‘নিকাহ রেজিস্ট্রারের ছেলের লাইসেন্স পাওয়া অগ্রাধিকার নয়’
২৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৭:৪৬
ঢাকা: কোনো নিকাহ রেজিস্ট্রারের মৃত্যু বা অবসরজনিত কারণে লাইসেন্সের কার্যকারিতার অবসান ঘটলে নতুন লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নিকাহ রেজিস্ট্রারের পুত্র সন্তান অগ্রাধিকার পাবেন এমন বিধান অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি কাশেফা হোসেন এবং বিচারপতি কাজী জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের দেওয়া এমন রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত এক নিকাহ রেজিস্ট্রারের ছেলের দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুল খারিজ করে ২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর এই রায় দেন হাইকোর্ট।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ওজি উল্লাহ, মো. ইসমাইল হোসেন ভূঁইয়া, মো. আবুল কালাম ও মো. ওমর ফারুক।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নূর-উস সাদিক চৌধুরী, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সৈয়দা সাবিনা আহমেদ মলি, ফরিদা পারভীন ফ্লোরা।
আর তজুমদ্দিন উপজেলার ইউএনওর পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম কে রহমান ও আইনজীবী মো. শরীফুল ইসলাম।
রায়ে আদালত বলেছেন, আমাদের বিবেচিত দৃষ্টিভঙ্গি হলো ‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ (সংশোধিত ২০১৩)’ অনুযায়ী ৬ (৬ক) বিধিটি; বিধি ৫ এবং বিধি ৬(৫) এর সুস্পষ্ট বিধানের অধীনে প্রযোজ্য হতে পারে না।
রায়ে আদালত আরও বলেন, এটি স্পষ্ট যে, আবেদনকারী মেধা তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে ছিলেন। তাই আমাদের বিবেচিত দৃষ্টিভঙ্গি হলো ‘নিকাহ রেজিস্ট্রার লাইসেন্স মঞ্জুরি উপদেষ্টা কমিটি’ মেধাতালিকা অনুসরণ করে প্যানেল প্রস্তুত করে কোনো বেআইনি কাজ করেনি।
অতএব, আমরা এই রুলের গ্রহণযোগ্যতা খুঁজে পাই না। তাই রুলটি খারিজ করা হলো।
‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ (সংশোধিত ২০১৩)’ এর বিধি ৬ (৬ক) এ বলা হয়েছে-
৬ (৬ ক): যদি কোন সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ এলাকার কোন নিকাহ রেজিস্ট্রারের মৃত্যু বা অবসরজনিত কারণে লাইসেন্সের কার্যকারিতার অবসান ঘটে তাহা হইলে উপ-বিধি (৪) এর অধীন নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স প্রধানের উদ্দেশ্যে প্রার্থী বাছাই এবং উপ-বিধি(৬) এর অধীনে লাইসেন্স মঞ্জুরের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নিকাহ রেজিস্ট্রারের পুত্র সন্তানকে, বিবি ৮ এর অধীন যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে অগ্রাধিকার প্রদান করিতে হইবে।’
তবে একই বিধিমালার ৫ এ বলা হয়েছে-
‘৫। উপদেষ্টা কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলী-উপদেষ্টা কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলী হইবে নিম্নরূপ, যথা-
ক) এই বিধিমালার অধীন সরকার কর্তৃক নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স মঞ্জুর করিবার উদ্দেশ্যে, প্রাপ্ত দরখাস্ত পর্যালোচনাপূর্বক তিনজন প্রার্থীর একটি প্যানেল প্রস্তুত করিয়া উহা সরকারের নিকট প্রেরণ; এবং
খ) এই বিধিমালার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, অন্য যে কোন কার্য সম্পাদন ও প্রয়োজনে সরকারকে পরামর্শ প্রদান।
আর ‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ (সংশোধিত ২০১৩)’ এর বিধি ৬ (৫) এ বলা হয়েছে-
৬ (৫): উপদেষ্টা কমিটি প্রতিটি লাইসেন্সের বিপরীতে তিনজন প্রার্থী বাছাই করিবে এবং সংশ্লিষ্ট জেলা রেজিস্টার বা সাব রেজিস্টার উপ-বিধি (৪) এর অধীন বাছাই সম্পন্নের পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে সকল দরখাস্ত এবং প্রয়োজনীয় দলিলাদিসহ তিনজন প্রার্থীর প্যানেল সরকারের নিকট প্রেরণ করিবে।’
