পরে ওটা পেরোতে হবে এটা বুঝতে পেরে গা কাঁটা দিচ্ছিল।
আবার চালক যখন খাড়া ঢালগুলো ভোঁ-টানে পেরোচ্ছিল, অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ ছড়িয়ে পড়ছিল শরীরময়। যেখানটায় কাচালং ও মাচালং নদী এক হয়েছে তার ওপরের সেতুটায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে মুগ্ধ চোখে দেখছিলাম। জলে এক দাঙ্গল স্থানীয় ছোট ছেলে দাপাদাপি করে একই সময়ে দুই নদীতে গোসলের মজা নিচ্ছিল।
ধুলোয় ধুসরিত হয়ে রুইলুই পাড়ায় যখন পৌঁছালাম, স্থানীয়দের বাড়ি-ঘর ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনি। একটা রিসোর্টও ছিল না। কখনও কখনও দু-চারজন পর্যটক রাত কাটায়, স্থানীয় পাংখোয়া বা লুসাইদের বাড়িতে। ওখানে খুব একটা সময় দাঁড়াইনি। শুরুতে সেনা সদস্যরা একটু গাইগুঁই করলেও পরে আরও এগুবার অনুমতি মিলল।
সরু পথ ধরে কংলাক পাহাড়ের দিকে রওয়ানা দিলাম। গাড়ি থেকে নেমে পাহাড়ে ওঠার সময় গাছপালা পোড়ার কারণে সৃষ্টি হওয়া নীল একটা ধোঁয়া ঘিরে ধরেছিল, মনে পড়ছে স্পষ্ট।
গ্রীষ্মের দাবদাহে পাহাড় বেয়ে কংলাকে উঠে হাঁফাতে লাগলাম। সবুজের একটু ঘাটতি আছে, তবে কাছে ও দূরের পাহাড়রাজ্যে এখানে সেখানে নীল ধোঁয়াদের বিস্তার, হালকা মেঘের জেঁকে বসার চেষ্টা দেখে শরীরটা জুড়িয়ে গেল। পাহাড়ের গায়ে হঠাৎ হঠাৎ জুমঘরগুলোও টানছিল। মনে হচ্ছিল, আহ্ ওখানে একটা রাত কাটাতে পারলে মন্দ হতো না। হয়তো বুনো শুয়োর বা মায়া হরিণের দেখাও পেয়ে যেতাম।
একটু পর পল্লব ভাইয়ের নির্দেশিত সেই কারবারির বাড়িতে গিয়ে শরবত জুটল। কারবাররি মেয়ের মিজোরামের বাসিন্দা জামাইয়ের দর্শনও লাভ করি। ভাঙা ভাঙা বাংলায় গল্প করার চেষ্টা করলেন আমার সঙ্গে। কারবারির বাড়ির দেয়ালে ঝুলতে থাকা সম্বরের মাথাটা থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না।
মিজো জামাইকে সুধালাম বাঘ আছে? ইশারায় দূরে দেখিয়ে বুঝালেন মিজোরামের বড় রিজার্ভে বাঘ আছে। পরে অবশ্য খোঁজ-খবর নিয়ে জেনেছিলাম সাজেকের সীমানার পরেই শুরু মিজোরামের ডামপা টাইগার রিজার্ভ। সাজেকের লোকেরা এখনও পাহাড়ের গভীরে বাঘ দেখার গল্প বলে। আমি বিশ্বাস করি সাজেক-কাসালংয়ের পাহাড়ি রাজ্যে এখনো ঘুরে বেড়ায় প্রিয় বাঘেরা।
আশপাশের অন্য ঘরগুলো ঘুরেফিরে দেখার সময় এক পাংখোয়াকে বিশাল এক বাঁশের হুকো টানতে দেখে চমকেছিলাম, তবে পরে পার্বত্য চট্টগ্রামে এ ধরনের হুকো অনেকই দেখেছি।
সাজেকে তখন বেশ কয়েক ঘর পাংখোয়া ছিল। শুনেছি এখন অনেক পাংখোয়াই পাহাড়ের আরো গভীরে সরে পড়েছে, ওরা লোকজনের ভীড়-বাট্টা কম পছন্দ করেন কিনা!
সাজেক থেকে যাচ্ছিলাম বাঘাইছড়ি, যার আরেক নাম মারিশ্যা। কিছুদূর এগুতে না এগুতেই খবর মিলল গোলমালের জের ধরে একটা গাড়ি পুড়েছে পথে। আমাদের চালক ভয় পেয়ে বাঘাইহাট থেকে বিকল্প পথ ধরল বাঘাইছড়ি যাওয়ার। ভয়ানক সে রাস্তা।
এখনো মনে আছে, কয়েকবার ছিটকে গাড়ির ভেতরে পড়েছিলাম। মেহেদি তো পাঁজরে এমন ব্যাথা পেয়েছিল, পরের কয়েকবছর যন্ত্রণা এই সফরের কথা ভুলতে দেয়নি। এক চাকমা পরিবারকে তুলে নিয়েছিলাম গাড়িতে। ওদেরও সাহায্য হয়েছিল, আমাদেরও অচেনা পথের ধাঁধা কাটে অনেকটা। ভয় পাচ্ছিলাম, মূল রাস্তায় একটু পর পর আর্মি ক্যাম্প পড়ে, এখানে তো তাও নেই! বিপদ হলে? দুরু দুরু বুকে শেষমেষ অক্ষতদেহেই পৌঁছে যাই মারিশ্যা।
সেখান থেকে পরে গিয়েছিলাম কাসালং রিজার্ভের দিকে। জঙ্গল খুব একটা দেখা না হলেও ছোট্ট এক বুনো হাতি আর তার মায়ের সঙ্গে আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তবে সে গল্প আজ নয়।
এখনকার রিসোর্ট-কটেজে ভরা সাজেকেও যে আমার কাছে খারাপ লাগে তা নয়। আধুনিক সাজেকেও অনেকবারই গিয়েছি। কোনো একটা রিসোর্ট বা কটেজের বারান্দায় দাঁড়ালেই যেন অন্য এক জগতে চলে যাই, যেখানে আমি ছাড়া আর কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই। আছে শুধু একের পর এক পাহাড় আর তার গায়ে সবুজ অরণ্য।
কিংবা কোনো একটি পায়ে চলা পথ ধরে পাহাড়ের অন্দি-সন্ধিতে ঘুরে বেড়াবার মজারও তুলনা নেই। কর্মব্যাস্ত সাজেক তখন পেছনে পড়ে থাকে, আমি হারিয়ে যাই প্রিয় পাহাড়-বনানীর রাজ্যে।
সাজেক আমার যেমন প্রিয়, অনেকেরই প্রিয় হতে পারে। আমি যদি যেতে পারি, অন্যরাও যাবেন এটাই তো স্বাভাবিক। তবে একটাই অনুরোধ মেঘের ওই আশ্চর্য সুন্দর রাজ্যকে ময়লা-আবর্জনাময় করে তুলবেন না। প্রকৃতিকে সুস্থ রেখেই ঘুরে আসুন।
ছবি: লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইশতিয়াক হাসান ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ কেমন ছিল একযুগ আগের সাজেক ভ্রমণ