Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চট্টগ্রামের ভাষায় কথা-গানে ‘চাটগাঁইয়া ঈদ উৎসব’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৬ এপ্রিল ২০২৩ ২২:০৫

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ঈদুল ফিতরের সঙ্গে বাড়তি উৎসবের মাত্রা নিয়ে এসেছে চট্টগ্রামের আব্দুল জব্বারের বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা। লালদিঘীর মাঠে সাড়া জাগিয়ে হয়ে গেল বলী খেলা। এবার তিন দিনের বৈশাখী মেলার আনন্দ উদযাপনের শেষ দিনে যোগ হল ‘চাটগাঁইয়া ঈদ আনন্দ উৎসব’। নগর সংস্কৃতির আধিপত্যকে একপাশে রেখে এদিন নাচে-গানে, বর্ণাঢ্য আয়োজনে তুলে ধরা হল চট্টগ্রামের চিরায়ত সংস্কৃতিকে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী গতবছর থেকে ‘চাটগাঁইয়া ঈদ আনন্দ উৎসব’ নামে নতুন এই আয়োজন শুরু করেছেন। বছর পার হতেই এই উৎসব চট্টগ্রামের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্মিলন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই উৎসবে ছিলেন বিশিষ্ট নাগরিকরাও।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (২৬ এপ্রিল) বিকেলে উৎসবে যোগ দিতে নগরীর লালদিঘী ময়দানে ছিল হাজারো মানুষের উপচে পড়া ভিড়। উৎসবের শুরুতেই রোভার স্কাউটের সদস্যরা নিজেদের সাজ-পোশাকে গ্রামবাংলার আবহমান ঐতিহ্য ফুটিয়ে তুলে অতিথিদের সামনে হাজির হন। কেউ শাড়ি ও ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ে সেজেছেন, কেউ লাঠিয়াল, বাউল, দইওয়ালা, জেলে, বউ-জামাই, আবার কেউ সাপুড়ে।

ডিসপ্লে শেষে নগরীর লালদিঘী ময়দানের ছয় দফা মঞ্চে বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব এম এ মালেক। উদ্বোধকসহ অতিথিরা সবাই চট্টগ্রামের ভাষায় বক্তব্য দেন। উদ্বোধনের পর বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়।

এরপর স্কুল অব ওরিয়েন্টাল ডান্সের শিল্পীদের নৃত্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসবের সাংস্কৃতিক পর্ব। এ পর্ব পরিচালনায় ছিলেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও চাটগাঁইয়া সঙ্গীত গবেষক নাসির উদ্দিন হায়দার।

বিজ্ঞাপন

ছয় বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে চাঁটগাইয়া উৎসবের আয়োজন দেখতে আসা ব্যাংকার নাবিলা তানজিনা সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেয়েকে নিয়ে বৈশাখী মেলায় এসেছিলাম কিছু কিনতে। এখানে এসে দেখি চাটগাঁইয়া ঈদ উৎসব হচ্ছে। গত বছর এই উৎসবে আসার কথা থাকলেও সময়ের অভাবে পারিনি। এবার আসতে পেরে খুব ভালো লাগছে। মেয়েকেও দেখাচ্ছি, সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সব বুঝিয়ে দিচ্ছি।’

চট্টগ্রামের ভাষা ও সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে ‘চাঁটগাইয়া ঈদ আনন্দ উৎসব’ প্রতিবছর করার তাগিদ দেন এম এ মালেক। তিনি বলেন, ‘বৈশাখ মাস বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। বৈশাখ মাস এলেই গ্রাম-শহরে অনেক জায়গায় নানারকম মেলা ও খেলা হয়। চট্টগ্রামের আব্দুল জব্বারের বলী খেলা এখন বাংলাদেশ ছাড়িয়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এটাই আমাদের সংস্কৃতি।’

‘চট্টগ্রামের ভাষা ও যে সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যদি আমরা এসব ঠিকভাবে শিখিয়ে না যেতে পারি তাহলে অন্য ভাষা, সংস্কৃতির মতো এটাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই চাঁটগাইয়া উৎসব প্রত্যেক বছর করতে হবে।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘গত বছর কয়েকজন তরুণ আমার কাছে এসে বলেছিল জব্বারের বলী খেলা হবে কিনা। আমি তখন নিজস্ব অর্থায়নে জব্বারের বলী খেলার আয়োজন করেছিলাম। এবার আরও সুন্দর করে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। সঙ্গে চাঁটগাইয়া উৎসবেরও আয়োজন হয়েছে। চট্টগ্রামের ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববাসীকে জানাতে প্রতি বছর চাঁটগাইয়া উৎসব হবে।’