এখানে উপদেষ্টা কমিটি বলতে ‘নিকাহ রেজিস্ট্রার লাইসেন্স মঞ্জুরি উপদেষ্টা কমিটিকে’ বুঝানো হয়েছে।
এর আগে মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ (সংশোধিত ২০১৩)’ এর বিধি লঙ্ঘন করে ২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তজুমদ্দিন উপজেলা সাব রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষরে (যিনি উপজেলা নিকাহ রেজিস্ট্রার লাইসেন্স মঞ্জুরি উপদেষ্টা কমিটির সদস্য সচিব) লাইসেন্স প্রদানে বাছাইকৃত তিন জনের নাম সুপারিশ করাকে কেন বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে রিটকারীকে তজুমদ্দিন উপজেলার ৫ নং শম্ভুপুর ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স প্রদানের জন্য কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়।
ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার ৫ নং শম্ভুপুর ইউনিয়নের অবসরপ্রাপ্ত নিকাহ রেজিস্ট্রার মো. খুরশেদ আলমের ছেলে মো. মাহমুদুল হাসানের দায়ের করা রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ২০২১ সালের ২৪ মার্চ এই রুল জারি করেন।
এর আগে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা ৬ এর জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব, নিবন্ধন মহাপরিদর্শক, ভোলার জেলা রেজিস্ট্রার, তজুমদ্দিন উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার, তজুমদ্দিন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)সহ ১১ জনকে বিবাদী করে রিট দায়ের করেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার শম্ভুপুর ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার মো. খুরশেদ আলমের ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ায় তিনি অবসরে যান। এরপর উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার নতুন নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগে দিতে বিজ্ঞপ্তি জারি করলে তাতে খুরশেদ আলমের ছেলে মাহমুদুল হাসান আবেদন করেন এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে মাহমুদুল হাসান চতুর্থ হন।
পরে নিয়োগের জন্য গঠিত ‘নিকাহ রেজিস্ট্রার লাইসেন্স মঞ্জুরি উপদেষ্টা কমিটি’ মেধা তালিকায় ১ম, ২য় এবং তৃতীয় স্থান অধিকার করা তিনজনের নাম সুপারিশ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ প্রেরণ করে।
এরপর ২০২১ সালের ৭ এপ্রিল আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক সচিব, ও আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা-৬ এর জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবের কাছে ‘নিকাহ রেজিস্ট্রার লাইসেন্স মঞ্জুরি উপদেষ্টা কমিটির’ সুপারিশ বাতিল চেয়ে আবেদন করেন মাহমুদুল হাসান।
সেই আবেদনের পর উপদেষ্টা কমিটির দাখিল করা সুপারিশ বাতিল এবং এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এ কারণে মাহমুদুল হাসান সংক্ষুব্ধ হয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর এ বিষয়ে জারি করা রুল খারিজ করে রায় দেন হাইকোর্ট।
এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন রিটকারী মাহমুদুল হাসান। যা এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
রিটকারীর আইনজীবী মো. ইসমাইল হোসেন ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাইকোর্ট মাহমুদুল হাসানকে নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স প্রদানের বিষয়ে জারি করা রুল খারিজ করে রায় দিয়েছেন। তবে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে নিয়মিত আপিল (সিপি ফাইল) দায়ের করা হয়েছে। যা এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে।’
সারাবাংলা/কেআইএফ/একে