‘উন্নয়নের ঢাক-ঢোল বাজালেও নদী রক্ষায় সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই’
৫ মে ২০২৩ ১৮:৩৮
ঢাকা: বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সরকার উন্নয়নের ঢাক-ঢোল বাজায় সর্বক্ষণ। কিন্তু নদী রক্ষায় এবং নদীকে সঠিকভাবে পরিশুদ্ধ রাখার ব্যাপারে তাদের (সরকার) কোনো পরিকল্পনা চোখে পড়ে না। বুড়িগঙ্গা নদীর পাশ দিয়ে যান, দেখবেন কী দুর্গন্ধ।’
শুক্রবার (৫ মে) দুপুরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। ‘জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশ ও নদী’ শীর্ষক এই সেমিনার আয়োজন করে বিএনপি। এতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন হাসনা জসিমউদ্দিন মওদুদ।
বিএনপির শাসনামলে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ, খাল খনন কর্মসূচি চালু, থ্রি-স্টোক বেবি ট্যাক্সি চলাচল নিষিদ্ধসহ পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এখন এগুলোর (পরিবেশ দূষণ রোধ) উপরে কোনো গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে ঢাকা সবচেয়ে দূষিত নগরীতের পরিণত হয়েছে। এই বিষয়গুলোকে এডড্রেস করার জন্য, জনগণের ভবিষ্যৎ সুন্দর করার জন্য, জনগণের জীবন-জীবিকার পথগুলোকে সুগম করার জন্য তাদের খুব বেশি আগ্রহ নেই।’
‘কারণ, তাদের তো জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় না, তারা নির্বাচিত নয়, জোর করে ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। তাদের লক্ষ্য একটাই যে, যে করেই হোক ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে। এই কারণে পরিবেশ রক্ষায় তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই’, বলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, ‘এখন আমি বাংলাদেশের যেসব জায়গায় যাই, সেখানে নদী আর বেশি দেখতে পাই না। দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ঢাকার পাশেই বুড়িগঙ্গা আগে কেমন ছিল, আর আজকে সেই বুড়িগঙ্গায় কী দেখছি, শীতালক্ষ্মা কী দেখছি? মানুষের অবহেলায়, সরকারের অব্যবস্থাপনায়, তাদের পরিকল্পনার অভাবে নদীগুলো মারা যাচ্ছে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সাভার-ধামরাইতে ছোট ছোট যে নদী ছিল সেগুলো প্রায় মরে গেছে। আপনারা দেখেছেন যে, তুরাগ নদীর পাশে সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সহযোগিতায় ও তাদের সমর্থনের বিভিন্ন ক্লাব গড়ে উঠেছে। সেই ক্লাবগুলো একেবারেই নদীর ওপরে নদী ভরাট করে গড়ে তোলা। পানি কমে যাচ্ছে, নদী দখল করা হচ্ছে- এটার বিষয়ে খবর নিলেই দেখবেন, সরকারের সঙ্গে যারা জড়িত, তারাই এই কাজগুলো করছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না।’
টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে বিএনপির ভূমিকা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘টিপাইমুখ বাঁধ যখন নির্মাণ করতে যায় তখনই আপত্তি করেছিল বিএনপি সরকার, একইসঙ্গে বিএনপি আপত্তি করেছে, বিএনপি আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। যার জন্যে আমাদের ইলিয়াস আলীকে, সম্ভবত অনেক মনে করেন সেই কারণে তাকে গুম হতে হয়েছে। এটা বড় লড়াই, বড় সংগ্রাম। এই সংগ্রামে আমাদেরকে জিততে হবে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য, আমাদের গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদেরকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসতেই হবে। সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসতে পারলেই আমরা প্রকৃতিকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে পারব, উদ্যোগ নিতে পারব।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন যে, মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে আমাদের বাংলাদেশের নদীগুলো কী পরিমাণ গতি হারিয়েছে এবং কী পরিমাণ চরিত্রগতভাবে পরিবর্তন হয়েছে। একটা উদাহরণ প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে সেটা ফারাক্কা চুক্তি। এই চুক্তি আওয়ামী লীগ সরকার যখন দ্বিতীয় যে চুক্তি করেছিল সেটাতে গ্যারান্টি ক্লজ নাই। ফারাক্কা পয়েন্টে একটা গ্যারান্টি ক্লজ থাকতে হবে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন চুক্তি করেছিলেন এই ফারাক্কার গ্যারান্টি ক্লজ ছিল।’
‘আওয়ামী লীগ আমলের চুক্তিতে আমাদেরকে ফাঁকি দিয়ে ফারাক্কা পয়েন্টে গ্যারেন্টি রাখেনি। এখানে যা পানি ভাগাভাগি হবে সেটার একটা এবং সেখানে আমাদেরকে ফাঁকি দেওয়া হল, বলা হলো যে, ৩৩ হাজার কিউসেক পানি থাকবে। এখন কিন্তু অনেক সময় সেখানে ১২ হাজার কিউসেক পানিও থাকে না। কেননা ফারাক্কা পয়েন্টে গ্যারেন্টি নাই। তারা (ভারত) উপরি অঞ্চলে বেশির ভাগ পানি ব্যবহার করে ফেলছে ফারাক্কার সেই পয়েন্টে পানি আর আসছে না। অতএব বাংলাদেশ পানির ন্যায্য ভাগ পাচ্ছে না। তার প্রতিক্রিয়া কী আপনারা বাংলাদেশের পরিবেশ-জলবায়ু পরিবর্তনে তা দেখছেন’, বলেন ড. খন্দকার মোশাররফ।
সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। এই থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের জনগণকে সোচ্চার হতে হবে। সরকারকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে, সরকারের মেরুদণ্ড সোজা থাকতে হবে। বলতে হবে আমার দেশের নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আমরা চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘যৌথ নদী কমিশনের মিটিং বছরে ৪ বার হতে হবে, সেখানে আমাদের ন্যায্য হিস্যার গ্যারান্টি করে দিতে হবে প্রত্যেকটা চুক্তির গ্যারান্টি ক্লজ থাকতে হবে, আরবিটেশন ক্লজ থাকতে হবে। ইউএন কনভেনশন অব ১৯৯৭ ক্লজ আমাদেরকে রেটিফাইড করতে হবে। ভারত এটার চরম বিরোধী। আমরা এই পথ অবলম্বন করে আমাদেরকে নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করার সুযোগ আমাদের নিতে হবে।’
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল ফাইনেন্সের নির্বাহী প্রধান জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এম জাকির হোসেন খান বলেন, ‘বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে নদীর বিষয়ে শক্তিশালী অবস্থান নেওয়া উচিত। সে যত বড় শক্তিশালী হোক, যত ক্ষমতাশালী হোক, নদী দখলের ব্যাপারে নদী দূষণের ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান পরিস্কার করা উচিত। কারণ নদী দখলকারী, নদী দূষণকারী মানবতার শত্রু, প্রকৃতির শত্রু। আজকে বাংলাদেশ বাঁচবে যদি নদী বাঁচে। যারা নদীকে মেরে ফেলছে তারা বাংলাদেশের মানুষকে মেরে ফেলায় অবদান রাখছে।’
বিএনপির বন ও পরিবেশ বিষয়ক সহ বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল ও কাজী রওনাকুল ইসলাম টিপুর যৌথ সঞ্চালনায় সেমিনারে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন এবং সেভ দ্য সুন্দর ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম বক্তব্য রাখেন।
সারাবাংলা/এজেড/এমও