বাঙালি সংস্কৃতিকে কেউ কেউ ধর্মের বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে চায় অভিযোগ করে আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন বলেন, ‘সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির শেকড়। শেকড় ছাড়া যেমন গাছ বাঁচতে পারে না, তেমন সংস্কৃতি ছাড়াও কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। আমাদের দেশে কিছু মানুষ এখন বৈশাখ উৎসবকে হারাম ঘোষণা করে ফতোয়া দিচ্ছে। বৈশাখ মাসে কেউ ইলিশ মাছ খেলে তাদের ঈমান শেষ। বাঙালি সংস্কৃতিকে ওরা ইসলামের বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। ওরা আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিতে চায়।’

‘চাঁটগাইয়া ঈদ আনন্দ উৎসব উদযাপন পরিষদ’র সভাপতি কাউন্সিলর জহরলাল হাজারীর সভাপতিত্বে ও আবৃত্তিশিল্পী দিলরুবা খানমের সঞ্চালনায় সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়শা খান, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি চৌধুরী ফরিদ, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা দেবাশীষ পাল দেবু, হেলাল উদ্দিন, আরশেদুল আলম বাচ্চু, নুরুল আজিম রনি এবং নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর বক্তব্য দেন।

আয়োজনের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের মানুষের আলাদা সংস্কৃতি আছে, আলাদা ভাষা আছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তান ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের মানুষের অবদান আছে। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের বিশাল অবদান আছে। চট্টগ্রামের ইতিহাস–ঐতিহ্যকে বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরতে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।’

বৈশাখী মেলা জমজমাট

চট্টগ্রামের প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে চলা বৈশাখী মেলা বুধবার শেষদিনে এসে আরও মুখর হয়ে উঠেছে। হাজার, হাজার ক্রেতার ভিড়, বিক্রেতার হাঁকডাক, বাঁশির সুর, ভুভুজেলার শব্দ- সবমিলিয়ে একাকার মেলা অঙ্গন।

বুধবার দুপুরে দেখা যায়, কেউ বাচ্চাদের নিয়ে নাগরদোলায় চড়ছেন। কেউ আবার শখের পণ্য কিনছেন। সবচেয়ে বেশি ভিড় লেগে আছে গৃহস্থালী পণ্যের দোকানগুলোতে। বিক্রেতারা গতবারের তুলনায় এবার ভালো বেচাকেনা হওয়ার কথা জানিয়েছেন। ঈদের ছুটি আর বৈশাখী মেলা প্রায় একসঙ্গে হওয়ায় লোকজন সময় নিয়ে মেলায় ঘুরছেন ও ইচ্ছে মতো পণ্য কিনছেন।

টাঙ্গাইল থেকে মাটির তৈজসপত্র নিয়ে আসা টিটু দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ২০ বছর ধরে আমি মেলায় পণ্য নিয়ে আসছি। কিন্তু এত বিক্রি গত কয়েক বছরে হয়নি। এবার খুব ভালোই বেচাকেনা হয়েছে। সেইসঙ্গে মেলা কমিটিও আন্তরিকভাবে আমাদের সহযোগিতা করছে।’

‘চট্টগ্রামের নানাভাই’ নামে পরিচিত শোপিজ বিক্রেতা আবুল মকসুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সব মিলিয়ে দুই লাখ টাকার মতো বিক্রি হয়েছে গত দুই দিনে। আজ সেটা তিন বা সাড়ে তিন লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে আমার সব পণ্য বিক্রি হয়ে যাওয়ায় ঝামেলায় পড়েছি। ঢাকায় যোগাযোগ করেছি। সেখান থেকেও আর মালামাল পাঠাতে পারবে না বলছে।’

মেলায় ঘুরতে আসা পোশাককর্মী ফরিদা ইয়াসমিন আঁখি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছিলাম। পরশু আসার কথা ছিলো। কিন্তু আজ মেলার শেষ দিন। সেজন্য সকালেই বাড়ি থেকে এসে বিকেলে রুমমেটদের নিয়ে কিছু জিনিস কিনতে এসেছি।‘

এদিকে, মেলার সময় আরও বাড়ানো হতে পারে বলে আভাস মিলেছে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে পুলিশের সিদ্ধান্তের ওপর। মেলা কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিক্রেতাদের কথা চিন্তা করে মেলার সময় বাড়ানোর চেষ্টা করছি।’

সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম

চাটগাঁইয়া ঈদ উৎসব টপ নিউজ বৈশাখী মেলা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর