৫০ কোটি টাকার পানির প্রকল্পে ‘অনিয়ম’, আলোয় আসেনি তদন্ত প্রতিবেদন
২৮ এপ্রিল ২০২৩ ১৭:৩৮
বাগেরহাট: বিশুদ্ধ পানির জন্য ২০০৬-০৭ সালে মোংলায় ৮৪ একর জমির ওপর পানি প্রকল্প নেওয়া হলেও তা কোনো কাজে লাগছে না। ৫০ কোটি টাকার এই প্রকল্পে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও আলোর মুখ দেখেনি এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন। এদিকে মোংলা পোর্ট পৌরসভায় পানির সংকট ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। অনাবৃষ্টি ও চলমান তাপদাহে পানির এ সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে পানি সরবরাহ প্রকল্পের পুকুর।
প্রকল্প শুরুর গলদে বিশুদ্ধ পানির সংকট লেগেই থাকছে এখানে। গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ৩ কোটি লিটার পানির চাহিদা থাকলেও নাম মাত্র ৬০ লাখ লিটার পানি সরবরাহের কথা বলছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে তা অর্ধেকেরও কম। এ অবস্থায় রেশনিং পদ্ধতিতে সরবরাহকৃত পানির ওপরই ভরসা পৌরবাসীর।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল বাগেরহাটের মোংলা উপজেলা। ১৯৭৫ সালে ১৯ দশমিক ৪৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তন নিয়ে মোংলা পোর্ট পৌরসভা গঠিত হয়। ধাধে ধপে এটি এখন প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় রূপান্তরিত হয়েছে। সমুদ্র লাগোয়া ও নদী-খালবেষ্টিত উপজেলা ও পৌর এলাকার এ জনপদে লবণাক্ততার আগ্রাসন প্রায় বছর জুড়েই। চৌদিকে অর্থই পানি থাকলেও পানযোগ্য ও বিশুদ্ধ পানির বড়ই অভাব এখানে।
এ সংকট লাগবে সরকারিভাবে ২০০৬-২০০৭ সালে মোংলা পোর্ট পৌরসভার পানি সরবরাহ ও এনভায়রনমেন্টাল স্যানিটেশন প্রকল্প নেওয়া হয়। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এককালীন ৮৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ফেইস-১ ও ফেইস-২ ভাগে বিভক্ত প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ৫০ কোটি টাকা।
২০১২-২০১৩ সালে প্রথম দফায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রথম ফেইসের কাজ শুরু হয়। প্রথম দফার কাজেই ত্রুটি রেখে দায়সারা শেষ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণে ২০১২-২০১৩ সালে আরও ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হয় প্রকল্পের দ্বিতীয় ফোইসের কাজ। প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন ও সীমানা প্রচীর, পানি শোধনাগার, উচ্চ জলধারা, ইস্পান্ডিং রিজার্ভার নির্মাণ, সাইড ওয়াল নির্মাণ ইনকেট স্টেশন, পাইপ লাইন ওবিদ্যুৎ সংযোগসহ বিভিন্ন প্যাকেজে কাজ করেন একাধিক ঠিকাদার। দৃশ্যমান এ সব কাজ নিয়ে বির্তক থাকলে প্রকল্পের পুকুর খননে অসঙ্গতি ধরা পড়ে।
প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেইসের পুকুর খননে ৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকার কাজ পায় মেসার্স মনির ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গফুটের এ পুকুর ১০ ফুট গভীরতার কথা থাকলেও মাত্র সাড়ে ৪ ফুট গভীরতা করেই প্রকল্প কর্মকর্তা দীপক চন্দ্র তালুকদার ও আরও ২ জন জন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সঙ্গে যোগসাজসে পুরো বিল তুলে নেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত পৌর মেয়র মোল্লা আব্দুল জলিল এ প্রকল্পসহ নানা দুর্নীতি অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। দুদকের একাধিক মামলার ঘানি টানতে হয় তাকে। আর পরবর্তী বিএনপি নেতা জুলফিকার আলী মেয়র নির্বাচিত হয়ে টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকা কারে বুঝে নেননি দুর্নীতির পানি প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেইস। কাগজ-কলমে বুঝে না নিলেও প্রকল্পের দায়িত্ব পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে স্থান্তরিত হয়।
বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুর রহমানও লুটপাট ও অনিয়মের এ প্রকল্পে বুঝে নিচ্ছেন না। এরই মধ্যে বদল হয়েছে তিন জন পৌর মেয়র ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের কর্মকর্তারাও। যে যার মতো শরিক হয়েছেন দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাটে। কিন্তু পৌরবাসীর বিশুদ্ধ পানির সংকটের দুর্ভোগ লেগেই থাকছে। বিগত কয়েক বছরেও প্রকল্পটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি পৌর কর্তৃপক্ষেকে। আর এ প্রকল্পটি বুঝিয়ে দেওয়া ও বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে ঘুরে ফিরে উঠে আসে অনিয়মের নানা চিত্র। তাই পৌর কর্তৃপক্ষ ও জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এ অবস্থায় বদল হয়েছে পৌর মেয়র ও প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা।
সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের কর্মকর্তাদের কেউ এখন অবসরে আবার কেউ অবসরের অপেক্ষায় রয়েছেন। একে অপরের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে যে যার মতো সেরে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। আর এতে ভোগান্তি বাড়ছে পৌরবাসীর।
পৌর এলাকার ৯ নংওয়ার্ডের বাসিন্দা জলিল হাওলাদার বলেন, ‘সরবরাহের লাইনে পানি আসছে না । তীব্র গরমের মধ্যে নদীর নোনা পানির ওপর ভরসা করতে হচ্ছে তাদের।’
পৌর শহরের ৫ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ফুল মিয়া হাওলাদার বলেন, ‘নদী-খাল বিল সহ চৗদিকে অথই পানি কিন্তু বিশুদ্ধ পানির বড়ই অভাব। দিন মজুরের কাজে না গিয়ে কলস ও ড্রাম নিয়ে জীবন বাঁচাতে ছোটাছুটি করতে হয় এখানে সেখানে।’
এ বিষয় প্রকল্প পরিচালক দীপক চন্দ্র তালুকদার (অন্যত্র দায়িত্ব থাকা) বলেন, ‘প্রকল্পের সব কিছু ঠিকঠাক আছে। পৌর কর্তপক্ষ বুঝেও নিয়েছেন। ঠিক আছে পানি সরবরাহ।’
মোংলা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের কর্মকর্তা প্রকৌশলী মো. সোয়ান আহম্মেদ জানান, দ্বিতীয় ফেইসের পুকুর খননের ঠিকাদার জামানতের প্রায় ৪ কোটি টাকা এরইমধ্যে তুলে নিয়েছেন।
এ দিকে পৌর এলাকায় ভয়াবহ পানির সংকটের কথা স্বীকার করে তিনি আরও বলেন, ‘শুস্ক মৌসুমের শুরুতে প্রকল্পের পুকুর শুকিয়ে যাচ্ছে। থাকছে না পানি। এ কারণে পৌরবাসীর দুর্ভোগ চরমে পৌছেছে। এ অবস্থায় নতুন আরেকটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে জমা আছে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মোংলা পোর্ট পৌরবাসীর পানির সংকট লাগব হবে।’
পৌর মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুর রহমান জানান, মোংলা পৌট পৌর সভায় ৯টি ওয়ার্ডে স্থায়ী বাসিন্দা প্রায় ১২ হাজার আর অস্থায়ী বাসিন্দা প্রায় আরও ৬ হাজার।
তিনি বলেন, ‘১২ হাজার পরিবারের বিপরিতে প্রতিদিন সাড়ে ৩ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন। আর ১৮ হাজার পরিবারের জন্য প্রয়োাজন ৪ কোটি ৩০ লাখ লিটার পানি। বর্তমানে ২ হাজার ৫শ’ পরিবারের জন্য প্রতিদিন গড়ে সকাল-বিকেল ৬০ লাখ লিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। যা চাহিদার তুলনায় নগণ্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘খনন কাজে দুর্নীতির কারণে প্রকল্পের পুকুরে পানি থাকছে না। এ কারণে পৌরবাসীর পানির চাহিদা মিটছে না। এ অবস্থায় একটি মোবাইল ওয়াটার টিটমেন্ট প্লান্ট প্রতিটি ওয়ার্ডে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।’
কিন্তু বর্তমান শুস্ক মৌসুম ও তাপদাহের মধ্যে পানির সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বলে স্বীকার করেন পৌর মেয়র।
পৌরবাসীর পানির সংকট লাগবে দু’দফায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের প্রথম ফেইসের ২৫ কোটি টাকার কাজ লোকচক্ষুর আড়ালে পার হলেও দ্বিতীয় ফেইজের পরবর্তী ২৫ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি অনিয়মের বিস্তার অভিযোগ ওঠে।
আর এ বিষয় খতিয়ে দেখতে প্রথম দফায় খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক মো. জামানুর রহমানের নির্দেশনায় সাতক্ষীরা জেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহীদুল ইসলাম ও যশোর অভয়নগর এলাকার সহকারী প্রকৌশলী মো. মাহামুদুল আলা ২০২২ সালের ২ আগস্ট তদন্ত শুরু করে। এতে অগ্রগতি না হওয়া ওই বছরের ৮ সেপ্টেম্বর ফের তদন্তে নামেন ঢাকা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পূর্ত) মো. সরোয়ার হোসেন। এ কর্মকর্তা বর্তমানে প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করলেও এখনও আলোর মুখে দেখেনি তদন্ত প্রতিবেদন।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মো. সরোয়ার হোসেন এর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে কয়েক দফায় যোগাযোগ করা হলেও সুইচ বন্ধ পাওয়া যায়।
সারাবাংলা/একে